নিবন্ধটি লিখতে গিয়ে শিরোনামের সঙ্গে সম্পর্কিত একটা প্রবাদের কথা মনে জাগ্রত হলো। প্রবাদটি হলো ‘ভাইয়ের ভাই না হয়ে যদি ভাবির ভাই হতাম তবে কাজটি সহজে হতো’। প্রাথমিকের শিক্ষকদের দীর্ঘ সময়ের বৈষম্য আর বঞ্চনা থার্ড ক্লাস থেকে সেকেন্ড ক্লাসে পৌঁছানোর চ্যালেঞ্জ নিয়ে প্রবাদটির অবতারণা। শিক্ষকেদের ধীরে ধীরে উন্নত বিশ্বের মতো প্রথম শ্রেণির মর্যাদা উন্নীত হতে হবে। প্রায় সব সরকারি দপ্তরসহ পিটিআই পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের সমযোগ্যতা, সমকাজের ১০ম গ্রেড তথা সেকেন্ড ক্লাস মর্যাদা দেয়া হচ্ছে। অথচ সব শিক্ষিত নাগরিক গড়ার কারিগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের দেয়া হচ্ছে ১৩তম গ্রেড ও থার্ড ক্লাস মর্যাদা। স্বাধীনতার এই দীর্ঘ সময় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা তথা শিক্ষক সমাজ চরম বৈষম্যের জাঁতাকলে পৃষ্ঠ।
২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের মার্চের পূর্বে সব প্রাথমিক শিক্ষক থার্ড ক্লাস মর্যদা পেয়ে আসছিলেন। ওই সময় থেকে এক প্রজ্ঞাপনে প্রধান শিক্ষকদের সেকেন্ড ক্লাস মর্যদা দিলেও বেতন দেয়া হয় ১১তম গ্রেডে। সব সরকারি প্রতিষ্ঠান ও পিটিআই পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সেকেন্ড ক্লাস মর্যদা পেয়ে ১০ম গ্রেড পেলেও প্রাথমিক প্রধান শিক্ষকদের মর্যদার বিষয়টি ছিলো শুভঙ্করের ফাঁকি। প্রধান শিক্ষকেরা নিজেরা আলাদা সংগঠন করে আন্দোলন, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ের পরেও দীর্ঘ সময় ধরে ঝুলে আছেন। তাদের আইনগত অধিকারের মাঝে পার হয়ে গেলো বছরের পর বছর, বিদায় নিলো বহু মন্ত্রী, সচিবসহ সরকার। গিট্টু লাগানোর জন্য রইলো শুধু মন্ত্রণালয় ও সাবেক সরকারের সচিব।
দেশ ও জনগণের উন্নয়নে শিক্ষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ক্ষমতা হারিয়ে বা ক্ষমতা প্রাপ্তির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলো শিক্ষার গুরুত্ব বা শিক্ষকদের চাওয়া পাওয়ার সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। ক্ষমতায় যেয়ে তারা প্রায় সকলে ভালোবাসায় গভীরে চলে যায়, দলীয় নেতা-কর্মীর মাঝে। তখন বিশেষ করে সরকারের মন্ত্রীরা চলে আমলাদের নিয়ন্ত্রণে। অনেকটা যৌথ বোঝাপড়ার মাধ্যমে চলতে থাকে স্বীয় স্বার্থসিদ্ধি। ইদানিং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের বক্তব্য মিডিয়ায় দেখে মনের মাঝে ভাবনার উদয় হলো। তিনি বলেছেন, বিগত সরকারের আমলে যারা পদোন্নতি বঞ্চিত তাদের এ গ্রেড দেয়া হবে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানাই। তবে প্রত্যাশা রইলো এ দৃষ্টিভঙ্গি সারা দেশের শিক্ষক-কর্মচারীদের ক্ষেত্রেও যেনো কার্যকর হয়। উন্নত বিশ্বে শিক্ষক সমাজের মর্যাদা প্রথম শ্রেণির। স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় অতিক্রম হলেও বাংলাদেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হয়নি। তবে সব সরকারের আমলে কম-বেশি উন্নতি হয়েছে। আমাদের সময়ে গ্র্যাজুয়েট শিক্ষকের সংখ্যা ছিলো অতি নগণ্য। বর্তমানে অনার্স মার্স্টাসে বিদ্যালয়েগুলো কানায় কানায় পরিপূর্ণ। নানা ছলচাতুরি করে প্রাথমিক শিক্ষকদের যোগ্যতার দোহাই দিয়ে থার্ড ক্লাস মর্যাদা ও বেতন স্কেল দেয়া হয়েছিলো।
উচ্চশিক্ষিত মেধাবীরা যখন প্রাথমিকের শিক্ষকতায় আসলেন, তখন তাদের বেতন গ্রেড মর্যাদা সমযোগ্যতাসম্পন্ন সব কর্মচারীদের সমান হওয়া বাঞ্ছনীয়। বাস্তবতা হলো শিশুরা ভাঙচুর, অবরোধ বা যেকোনো আন্দোলন করতে পারে না। তাই তারা অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। শিক্ষক সংকটসহ নানা চ্যালেঞ্জের বেড়াজালে প্রাথমিক শিক্ষা জর্জরিত। একটা প্রবাদ আছে ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’। প্রাথমিকের সমস্যার মূলে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে প্রাথমিক শিক্ষায় অভিজ্ঞ কর্মকর্তা না থাকায় হ য ব র ল অবস্থায় চলছে শিশুশিক্ষা ব্যবস্থা।
অর্থকষ্টে দিন পার করেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক থেকে সব শিক্ষকেরা। সবচেয়ে করুণ অবস্থা প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের। শিক্ষকতা পেশা বেছে নিলেও অর্থসংকটে তারা। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার মুখে শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোর কথা বললেও তা কাজে বাস্তবায়ন করেনি। শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় জনবল ধরে রাখতে দ্রুত বেতন-ভাতা ও সুবিধা বাড়ানো উচিত। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এমন তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে ‘পেশা হিসেবে শিক্ষকতার অগ্রগতি’ শিরোনামে শিক্ষকদের বেতন-ভাতার করুণ অবস্থা তুলে ধরা হয়।
গত ১ ডিসেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এ প্রতিবেদন জমা দেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির সদস্যরা।
অর্থনৈতিক শ্বেতপত্রের প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। এ আইনটি কার্যকর হওয়ার পর সরকার শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতের দায়িত্ব নয়। প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষকদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অথচ জাতীয় বেতন কাঠামোতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা খুব নিচের স্তরে অবস্থান করছেন।
বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ১৩তম গ্রেডে বেতন-ভাতা পান। তাদের মূল বেতন ১১ হাজার টাকা। এর সঙ্গে তারা অবস্থানভেদে বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা মিলিয়ে সর্বমোট ১৯ হাজার টাকা পেয়ে থাকেন।
গবেষণা বলছে, বর্তমানে রাজধানী ঢাকায় চার সদস্যের একটি পরিবারের শুধু খাবারের খরচই ২২ হাজার ৬৬৪ টাকা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গড় বেতন ১৭০ ডলার, যা বাংলাদেশের গড় মাসিক মাথাপিছু আয়ের তুলনায় প্রায় ২৭ শতাংশ কম। উচ্চমূল্যে খাবার কিনে খেয়ে প্রাথমিকের একজন শিক্ষকের পক্ষে সংসার চালানো পাহাড়সম কঠিন।
বিশেষ করে যারা সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি, তাদের জন্য এটা বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত কয়েক বছর মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশ ছাড়িয়েছে। অথচ প্রাথমিক শিক্ষকেরা এখনো ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের বেতন কাঠামো অনুযায়ী বেতন-ভাতা পাচ্ছেন, তা দিয়ে মূল্যস্ফীতির এ কঠিন সময় পার করছেন তারা। বেতনের হিসাবে বিশ্বের দেশগুলোর চেয়ে বহু পিছিয়ে বাংলাদেশের প্রাথমিকের শিক্ষকেরা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ৪৫তম। আর দক্ষিণ এশিয়ায় সপ্তম অবস্থানে রয়েছে।
রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে যোগদান করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করা ফারজানা আক্তার। শিক্ষকতা করার প্রবল ইচ্ছা থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছেন তিনি। তবে আর্থিক অনটনে সিদ্ধান্ত বদলের পথে ফারজানা।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক-স্নাতক শেষ করে শখের বশে প্রাথমিকে চাকরিতে এসে এখন দেখছি জীবন অনেক কঠিন। এ চাকরিতে থেকে বাবা-মায়ের আশা পূরণ সম্ভব নয়। এখন ভিন্ন চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছি।
অর্থনৈতিক শ্বেতপত্রে প্রাথমিক শিক্ষকদের করুণ চিত্র তুলে আনায় খুশি প্রাথমিক শিক্ষক সমাজ। জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব ফরিদ আহাম্মদ বলেন, সহকারী শিক্ষকদের এ দাবি (দশম গ্রেড বাস্তবায়ন) যে যৌক্তিক তা সরকার বরাবর বলে আসছে। কিছু বাস্তবতায় সেটা এখনই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের এ বিষয়টি মাথায় আছে। যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি এটা বাস্তবায়ন হবে হয়তো।
সচিব মহোদয়ের সঙ্গে একমত পোষণ করে কিছুদিন পূর্বে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা একই সুরে সুর মিলিয়ে বক্তব্য রেখেছেন। অপরদিকে শিক্ষা উপদেষ্টা ছাত্রদের বলেছেন, সড়কে অবরুদ্ধ করে আন্দোলন না করে মানুষের দুর্ভোগ না বাড়িয়ে তাদের ন্যায্য দাবি নিয়ে তার কাছে যেতে। ন্যায্য দাবি সমাধানের আশ্বাস দেয়া হলে আন্দোলন বা ক্ষোভ দূর হয়ে যায়। তিনি ছাত্রদের অটো পাস যা জনসমর্থিত নয় তাও মেনে নিয়েছেন। ছাত্ররা রাস্তা অবরোধ করলে সাধারণত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নীরব ভূমিকা পালন করে থাকেন অথচ শিক্ষক বা কর্মচারীরা একই ঘটনা ঘটালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকেন। সরকারি কর্মচারীদের সাধারণত যখন যে সরকার আসে তখন সে সরকারের একান্ত বিশ্বস্ত কর্মচারী হিসেবে কাজ করতে হয়। নচেৎ জীবন জীবিকার পথে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। একটা গানের কথা মনে পড়লো ‘যেমনে নাচায়, তেমনি নাচি পুতুলের কী দোষ?’
রাজনীতির সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে কেউ কেউ হয়তো বেশি নৃত্য করে ফেলেন। তাকে আত্মপক্ষ সমর্থন করে বিধিসম্মতভাবে শাস্তি দেয়া হোক। ব্যক্তিগত আক্রোশ বা বিভিন্ন দোষ দেখিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বহু শিক্ষককে টেনেহিঁচড়ে হেনস্তা করা হয়েছে। উশৃঙ্খল শিক্ষার্থীর সহযোগিতায় বখাটে লোকজন শিক্ষকদের পদত্যাগ করিয়েছেন। উচিত ছিলো উশৃঙ্খলদের পাশাপাশি শিক্ষকদের বিচারের মুখোমুখি করা। এক্ষেত্রে তা দৃশ্যমান নয়।
শিক্ষার্থীরা আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ। শিক্ষকেরা আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ গড়ার কারিগর। এক কথায় শিক্ষকেরা সব শিক্ষিত নাগরিকের জনক। শিক্ষক সমাজের শিক্ষার্থীর তথা জাতির অভিভাবক। তাদের মর্যাদা হাওয়ার কথা সর্বশীর্ষে। জাতীয় কলঙ্কমোচনের স্বার্থে শিক্ষক মর্যাদা বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাস্তবায়নযোগ্য নয়। এ বক্তব্যের মাধ্যমে শিক্ষকদের প্রতি অবহেলা বা যন্ত্রণা দিলে নিজেদের তথা জাতিকে কলঙ্কিত করা হয়। যারা এই মর্যাদার বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন। তারা বিগত সময়ের শিক্ষার্থী হিসেবে নিজেদের কলঙ্কিত করবেন। বিশাল ক্ষোভ ও দুঃখ নিয়ে প্রিয় সন্তানতুল্য ছাত্রদের সঙ্গে শিক্ষকদের তুলনা করছি। আশা করি শিক্ষক সমাজের মর্যাদার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা আগামীর সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে।
লেখক: শিক্ষাবিদ
(মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন)