হাই-ব্রিড শাব্দিক অর্থ উচ্চবংশে পালিত বা শিক্ষিত। ‘হাই-ব্রিডাইজেশন বা সংকরায়ন প্রকৃতির স্বাভাবিক ঘটনা। সাধারণত পরাগায়নের মাধ্যমে দুইটি জাতের মধ্যে বিনিময় হওয়াকে বোঝায়। বাস্তবিক অর্থে এক দলের নেতা ও অন্য দলের নেতার গোপন যোগাযোগ অথবা মিলনের ফলে যে সব নতুন জাতের নেতা পাওয়া যায়, তার মধ্যে কোনো কোনো নেতা তার দলের আদর্শ ভেতরে লালন করে, বাইরে অন্য দলের গুণাবলি প্রকাশে ব্যস্ত থাকেন।
এ ধরনের নেতাকে হাইব্রিড নেতা বলা হয়।
তবে হাইব্রিড বলতেই যে উন্নতমানের নেতা হবে তা নয়। হাইব্রিড নেতার মাধ্যমে সাময়িক অধিক ফলন পাওয়া গেলেও তা থেকে পরবর্তী সময়ে সংগঠনের জন্য কোনো ত্যাগ আশা করা যায় না। খুবই নীরবে নিভৃতে এ ধরনের নতুন হাইব্রিড নেতাদের বিচরণ হয় আবার মেয়াদান্তে ঝরে যায়।
হাই-ব্রিডিয়ানদের কাজের চেয়ে চাপার জোর বেশি। অনেকে কাজ করতে করতে জীবন ক্ষয় করেও বসের প্রশংসা কুড়াতে পারেন না। আর কেউ কেউ কাজ না করেও চাপার জোরে বসের বাহবা কুড়ানো নিয়ে ব্যস্ত। তেলের কাছে যেমন মেধাবীরা অসহায়, তেমনি হাই-ব্রিডিয়ান নেতৃত্বের কাছে শিক্ষকদের ন্যায্য দাবিগুলোও অসার।
রাজনৈতিক অর্থায়নে কিছু শিক্ষক নেতাদের হাইব্রিডের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। বর্তমান সময়ে প্রাথমিক শিক্ষায় হাইব্রিড নেতৃত্বের বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে। ৬৯-এর গণ-আন্দোলনের পর পরই সারা দেশে ৬ দফা আন্দোলনের ডামাডোল বেজে ওঠে। দেশ দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকে স্বাধিকার আন্দোলনের পথে। সে আন্দোলনে সব পেশাজীবীর অংশগ্রহণ থাকলেও প্রাথমিক শিক্ষক সমাজের অবস্থান চোখে পড়ার মতো ছিলো না।
প্রাথমিক শিক্ষক সমিতিকে ৬ দফা তথা স্বাধিকার আন্দোলনে যুক্ত করার লক্ষ্যে এগিয়ে এলেন এক ঝাঁক তরুণ। তাদের নেতৃত্বে গড়ে তোলা হয় পূর্ব পাকিস্তান প্রাথমিক শিক্ষক সংগ্রাম পরিষদ। নেতৃত্ব দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক আবুল কালাম আযাদসহ মানিকগঞ্জের আশরাফউদ্দিন, আ কা ফজলুল হক, আলতাফ হোসেন দাদুসহ অসংখ্য তরুণ প্রাথমিক শিক্ষক নেতা। তাদের নেতৃত্বে মোনায়েম খানের গভর্নর হাউস ঘেরাও করে আদায় করা হয় সর্বপ্রথম প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন স্কেল।
সেই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন সরকারের আমলে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি শিক্ষকদের ন্যায্য দাবিগুলো নির্বাচনে ও বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছিলো। কিন্তু ডিজিটাল যুগের শুরু থেকেই বিশেষ করে ফেসবুক এবং হাই-ব্রিডাইজেশন ফলে শিক্ষক সমাজ বিভক্ত। শিক্ষক সংগটনের নামে অভিন্ন ও ভিন্ন ভিন্ন দাবিতে হাইব্রিড নেতৃত্বের আন্দোলন মাঠে আছে।
সর্বশেষ সহকারী শিক্ষকদের দশম গ্রেডের দাবিটি ‘বাস্তবসম্মত না’ বলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা জানিয়ে দিয়েছেন। শিক্ষক নেতাদের প্রতি সম্মান রেখেই বলতে চাই শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি সরকার বাস্তবায়ন করবে এটাই স্বাভাবিক হয়ত এখন নয়তো সময় সাপেক্ষে। তবে ‘বাস্তবসম্মত না’ বলার ফলে অন্যসব দাবিগুলো হালকা করে ফেললো না তো? সেইসঙ্গে দাবিনামা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করলে হয়তো শিক্ষক সমাজ অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দচয়ন থেকে পরিত্রাণ পেতো।
দশম গ্রেডকে শুধুই বেতন স্কেলের ফ্রেমে দেখলে ঠিক হবে না।
এ দাবি শিক্ষকদের মর্যাদার থার্ড ক্লাস থেকে সেকেন্ড ক্লাস পরবর্তীতে ফার্স্ট ক্লাস। সহকারী শিক্ষকদের ভাবনা এ দাবি তাদের। অপরদিকে, প্রধান শিক্ষকদের ভাবনা এ দাবি সহকারীদের। আসলে এ দাবি শিক্ষক সমাজের মর্যাদার দাবি। এ হীন পরিস্থিতি প্রধান ও সহকারীদের বিশেষ করে হাই-ব্রিডিয়ানদের হীন মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। সময় এসেছে ঐক্যের, অন্যথায় আরো খারাপ অবস্থা প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকদের সামনে অবস্থান করছে। তবে বনের বড় গাছগুলো ছায়া দিয়ে আলো দিয়ে ছোট গাছগুলোকে না টিকিয়ে রাখলে ঐক্য সমৃদ্ধ ও ফলপ্রসূ হবে না।
লেখক: শিক্ষক