শিক্ষা উপদেষ্টা দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের প্রতি ছয়টি পরামর্শ দিয়েছেন। আমরা দেখতে পাচ্ছি, দেশের প্রায় সব এলাকায় এবং উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অস্থির অবস্থা বিরাজ করছে। শিক্ষার্থীদের হাতে এখনো বই-পুস্তক ও কলমের পরিবর্তে লাঠি-সোঁটা, আগ্নেয়াস্ত্র। শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে নেই, তারা রাস্তায়, মার্কেটে, বাসস্ট্যান্ড আর ট্রেন স্টেশনে। তাদেরকে ক্লাসমুখী করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে রাষ্ট্রের তরফ থেকে কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেনো যেনো কোনো কথাই কানে তুলছেন না।
এই অবস্থা বিবেচনায় শিক্ষা উপদেষ্টা ভিসিদের কয়েকটি পরামর্শ ও নির্দেশনা দিয়েছেন যাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করে।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হামলাসহ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো ভীতিপ্রদ বাস্তবতাকে স্পষ্ট করে তুলছে যা, শিক্ষার্থীদের মানসিকতার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে, পড়ালেখা বিমুখ হয়ে পড়ছেন শিক্ষার্থীরা, ভুলে যাচ্ছে তাদের মূল কাজের কথা। কোনো সমস্যায় পড়লে কর্তৃপক্ষের দ্বারস্থ না হয়ে নিজেরাই প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করছেন, ধ্বসাংত্মক হয়ে পড়ছেন, রক্তারক্তির ঘটনা ঘটাচ্ছেন।
যৌক্তিক হোক আর অযৌক্তিক হোক কাউকে জিম্মি করে তাদের দাবি আদায় করার চেষ্টাই যেনো তাদের শিক্ষা। ‘মব জাস্টিসের’ মতো মারাত্মক অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে চলেছেন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এ অরাজক পরিস্থিতি পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। শিক্ষার্থীরা অসহিষ্ণু হয়ে এসব করছেন কি এবং কেনো করছেন? সেসব উত্তর আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
এ ধরনের অরাজক পরিস্থিতি শুধুমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের দ্বারা প্রশমিত করা সম্ভব নয়, রাষ্ট্রীয় নির্দেশনা ও আনুকুল্য প্রয়োজন। আর এ কারণেই শিক্ষা উপদেষ্টা এ ধরনের পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ সুষ্ঠু রাখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য। আমরাও তাই মনে করি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যখন উদ্যোগ গ্রহণ করবে, সমাজ ও রাষ্ট্র তাদের পক্ষে অবস্থান নেবে। অন্তত দেশে বর্তমানে যে সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করছে তারা বিষয়টিতে পজিটিভলি সাড়া দেবে। তারই প্রকাশ ঘটেছে শিক্ষা উপদেষ্টার পরামর্শ প্রদানের মধ্য দিয়ে।
তিনি নিয়মিত কর্মশালা, সেমিনার ও আলোচনার আয়োজন করতে বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে। এ ছাড়া এক্সট্রা ও কো-কারিকুলার কার্যাবলি যেমন বিতর্ক প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খেলাধুলা ইত্যাদি পরিচালনার জন্য প্রশাসনকে বলেছেন। এ ধরনের কার্যাবলির নিয়মিত চর্চা শিক্ষার্থীদের মূল শিক্ষাকে যেমন সাহায্য করে তেমনি তাদের শরীর, মন ও মানসিকতার ওপর অনেক পজিটিভ ইফেক্ট ফেলে। এগুলোর চর্চা বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই বললেই চলে। এসবের স্থান দখল করেছে লাঠিসোঁটা, মারামারি, অসহিষ্ণুতা আর চর দখলের মতো হিংসাত্মক ও ধ্বংসাত্মক কাজ।
ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন করার পরামর্শ দিয়েছেন উপদেষ্টা। এ বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েকবার বাংলা ও ইংরেজি দৈনিকে লিখেছিলাম যে, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আমাদের বিরাট সম্পদ। এগুলো রক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণ অত্যন্ত কার্যকরীভাবে করতে হবে। তাহলে আমাদের চারপাশের প্রতিবেশি দেশ থেকেও শিক্ষার্থীরা পড়াশুনার জন্য এখানে আসবে যা আমাদের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবে আর দেশের সুনামও চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। আর তাই প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে বিশেষ এক ধরনের থানা ও বাহিনী সৃষ্টি করার কথা বেশ কয়েকবার লিখেছি। এই বাহিনীর নাম হবে, ‘ক্যাম্পাস পুলিশ’ যারা সাধারণ পুলিশের মতো হবে না। এখানকার সকল সদস্য কমপক্ষে অনার্সসহ মাস্টার্স পাস হবে।
বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত হবে এ বাহিনীর সদস্যরা যাতে তারা শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় পরিস্থিতি সফলভাবে ‘ডিল’ করতে পারে। তারা শুধুমাত্র কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে, সাধারণ পুলিশের ভূমিকায় থাকবে না। এরসঙ্গে ‘ইন্ডাসট্রিয়াল পুলিশ’ গঠনের কথাও লিখেছিলাম। সেটি দেখলাম হয়েছে কিন্তু ‘ক্যাম্পাস পুলিশের বিষয়টি রাজনৈতিক সরকার শিকেয় তুলে রেখেছে।
অনেক তথাকথিত শিক্ষার্থী ও ছাত্র সংগঠনগুলো এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। তারা এটি চিন্তা করে না যে, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে অহরহ পুলিশ মোতায়েন রাখতে হবে যাদের বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চশিক্ষা সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। তারা শুধু লাঠিপেটা ছাড়া আর কোনো দায়িত্ব পালন করতে পারে না। অথচ বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যে হারে ধ্বংসাত্মক কার্যাবলি চলছে তা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত বাহিনী প্রয়োজন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তার নিদের্শে এবং বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অতিরিক্ত আইজিপির সমমর্যাদার একজন পুলিশ অফিসার থাকবেন, ছোট বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোতে সিনিয়র এসপি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা থাকবেন। কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যায়ে এ ধরনের একটি ইউনিট থাকতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকারের একটি রূপরেখা তৈরি করে পরবর্তী সরকারের জন্য রেখে যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আমাদের রক্ষা করতেই হবে।
বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া এবং যখনই কোনো সহিংস ঘটনার সূত্রপাত হবে ঘটবে সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে অবহিত করে দ্রততম পদক্ষেপ নেয়ার জন্য তাদেরকে তৈরি থাকার জন্য নিয়মিত তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কথা বলা হয়েছে। বিষয়গুলো নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিভিন্ন কমিটিতে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
উপদেষ্টা যেকোনো মূল্যে শিক্ষা কার্যক্রমকে সচল রাখার পরামর্শ দেন। এ প্রসঙ্গে আমার একটি কথা মনে পড়ে। দিন দুয়েক আগে প্রফেসর হারুন আর রশিদ, বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। তখন এরশাদ সরকারের আমল। সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল। স্যার তখন বিভগীয় চেয়ারম্যান। তিনি বলতেন কোনোভাবেই ক্লাস বন্ধ রাখা যাবে না, কোনো পরীক্ষা পেছানো যাবে না। একদিকে লাশ পড়ে থাকতে পারে কিন্তু তোমাদের ক্লাস করতে হবে এবং সময়মতো পরীক্ষা দিতে হবে। আসলেই এসব বিষয়ে শিক্ষকসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সব স্তরের প্রশাসন শক্ত হলে সহিংসতা অনেকটা এড়ানো সম্ভব।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে নিয়মিত প্রতিবেদন তৈরি এবং তা প্রয়োজনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসিতে পাঠানোর পরামর্শ দেন, এবং যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে সেগুলো অগ্রগতির নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করারও পরামর্শ দেন উপদেষ্টা। উপরোক্ত পদক্ষেপগুলো ছাড়াও ভিসিসহ বিভাগীয় চেয়ারম্যান, ডিন, সিন্ডিকেটের সদস্যরা পরিস্থিতি সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আরো কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। তা না হলে বিশ্ববিদ্যালসহ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বাঁচানো যাবে না। এগুলো সব লাঠিয়াল বাহিনীর ‘ডেনে’ পরিণত হবে। তখন সকলের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। কাজেই এখনই পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ করছি।
লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক