দক্ষিণ মিশরের লুক্সর শহরে আমেরিকার প্রাচীন মিশরবিদ এডউইন স্মিথ ভ্রমণে গিয়েছিলেন। ১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দে প্রাচীন মালপত্রের বিক্রেতা মোস্তফা আগা'র কাছ থেকে ষোড়শ বা সপ্তদশ মিশরীয় ফেরাউনের (১৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) কবর থেকে সংগৃহীত প্যাপিরাস কিনেছিলেন। এটি চার হাজার বছর আগের প্যাপিরাসে লেখা চিকিৎসা শাস্ত্রের একটি অংশ, আরো সুনির্দিষ্ট করলে আঘাতের চিকিৎসা শাস্ত্র বা সার্জারি। বিশেষজ্ঞরা এর মূল প্রণেতা মিশরের দ্বিতীয় রাজবংশের রাজা ডয়সরের প্রধানমন্ত্রী, চিকিৎসক, স্থপতি ইত্যাদি বহুবিধ গুণের অধিকারী। ইমহোটেপ (২৬৯২-২৬২৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) বিশ্বাস করেন, সেই সময় ডয়সরের দন্ত বিশারদ ও চিকিৎসা বিভাগের প্রধানের নাম জেরি রা। প্রাচীন মিশরে ২৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে পেসেশেট নামের মহিলা চিকিৎসকের পরিচয় পাওয়া যায়। সেই সময় পুরুষ চিকিৎসককে সনা ও মহিলা চিকিৎসককে সনত বলা হতো।
প্যাপিরাস আসলে তখনকার দিনের কাগজ, নীল নদে জন্মানো এক ধরনের ঘাসের পাতা থেকে তৈরি। পাতার ডাটা পাতলা করে লম্বালম্বি কেটে খাড়া ও সমান্তরাল দুই স্তরে সাজিয়ে চেপে জোড়া দিয়ে তৈরি করা হতো। সাধারণত সমান্তরাল পাশে লেখা হতো, খাড়া পাশ হয় খালি রাখা, না হয় নোটে লেখা হতো।
তখন মানুষ কালির ব্যবহার জানতো, আবিষ্কার নিশ্চয়ই আরো অনেক আগের। এডউইনের প্যাপিরাসটি কালো কালি দিয়ে লেখা। কিন্তু ব্যাখ্যাগুলো লাল কালিতে।
আমরা এখন যা কাগজ নামে চিনি তা প্রথম খ্রিষ্টপূর্বাব্দে চীনের আবিষ্কার। মিশরের প্যাপিরাসের কাগজের আরও তিন হাজার বছর পরে। তুত গাছের বাকল ঢেকী দিয়ে কুটে পাতলা জালির উপর শুকিয়ে চীনারা কাগজ তৈরি করতো। ৭৫১ খ্রিষ্টাব্দে আরবদের সঙ্গে চীনা টঙ সাম্রাজ্যের বর্তমানের কাজাখস্থান-কিরঘিজস্থানের তালাস নদীর তীর জুড়ে যুদ্ধে কিছু চীনা সৈনিক বন্দী হয়। তাদেরকে বর্তমান ইরাকের বাগদাদে নেওয়া হয় এবং কাগজ বানানোর কাজে লাগানো হয়। তাদের কাছ থেকে মুসলমানরা কাগজ তৈরির পদ্ধতি শিখলে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। বাগদাদে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থাগার ‘বায়াত-উল- হিকমা’র পেছনের রহস্য সহজলভ্য কাগজ এবং শাসকদের জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ। এই কাগজকে ভিত্তি করে জার্মানিতে কাগজের ছাপাখানা তৈরি হয়। আপনারা জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টের ছাপাখানার গুটেনবার্গ মিউজিয়ামে গিয়ে দেখে আসতে পারেন।
লেখার তিন উপাদান কাগজে-কালি-কলম তৈরি পদ্ধতি, বস্তুগত ও রাসায়নিক উপাদানের ব্যাপক বিবর্তন হয়েছে। এখনকার দিনে যে ভার্চুয়াল ইলেকট্রনিক কালি-কাগজ কম্পিউটারে লেখা হয় তা-ও অনেকেই ভেবে কুল-কিনারা করতে পারেন না।
এবার একটি বিখ্যাত মেডিক্যাল প্যাপিরাসের কথায় আসা যাক: আমেরিকান এডউইন মিশরের লুক্সরে গিয়ে জনৈক মোস্তফার কাছ থেকে একটি প্যাপিরাস কেনেন, কেনার সময় জানতেন না এর ভেতরে কি আছে। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যুর পর তার মেয়ে নিউইয়র্ক হিসটোরিক্যাল সোসাইটিকে এটি দান করেন। এই সোসাইটির ক্যারোলিন রানসম উইলিয়াম এর গুরুত্ব উপলব্ধি করে জেমস হেরি ব্রেসটেডকে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে এর ইংরেজিতে অনুবাদ করতে দেন। জেমস ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে ড. অরনো বি লুকোরড এর সহায়তায় অনুবাদ করলে এর মাহাত্ম্য প্রকাশ পায়। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সর্বসাধারণের জন্য ব্রুকলিন মিউজিয়ামে রাখা হয়। এরপর থেকে নিউইয়র্ক একাডেমির মেডিসিন রাখা হয়।
২০০৫-০৬ খ্রিস্টাব্দে মেট্রোপলিটন মেউজিয়ম অব আর্ট, নিউইয়র্কে প্রদর্শন করা হয়। এই সময় ইজিপশিয়ান আর্ট এর কিউরেটর জেমস পি এলেন একটি ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন। ব্রেকস্টেডস এর ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের অনুবাদের পর এটি ছিল একটি পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ। এই অনুবাদ থেকেই প্রাচীন মিশরের চিকিৎসাশাস্ত্রে সার্জারির প্যাপিরাসটি দর্শকদের আলোড়িত করে।
অনুবাদ হতে দেখা যায়, এখানে ৪৮ ধরনের আঘাত, ক্ষত, হাড়ভাঙ্গা, স্থানচ্যুত হাড় ও ফোড়ার চিকিৎসা সম্পর্কে ব্যবস্থাপত্র ও পদ্ধতি বর্ণনা করা আছে। এছাড়াও আরো বেশ কয়েকটি চিকিৎসা সম্পর্কিত প্যাপিরাস সম্পর্কে জানা যাক। ইবার্টস প্যাপিরাস ১৫৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের চিকিৎসা শাস্ত্রের সংকলন।
মাছি, উকুন, বিচ্ছু, পোকামাকড়, ইঁদুর, নখের প্রদাহ, কুমিরের কামড় থেকে শুরু করে ৭০০ প্রকার চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্র আছে। মজার বিষয় হৃৎপিণ্ড এবং রক্ত সংবহনতন্ত্র সম্পর্কে তাদের বেশ পরিষ্কার ধারণা ছিল। জার্মান মিশরবিদ ও উপন্যাসিক জর্জ মারকুইস ইবার্টস ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে সংগ্রহ করায় তার নাম অনুসারে এই পেপারসটির নামকরণ করা হয়েছে।
কাহুম জাইকোলোজিক্যাল প্যাপিরাস ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের প্রফেসর ফ্লিনডারস পেটরি মিশরের বর্তমান লেহুন শহরের কাছের একটি স্থান থেকে আবিষ্কার করেন। মিডল কিংডম (১৮৫০-১৭০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) ফেরাউনের শাসনের ২৯তম বৎসর ১৮২৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে কোন একজন চিকিৎসক স্ত্রীরোগের চিকিৎসার জন্য এটি সংকলন করেছিলেন। আবিষ্কৃত স্থান কাহুন সেই সময় রমরমা শহর। মহিলাদের চিকিৎসা করার মত আর্থিক সংগতিও ছিল। প্যাপিরাস বেশ বহু বারবার ব্যবহৃত হয়েছিল। তাই এর একপাশে প্রাচীনকালে পটি দেয়া হয়েছিল।
দ্য লন্ডন মেডিক্যাল প্যাপিরাসে প্রাচীন মিশরের চামড়া, চোখ, প্রসূতি এবং পোড়া চিকিৎসার মেডিক্যাল প্রেসক্রিপশন। চিকিৎসার অনুষঙ্গ হিসেবে দুষ্ট আত্মা ও ভূতের বিষয়েও পরামর্শ দেয়া আছে। দ্য কার্লসবার্গ প্যাপিরাস মূলত স্ত্রী রোগের বিশেষত গর্ভকালীন এবং চোখের চিকিৎসা সংক্রান্ত। এটি প্রাচীন মিশরীয় ভাষা থেকে শুরু করে প্রাচীন গ্রিক ভাষায় লেখা মধ্য রাজবংশ ও তার পরবর্তীকালে ক্যাপিরাস।
দ্যা হার্সটড মেডিক্যাল প্যাপিরাসে মূত্রনালীর সংক্রমণ ও পরিপাকতন্ত্রের রোগ এবং এর সাথে সম্পৃক্ত অন্যান্য সমস্যার চিকিৎসা সম্পর্কে ব্যবস্থাপত্র দেওয়া আছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইবার্টস প্যাপিরাস ও বার্লিন প্যাপিরাসের সঙ্গে মিল রয়েছে। নতুন সাম্রাজ্যের সময়ের প্রতিলিপি হলেও এর মূল উৎস মধ্য রাজ্যের সময়ে।
দ্যা চেস্টার মেডিক্যাল প্যাপিরাসে (১৫৭০ থেকে ১০৬৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কোলোরেকটাল ক্যানসার ও মাথা ব্যথা প্রশমনের জন্য গাঁজা ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া আছে। হেরোডটাস খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে তার হিসটোরিস বিই এ স্কাইথিয়ানদের রিক্রেশনাল হ্যালুসিনোজেন এর জন্য ড্রাগ হিসাবে গাঁজা সেবনের উল্লেখ করেছেন।
দ্যা বার্লিন মেডিক্যাল প্যাপিরাস (২০২৪ থেকে ১৭৮২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) মূল থেকে নিউ কিংডম সময়ের প্রতিলিপি করা হয়েছে। তাতে জন্মনিরোধ এবং বন্ধাত্ব চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্র দেওয়া আছে। অবাক হবার বিষয়, সেই সুপ্রাচীনকালে মহিলাদের পেশাব সংগ্রহ করে তাতে ভেষজ রস দিয়ে রং পরিবর্তন থেকে গর্ভাবস্থা নির্ণয় করা হতো। ইবার্টস এর সাথে এই প্যাপিরাসের কিছু কিছু ক্ষেত্রে মিল লক্ষ্য করা যায়।
প্রাচীনকালে তখনকার দিনের সারা দুনিয়ায় মিশরীয় ডাক্তারদের প্রচুর চাহিদা ছিল। মিশরের স্বর্ণ যুগে গ্রিকরা মেডিক্যাল পড়ার জন্য মিশরে আসতেন। গ্রিক চিকিৎসাবিদ গ্যালেন (১২৬-২১৬ খ্রিষ্টাব্দ) নিজেই স্বীকার করেছেন, তিনি জনৈক ক্লিওপেট্রার (মিশরের ফারাও ক্লিওপেট্রা নন) এর কাছে চিকিৎসা বিদ্যা শিখেছেন। মিশরের কাছ থেকে গ্রীসদের, সেখান থেকে রোমানদের হস্তগত হয়ে চিকিৎসা শাস্ত্র আরো উন্নত হয়েছে। এরপর আরবদের হাতে এসে ক্রমান্বয়ে চিকিৎসাশাস্ত্র কাব্যের রূপ নিয়েছে।
উজবেখস্থানের 'খিবা' শহরের উপকণ্ঠে ইবনে সিনার পৈত্রিক বাড়িতে গিয়ে জানতে পারি, ফেরদৌসীর শাহনামার আদলে ইবনে সিনার চিকিৎসাশাস্ত্র ছন্দবদ্ধ রচনা। ইউরোপে চিকিৎসা শাস্ত্র উন্নতির শিখরে উঠেছে। তারপরও চীনের ১ম সম্রাটের মৃত্যুহীন জীবনের সন্ধান এখনো অব্যাহত।
অপরপক্ষে একমাত্র ফ্লিনডার পেট্রি স্থানীয় নামটি ব্যবহার করেছেন। এরফলে জ্ঞান অনুসন্ধানকদের প্যাপিরাস ও তার বিষয়বস্তু সম্পর্কে আগ্রহ জন্মে ও জানা সহজ হয়। সংগ্রাহক এনটিকুয়ারিয়ামদের নামে নামকরণ করা মানবজাতির কি কল্যাণে আসবে তা বোধগম্য নয়। অতীতে বিভিন্ন দেশ থেকে সারা দুনিয়ায় কলোনী স্থাপন ও ধর্ম বিস্তার করা হয়েছে। তাদের কৃতিত্ব ধরে রাখার জন্য তাদের নামে প্রচার করা হয়।
মিশরীয়রা গ্রিকদের সহস্রাধিক বছর আগে চিকিৎসা বিজ্ঞানের জ্ঞান উদ্ভাবন ও সংকলন করলেও ইমহোটেপ 'ফাদার অফ মেডিসিন' হতে পারেননি; হয়েছেন গ্রিক হিপোক্রেটিস। কিন্তু এ সম্পর্কে জাতিসংঘের অঙ্গ সংগঠন ইউনেস্কো ভেবে দেখতে পারে। মিশরীয়রা অমূল্য সম্পদকে সামান্য অর্থের বিনিময়ে হস্তান্তর করেছে। হাত বদলে প্যাপিরাসের নামই শুধু বদলায়নি কেমেট (কালো মাটির দেশ) বদলে মিশর হয়েছে।
ওই সময়কার প্যাপিরাস প্রাপ্তিস্থানের স্থানীয় নাম কিংবা ফেরাউন বা লেখক বা সংকলক, ডাক্তার বা মহিলা ডাক্তারের নাম অনুসরণে নাম রাখা হলে আরও বেশি সার্থক হতো কি না?
লেখক: প্রবাসী