২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে অদ্যাবধি পর্যন্ত সরকারি কর্মচারীদের জাতীয় বেতনের স্কেল প্রদান করা হয়নি। যার ফলে নিম্ন বেতনভুক্ত কর্মচারীরা জীবনধারণের সব কিছুর দাম অসহনীয় বৃদ্ধি পাওয়ায় বেশিরভাগ কর্মচারীর তাদের সংসার চালাতে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। সবচেয়ে বেশি ঋণে জর্জরিত অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মরত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা।
তার প্রধান কারণ সাবেক শিক্ষকদের বেতন স্কেল ছিলো অফিস সহকারী তথা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের মলো। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে নন-ট্রেইন্ড মাস্টার্স গ্র্যাজুয়েট প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন ছিলো অফিস সহকারীদের নিচে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী ও প্রধান শিক্ষকদের বেতন স্কেল ছিলো অফিস সহকারীদের সমান। স্বাধীনতার পর হতে ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই স্বল্প পেনশনে প্রাথমিক শিক্ষকদের অবসরে যেতে হয়েছিলো। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির বেতন বৈষম্য দূরীকরণ আন্দোলনে আমাকে হাজতেও যেতে হয়েছিলো। সে আন্দোলনের প্রশিক্ষণবিহীন সহকারী শিক্ষকেরা ২৬০০ টাকা হতে ৩০০০ টাকা বেতন স্কেল পেয়েছিলো। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষকেরা তিন হাজার টাকার স্কেল থেকে ৩ হাজার ১০০ টাকা স্কেল পান। প্রধান শিক্ষকেরা ৩ হাজার ১০০ টাকা থেকে ৩৭০০ টাকা স্কেলে উন্নীত হয়।
এই স্বল্প বেতন নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষক সমাজকে অবসরে যেতে হয়েছিলো। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে বেতন স্কেল দুই গুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় পূর্বের পেনশনপ্রাপ্তদের সঙ্গে বর্তমান অবসরপ্রাপ্তদের বিশাল পেনশন এর বৈষম্য সৃষ্টি হয়। সাবেক সরকারের আমলে একই পদে বৈষম্য নিরসনের আবেদন নিবেদন করেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি। পাশাপাশি চিকিৎসার ব্যয়ও প্রায় সব দ্রব্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কয়েক গুণ বেড়েছে। চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধির আবেদন নিবেদন ও উপেক্ষিত হয়েছে।
৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে ২৫০০ টাকা অবসরভাতা নিতান্তই কম। সাধারণ প্রবীণরা অধিকাংশই চিকিৎসার মাঝে বেঁচে আছেন। বর্তমান চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহের জন্য সিনিয়র অবসরপ্রাপ্তদের জন্য কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। বিগত সরকারের সময় শতভাগ পেনশন সমর্পনকারীদের জন্য ১৫ বছর পর পুরো পেনশন প্রদানের আদেশটি অনেকটা শুভঙ্করের ফাঁকির মতো ছিলো। সাধারণত অবসর গ্রহণের পর ১৫ বছর খুব কম সংখ্যক কর্মচারী জীবিত থাকেন।
অপরদিকে শতভাগ পেনশন সমর্পণকারী, টাকা এককালীন বাড়তি গ্রহণ করে ছিলেন। সরকারের তহবিল থেকে মাসে মাসে টাকা গ্রহণ না করায় আট বছর চার মাসের সেই টাকা পরিশোধ হয়ে গিয়েছে। সে প্রেক্ষাপটে শতভাগ পেনশন সমর্পনকারীদের পুনরায় ১০ বছর পর পেনশন প্রতিস্থাপনের বিষয়টি বহু আবেদন নিবেদন করেও বিগত সরকারের সুদৃষ্টি অনুধাবন করা যায়নি।
সিনিয়র পেনশনভোগীদের তিনটি প্রধান প্রত্যাশা: ১. সমপদে পেনশন এর বৈষম্য দূর করা।
২. ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে চিকিৎসা ভাতা ১০ হাজার টাকা প্রদান। ৩. শতভাগ পেনশন সমপর্ণকারীদের যৌক্তিক ১০ বছর পর পেনশন পুনর্স্থাপন করা।
কর্মরত প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন ভাতা অন্যান্য সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে বিশাল বৈষম্য আজও বিদ্যমান। একই শিক্ষাগত যোগ্যতা ও সমকাজে প্রাথমিকের শিক্ষকেরা পাচ্ছেন ১৩তম গ্রেড আর পিটিআই পরীক্ষণ বিদ্যালয়সহ সরকারি দপ্তরে পাচ্ছেন দশম গ্রেড। প্রধান শিক্ষকদের মহামান্য আপিল বিভাগের রায়ের পরেও দেয়া হচ্ছে ১১ গ্রেড।
দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন বৃদ্ধির তুলনায় প্রাথমিকের শিক্ষকেরা সকল সরকারি কর্মচারীদের তুলনায় অনেক বেশি কষ্টে আছেন। সরকারে নিম্ন বেতনভুক্ত কর্মচারীরা ঋণগ্রস্ত হলেও সর্বাধিক ঋণগ্রস্ত প্রাথমিকের অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মরত শিক্ষকেরা। বৈষম্য ও যৌক্তিক দাবি নিরসন করে ঋণ জর্জরিত প্রাথমিকের কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের রেহাই দেয়া যায়। এ সময় বৈষম্য নিরসনসহ যৌক্তিক সমস্যা নিরসনে প্রত্যাশা রইল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রাথমিকের উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার সমীপে। ঋণের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হোক প্রাথমিকের অবসরপ্রাপ্ত, কর্মরত শিক্ষকসহ সকল কর্মযচারীরা।
লেখক: শিক্ষাবিদ