পতিত আওয়ামী সরকারের আমলে জারি করা প্রজ্ঞাপন কাটাছেঁড়া করে এই শব্দের স্থলে ওই শব্দ, ওই শব্দের স্থলে সেই শব্দ হবে এভাবেই প্রজ্ঞাপন জারি করে চলছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ থেকে বোঝা যায়, আমলাদের আওয়ামী প্রীতি এখনো যায়নি। গত ৫ আগস্ট রক্তাক্ত অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারের পতন হলেও প্রশাসনে স্বৈরাচারের আশীর্বাদপুষ্ট আমলারা বহাল তবিয়তে আছেন। এতে ইউনূস সরকারের আদেশ পরিপালনে স্বৈরাচারের দোসর আমলাদের অনীহা এমনকি অমান্য করা নজিরও ঘটছে।
এক্ষেত্রে অন্য মন্ত্রণালয়ের তুলনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় অগ্রগামী। উপদেষ্টার আদেশ উপেক্ষা করে বিকল্প প্রজ্ঞাপন জারি হচ্ছে! একের পর এক বিতর্কিত ও বিভ্রান্তিমূলক প্রজ্ঞাপন জারি ও বাতিলের খেলায় মত্ত অসৎ আমলারা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমিটি গঠন বিষয়ে পতিত সরকারের প্রজ্ঞাপন কাটাছেঁড়া করে গত ১৮ নভেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করে। গত ২৪ নভেম্বর ১৮ নভেম্বরের জারি করা প্রজ্ঞাপনের সংশোধিত প্রজ্ঞাপন জারি করে। গত ২ ডিসেম্বর আবার ২৪ নভেম্বরের প্রজ্ঞাপন বাতিল করে ১৮ তারিখের প্রজ্ঞাপন বহাল রেখে প্রজ্ঞাপন জারি করে। [inside-ad]
দৈনিক শিক্ষাডটকম সূত্রে জানা যায়, আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে শিক্ষা উপদেষ্টা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কমিটি ভেঙে অ্যাডহক কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন। কিন্তু সম্পূর্ণ কমিটি ভেঙে না দিয়ে শুধু সভাপতি পরিবর্তন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় এবং সে মোতাবেক কমিটি গঠন করা হয়। এ ব্যাপারে চলতি বছরের ২১ আগস্ট শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, রাজনৈতিকভাবে তৈরি করা কমিটি থাকার কথা নয়। আমি বলেছিলাম, বেসরকারি স্কুল-কলেজের পুরো কমিটিকেই বাতিল করতে, কিন্তু কোনো কারণে বোধহয় শুধু সভাপতিকে বাতিল করা হয়েছে। আসলে পুরো কমিটিকেই বাতিল করার কথা। কারণ, এগুলো তো সবই রাজনৈতিকভাবে তৈরি করা কমিটি।
জনগণ জানতে চায়, যে বা যারা শিক্ষা উপদেষ্টার আদেশ ডিঙিয়ে তাদের আদেশ জারি করলো, তাদের ব্যাপারে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে? শিক্ষায় অংশীজনরা বলছেন, শিক্ষা উপদেষ্টার আদেশ উপেক্ষার দুঃসাহস দেখাচ্ছে তার নতজানু নীতির কারণে।
পতিত আওয়ামী সরকারের প্রজ্ঞাপন কাটাছেঁড়া না করে নতুনভাবে প্রজ্ঞাপন জারি করতে আমলাদের এতো অনীহা কেনো? রক্তের বিনিময়ে স্বৈরাচারের পতন হলেও স্বৈরাচারের দোসররা এখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমিটির সদস্য হিসেবে বহাল তবিয়তে আছ। এ ছাড়া আওয়ামী সরকার ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমিটির সভাপতির যোগ্যতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জন্য স্নাতক এবং কলেজের জন্য স্নাতকোত্তর নির্ধারণ করে নীতিমালা করে। অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় সেই নীতিমালা বহাল রেখে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।
এতে মফস্বল এলাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সভাপতি পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ছে। দেশের শিক্ষার সার্বিক অবস্থায় মাধ্যমিক স্তরে সভাপতির যোগ্যতা এইচএসসি ও কলেজ পর্যায়ে সভাপতির যোগ্যতা স্নাতক পাস বিবেচনা করা যেতে পারে।
এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সর্বজনীন বদলির নীতিমালা করা হবে বলে শিক্ষা উপদেষ্টা শিক্ষকদের আশ্বস্ত করেছিলেন। শিক্ষকেরা উপদেষ্টা কথায় আশ্বস্ত হয়ে সর্বজনীন বদলির অপেক্ষায় আছেন। কিন্তু হঠাৎ করে আবার পারস্পরিক বদলির প্রজ্ঞাপন জারি করে শিক্ষকদের সংক্ষুব্ধ করা হচ্ছে কেনো? এছাড়া দৈনিক শিক্ষাডটকম সূত্রে জানা যায়, দুর্নীতিবাজরাই মিনিস্ট্রি অডিটর হয়েছে।
অডিট করার জন্য তারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। ইতোমধ্যে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান অডিট করতে গিয়ে ঘুষ নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়েছেন। কোথাও কোথাও অডিটরদের গরুর দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখার ঘোষণা দিয়েছে শিক্ষকেরা। যেখানে আগামী বছরের জন্য কারিকুলাম, পাঠ্য বই ছাপানো, নতুন শিক্ষক নিয়োগসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হিমশিম খাচ্ছে সেখানে অডিট নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হওয়ার হেতু কী?
স্বৈরাচারের পতনের ফলে দুর্নীতিবাজ আমলাদের পুকুর চুরির পথ বন্ধ হওয়ায় তারা মনোক্ষুণ্ণ। এ জন্য শিক্ষাব্যবস্থা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় এমন কাজই তারা করে যাচ্ছে।
অসৎ, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শাস্তির আওতায় না আনলে সৎ ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হতাশ হয়ে কাজ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। শিক্ষা উপদেষ্টা দুর্নীতিবাজ ও পতিত আওয়ামী সরকারের দোসর আমলাদের চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হলে শিক্ষাব্যবস্থায় বড় বিপর্যয় ঘটবে। যা সরকারের জন্য বিব্রত পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শিক্ষা উপদেষ্টা যেসব বিষয় বিবেচনা করতে পারেন-১. মন্ত্রণালয়ের স্পর্শকাতর জায়গা থেকে আওয়ামী দোসরদের সরিয়ে দেয়া।২. ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের পাঠ্য বইয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও ২৪ এর গণ-অভ্যুত্থান সংযোজনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সর্তকতা অবলম্বন করা। ৩. কোনো বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারির আগে আপনার নোট পাওয়া নিশ্চিত করা। ৪. মিনিস্ট্রি অডিট কার্যক্রম আপাতত স্থগিত রাখা। এ ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সৎ ও ন্যায়পরায়ণ শিক্ষকদের তালিকা করে ডিআইএ পদায়নের ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। ৫. এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাড়িভাড়া, উৎসব ভাতা ও সর্বজনীন বদলির ব্যবস্থা করা।
লেখক: সহকারী প্রধান শিক্ষক, দনারাম উচ্চ বিদ্যালয়
(মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন)