শিক্ষা বিষয়ক দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল পত্রিকা দৈনিক শিক্ষাডটকমে গত শনিবার প্রকাশিত একটি খবরের দিকে পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করছি। খবরটির শিরোনাম ‘ঘুষ নিতে মিনিস্ট্রি অডিটরদের স্বামী, এমপিও শিক্ষকরা আতঙ্কে’। তাতে বলা হয়েছে, ‘এখানে এক বছর চাকরি করে কেউ যদি ঢাকায় ফ্ল্যাট ও কোটি টাকার ব্যাংক ব্যালান্স করতে না পারে তাহলে তো সে কোনো উপযুক্ত শিক্ষা ক্যাডারই না! এমনটাই চাউর রয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের শিক্ষা পরিদর্শক ও সহকারি শিক্ষা পরিদর্শক হিসেবে পদায়ন পাওয়া বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্যে। এমন ‘ঐতিহ্য’ ধরে রাখতে ডিআইএর একজন পরিদর্শক উপরির টাকা গুণতে বেকার স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে গেছেন। আরেকজন গেছেন শাশুড়িকে নিয়ে। আরেক নারী কর্মকর্তা তার ভুয়া সাংবাদিক স্বামীর দাপট দেখিয়ে গত পাঁচ বছর ঢাকার বাইরের এক সরকারি কলেজের সবাইকে তটস্থ রেখে ৫ আগস্টের পর নতুন পরিচয়ে ডিআইএতে বদলি হয়ে এসেছেন। আবার কোথাও একসঙ্গে তদন্তে যাওয়া দুই নারী কর্মকর্তা ঢাকায় ফিরে ঘুষের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে অস্থির করেছেন শিক্ষা ভবনের অফিসের কক্ষ।’
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মচারী ও তাদেরকে দেখভাল করার জন্য, সঠিকপথে পরিচালানার জন্য শিক্ষা বিভাগের রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের জীবনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, জীবনধারা এবং জীবনদর্শন এই লাইনগুলোর মধ্যে পুরোপুরি ফুটে উঠেছে। শিক্ষার এই হাল কি প্রজন্ম তৈরি করছ আর করবে? শুধু শিক্ষকদের ভালো হওয়ার পরামর্শ দিলে সেটিই বা কাজ করবে কেনো?
এসব বিসিএস নামধারী কর্মকর্তাদের স্বামী-স্ত্রী, বন্ধু-বান্ধব বা ভুয়া সাংবাদিক যে যাই করুক না কেনো দৈনিক শিক্ষার জালে তাদের কোনো না কোনোভাবে পড়তেই হচ্ছে। কারণ, দৈনিক শিক্ষা ও দৈনিক আমাদের বার্তা অত্যন্ত পেশাদারিত্বের সঙ্গে এবং শিক্ষা উন্নয়নের মহান ব্রত নিয়ে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে।
প্রকাশিত খবরে আরো বলা হয়েছে, ‘গত তিন সপ্তাহে তদন্ত ও পরিদর্শন করা তিন জেলার ত্রিশটি প্রতিষ্ঠানের তিন শতাধিক শিক্ষক-কর্মচারী আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। ঘুষের টাকা দিয়েও তারা বিপদে। কারণ, ঢাকা থেকে টেলিফোন করে তাদেরকে বলা হচ্ছে, ঘুষের বিষয়ে দৈনিক শিক্ষাডটকম পত্রিকার প্রতিবেদন প্রকাশ হতে পারে। যদি প্রতিবেদন প্রকাশ হয় তাহলে অভিযোগের তদন্তেও পাঠানো হবে ডিআইএতে কর্মরত শিক্ষা ক্যাডারদেরই। ঘুষ দেয়া এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা শুধু তাদের অভিযুক্ত সহকর্মীদের বিষয়ে তদন্ত কমিটির কাছে বলবেন, তারা ঘুষ দেননি এবং কোনো সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেননি।’
এর মানে, দুর্নীতি ঢেকে দেয়ার পদ্ধতিও ভুক্তভোগীদের শিখিয়ে দিচ্ছে এসব অসাধু ও দেশবিরোধী তথাকথিত কর্মকর্তারা যা দৈনিক শিক্ষার জালে ধরা পড়ছে।
এভাবে বিভিন্ন ধরনের চাঞ্চল্যকর তথ্যাদির প্রমাণ মিলছে প্রতিদিন। প্রকাশিত খবরে আমরা জানলাম, ষোল বছর ধরে বেকার এক ব্যক্তিকে এক এলাকার শিক্ষকেরা আবিষ্কার করলেন এক নারী পরিদর্শকের সঙ্গে বিদ্যালয় পরিদর্শনে যেতে। শিক্ষকেরা তাকে চিনে ফেলায় হয়েছে বিপত্তি। পরে জানা গেলো তিনি সেখানে গিয়েছেন তার স্ত্রীর সঙ্গে কারণ টাকা পয়সা রাখার ব্যাগ দরকার, দরকষাকষিসহ নিরাপত্তা এবং বেশি ঘুষ চাইলে হেনস্তার শিকার নারী কর্মকতাদের যাতে রক্ষা করতে পারেন এসবই মূলত তাদের কাজ। এই হচ্ছে শিক্ষা বিভাগের অডিট!
আবার কিছু নারী কর্মকর্তা তাদের স্বামীদের কবি ও সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে নিজেদের অফিসসহ তাদের যেসব জায়গায় পদচারণা রয়েছে সর্বত্রই সবাইকে তটস্থ রাখেন এবং রাখতেন। মানুষ এখন সচেতন। শিক্ষকেরা সচেতন! কাজেই এসব সহজেই ধরা পড়ছে। প্রায়ই দেখা যাচ্ছে পরিদর্শনের কাজে গিয়ে হেনস্তা ও গণ ধোলাইয়ের শিকার হচ্ছেন অসাধু ও অর্থলোভী কর্মকর্তা- কর্মচারী ও তাদের স্বামী কিংবা স্ত্রী।
এ বিষয়ে আমি একটু আমার নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমি একটা শিক্ষা কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত ছিলাম। তার আওতায় কয়েকটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো। সেগুলোর অনুমোদন ও ইআইআইএন নম্বর দরকার ছিলো। আমি যেহেতু বিদ্যালয়গুলোর দায়িত্বে ছিলাম তাই একজন সহকর্মীকে নিয়ে মন্ত্রণালয়ে আমারই বিদ্যালয়ের সিনিয়র ভাই এবং নিকটতম প্রতিবেশী মেধাবী শিক্ষার্থী তখন অতিরিক্ত সচিবের কাছে যাই। তার সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর তিনি পাঠালেন ব্যানবেইসে। সেখানে গিয়ে দেখি মানুষের ঢল। তারা সবাই কোনো না কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান। সবাই অসহায়ের মতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা, সম্ভবত দিনের পর দিন বসে আছেন।
আমাদের যেহেতু অতিরিক্ত সচিব পাঠিয়েছেন, আর শিক্ষা নিয়ে লেখালেখি করি, সাহস নিয়ে সরাসারি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার রুমে ঢুকলাম। তিনি প্রথম আমাদের সঙ্গে আকডুম বাকডুম শুরু করলেন। এই কাগজে হবে না, এটি পুরনো, নতুন ফরম লাগবে ইত্যাদি ইত্যাদি। ইতোমধ্যে দেখলাম ওই রুমে আমাদের পেছনে এসে দাঁড়ালেন ব্যানবেইসের পরিচালক স্বয়ং (তখনো পদটি মহাপরিচালক পদে উন্নীত হয়নি)। তিনি ওই কর্মকর্তাকে কি যেনো ইশারা দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ওই কর্মকর্তা চেয়ার টেবিলে কাঁপিয়ে কাজ তো করে দিলেনই এবং বললেন, আপনারা আগে বলবেন না যে, মন্ত্রণালয়ের অমুক স্যার পাঠিয়েছেন।
বাইরের লোকজনের ভিড় নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা ছিলো না। এবং খেলা ওখানেই শেষ নয়। কারণ কু-স্বভাব তো দূর হয় না। ওই কর্মকর্তার বাড়ি সিরাজগঞ্জে। তিনি তার বাড়িতে গেছেন নিজের কাজে, বেড়াতে। আমাদের প্রধান শিক্ষককে জানালেন, তিনি বিদ্যালয়ে পরিদর্শনে যাবেন। হেডমাস্টার আমাকে জানালেন, অমুক স্যার ব্যানবেইস থেকে আগামীকাল দশটার দিকে আমাদের বিদ্যালয়ে আসবেন। তাকে কীভাবে আপ্যায়ন করবো, টাকা-পয়সা কতো দিতে হবে, কিছু বুঝতে পারছি না।
আমি প্রধান শিক্ষককে বললাম। উনি আসার পর সালাম দিয়ে বলবেন, এই বিদ্যালয়ের খোঁজখবর মন্ত্রণালয়ে অমুক স্যার এবং সচিব স্যার নিয়মিত রাখেন।
ওই কর্মকর্তা গিয়েছিলেন প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে কিছু আদায় করবেন, খাওয়া দাওয়া করবেন, তার কর্তৃত্ব দেখাবেন এসব আশায়। তো প্রধান শিক্ষককে শিখিয়ে দেয়া কথাগুলোই উনি ওই কর্মকর্তাকে বললেন। বলার সঙ্গে সঙ্গে এক মিনিটও দেরি না করে তার ব্যবহৃত মোটর সাইকেল ঘুরিয়ে বললেন, আমি হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। আমাকে এক্ষুণি চলে যেতে হবে। এক কাপ চা বা পানি কিছুই পান না করে সঙ্গে সঙ্গে সটকে পড়েছিলেন। আর জীবনে সেই বিদ্যালয়ে যাননি।
এসব থেকে মুক্তি পেতে শিক্ষা বিভাগের এসব পদে যাকে তাকে, কোনো প্রভাবশালীর আত্মীয়-স্বজনকে পদায়ন করার নিয়ম পুরোপুরি পাল্টাতে হবে। তাদের বিভিন্নভাবে সততার পরীক্ষা দিতে হবে। তা না হলে শিক্ষার ডুবন্ত তরী আর ভাসিয়ে রাখা যাবে না।
বর্তমান সরকার কোনো রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে কিংবা আদর্শে প্রভাবিত হয়ে কাজ করছে না। তাদের কাছে আমাদের অনুরোধ, আপনারা এসব জায়গাগুলো একটু পরিষ্কার, একটু নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসার কৌশল প্রয়োগ করুন, যা পরবর্তী সময়ে উদাহরণ হয়ে থাকবে। শিক্ষা বিভাগকে কলুষমুক্ত রাখতেই হবে, যদি জাতিকে সামনে এগিয়ে নিতে চাই।
লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক