চলমান কারিকুলামে বিতর্কিত পাঠ্যক্রমে ত্রুটি-বিচ্যুতি যাই থাকুক না কেনো, ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম গ্রেডের বার্ষিক সামষ্টিক মূল্যায়নে সংশোধিত পাঠ্যক্রম ও বিষয়ভিত্তিক নমুনা মূল্যায়ন পত্রের সৌজন্যে চলমান বার্ষিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার মহাযজ্ঞ সফলভাবেই এগিয়ে চলছে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মাঝে শিখন-শেখানো পরবর্তী ধাপ মূল্যায়ন প্রক্রিয়া অর্থাৎ বার্ষিক পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের মাঝে উৎসাহ-উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে শিক্ষক শিক্ষার্থী অভিভাবকদের মাঝে। গত ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়ন ব্যবস্থাপনায় যে সন্দেহ, যে বিতর্ক সমালোচনা ছিলো তা এখন প্রায় নাই বললেই চলে। বেশ আনন্দের ব্যাপার ইংরেজি বিষয়ে প্রতিটি গ্রেডের সংশোধিত পাঠ্যক্রম অনুযায়ী নমুনা প্রশ্নপত্রের যে ধারা সংযোজিত হয়েছে তা শিক্ষার্থী শিক্ষক অভিভাবকদের কাছে বহুল প্রশংসিত। নতুন কারিকুলাম প্রয়োগের সবচেয়ে বড় যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনুসন্ধানী ও গবেষণামূলক মনোভাব জাগিয়ে তোলা এবং সঠিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত সাড়া পাওয়া।
চলমান বার্ষিক সামষ্টিক মূল্যায়নে বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষার প্রশ্নের যে ধারা সংযোজন বিয়োজনের মাধ্যমে সংশোধিত পাঠ্যক্রমে নতুনভাবে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র রচিত হয়েছে এবং প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিজস্ব নামে তা বাস্তবায়ন করছে তাও প্রশংসনীয়। তবে মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় যতোই পরিবর্তন ঘটুক না কেনো এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যতো সৌহার্দপূর্ণ ও আন্তরিক হবে এর সুফল ততোই আরো বেশি হবে। এটা ইতোমধ্যে নিবেদিত শিক্ষকেরা নির্ভুলভাবে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন ও করে যাচ্ছেন।
কিন্তু শিক্ষক শিক্ষার্থী অভিভাবকদের মধ্যে মূল্যায়ন সংক্রান্ত আগের যে ভীতি সন্দেহ তা খোদ কারিকুলাম সিন্ডিকেটের আড়ালে থাকা বিশেষজ্ঞরা গত ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নে কাটাতে পারেননি। সংশোধিত পাঠ্যক্রমের আলোকে বার্ষিক পরীক্ষা মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় দেশপ্রেমিক কিছু বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষকের সহযোগিতায় সাম্প্রতিক নির্দেশিত বার্ষিক মূল্যায়ন নির্দেশিকা অনুযায়ী মূল্যায়ন কার্যাবলি শেষ করার চেষ্টা করে চলেছেন। এই মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় ত্রুটি-বিচ্যুতি যাই থাক না কেনো শিক্ষকেরা তাদের দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থেকে বিতর্কিত আগের ওই মূল্যায়ন প্রক্রিয়া সমালোচনার বস্তু হিসেবে যা ভেসে বেড়াচ্ছিল তা থেকে একটু স্বস্তি পেয়েছেন।
তবে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়াও এখন প্রতিফলিত। আর তা হচ্ছে গাইড আর নোটবইয়ের ব্যাপক ছড়াছড়ি যা শিক্ষার্থীদের ক্লাসমুখী বা পাঠদানে মনোযোগ থেকে বিরত হওয়ার আশঙ্কা অনেকাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে। এ বছর শিক্ষার্থীদের ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে সর্বোচ্চ মহল থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায় সবাই একটা লুকোচুরি খেলার মধ্যে ছিলো যা বার্ষিক পরীক্ষার আগে প্রকাশিত শিক্ষার্থীদের বার্ষিক সামষ্টিক মূল্যায়ন পাঠ্যক্রম ও সময়সূচি বের হওয়ার ফলে অনেকাংশে কেটে গেছে। আবার ধারাবাহিক ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নে ডাটা এন্ট্টি প্রক্রিয়ায় তখন শিক্ষা কারিকুলামে সংশ্লিষ্ট দপ্তর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।
তা ছাড়া শিক্ষার সঙ্গে জড়িত কর্তাব্যক্তিদের তৎকালীন একঘেয়েমি কথাবার্তা মন্তব্য ও লুকোচুরি খেলার প্রভাব এসে পড়েছে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অভিভাবকদের ওপর, যা মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে সফল কারিকুলাম বাস্তবায়নের পথে অন্তরায় ছিলো। হয়তো আগামী বছরে দেশপ্রেমিক দক্ষ বিশেষজ্ঞের সহায়তায় পাঠ্যক্রম পরিকল্পনায় দূর হতে পারে। এক্ষেত্রে গত বছরের শেষে দেশের সব শিক্ষক এবং এ বছরের শুরুতে সব প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ শেষ হয়েছিলো ঠিকই কিন্তু মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় কারো স্বচ্ছ ধারণা তখনো ছিলো না। বরং অতিউৎসাহী ও প্রথম থেকেই কারিকুলাম বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করা সমালোচকরা মূল্যায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে শিক্ষার্থী অভিভাবকদের মাঝে বিরূপ ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াতে সবসময়ই সক্রিয়। আর এ সুযোগটা তারা আরো বেশি পায় যখন কারিকুলাম সিন্ডিকেটভিত্তিক বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে সময়ের ব্যবধানে ভিন্ন ভিন্ন মন্তব্য প্রদান প্রায় চোখে পড়তো। তবে বাস্তব ও বিজ্ঞানসম্মত অনুসন্ধানী গবেষণামূলক নতুন কারিকুলামে মূল্যায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে যতোটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব, ভয়ভীতি ও সন্দেহ বিরাজমান আসলে তা ঠিক নয় বরং এনসিটিবির প্রতিটি পাঠ্যবই যদি শিক্ষকেরা প্রশিক্ষণের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে শিখন-শেখানোর কাজে শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করতে পারেন তবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে শিক্ষার্থীদের মাঝে ধারাবাহিক বার্ষিক সামষ্টিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার মোটামুটি একটা স্বচ্ছ ধারণা পেতে পারা খুব একটা কষ্টসাধ্য নয়।
এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, এক্ষেত্রে শিক্ষকদের আন্তরিকতাই প্রধান নিয়ামক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যেহেতু শিক্ষকেরা গত বছর ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির মূল্যায়ন প্রক্রিয়া যেকোনোভাবেই হোক সম্পন্ন করার চেষ্টা করেছিলেন। নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে এনসিটিবির প্রতিটি বিষয়ের পাঠ্যবইয়ের প্রতিটি অভিজ্ঞতা ও এক্টিভিটি অত্যন্ত সহজ ও সাবলীলভাবে সন্নিবেশিত করা হয়েছে, যা একটু মনোযোগ ও আন্তরিকতার সঙ্গে অনুধাবন করতে পারলেই শিক্ষক- শিক্ষার্থী-অভিভাবক কারো মধ্যে মূল্যায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব তা অবশ্যই কেটে যাবে।
সম্প্রতি মাউশি অধিদপ্তরের বার্ষিক সামষ্টিক মূল্যায়নে প্রতি গ্রেডের প্রতি বিষয়ের প্রশ্নপত্রের যে নমুনা শিক্ষকেরা পেয়েছেন তা ভালোভাবে সবাই যদি গুরুত্বসহকারে অনুধাবন করতে পারতো এবং শিক্ষার্থীদের সম্যক ধারণা দিতে চেষ্টা করতো তবে বাজারে পাওয়া গাইড বইয়ের প্রতি শিক্ষার্থীদের এতো ঝোঁক থাকার কথা নয়। অবশ্য কতিপয় শিক্ষকেরও বাজারে পাওয়া এহেন গাইড আর নোটবইয়ের ওপরও যে নির্ভরতা কম নয় তা না বোঝার লোক কমই আছে। আবার এক শ্রেণির লোক আছে সবসময়ই মূল্যায়নের নেতিবাচক দিক তুলে ধরার চেষ্টা করছেন বা করে যাচ্ছেন। তবে আমরা যারা শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত, সমালোচকদের সমালোচনার দিকে কান না দিয়ে সব ধরনের নেতিবাচক দিকগুলোকে উপেক্ষা করে ধারাবাহিক বার্ষিক মূল্যায়নে কারিকুলাম প্রদত্ত নির্দেশিকার আলোকে সংশোধিত পাঠ্যক্রমের আলোকে ও নিজের প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কোমল ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের অত্যন্ত আনন্দ উৎসাহ ও উদ্দীপনা দিয়ে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে অবদান রাখতে কখনো নিজের মনকে দুর্বল না করে এগিয়ে চলি। শিক্ষার সফল বাস্তবায়নে আর জাতির মেরুদণ্ড সোজা করতে নিজেকে নিয়োজিত রাখি সর্বদা।
লেখক: সিনিয়র শিক্ষক
(মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়)