আজ ১১ ডিসেম্বর। আন্তর্জাতিক পর্বত দিবস। পার্বত্য এলাকার মানুষের জীবনমান উন্নয়ন, সচেতনতা ও টেকসই ভবিষ্যৎকে গুরুত্ব দিয়ে জাতিসংঘ ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দের ১১ ডিসেম্বর থেকে আন্তর্জাতিক পর্বত দিবস পালন করে আসছে। ২০০২ খ্রিষ্টাব্দ জাতিসংঘ দিবসটি পালনের ঘোষণা দেয়া দেয়। ‘পর্বত’ তিন অক্ষরের একটা শব্দ হলেও কতো টান তার মধ্যে। কিসের নেশায় ভ্রমণপিপাসু মন ছুটে যায় পর্বত ও পাহাড়ের কাছে-তা হয়তো ভ্রমণপিপাসু মনই বলতে পারবে। বিশাল আয়তন নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে পর্বত। বিশাল উচ্চতা থাকা সত্ত্বেও পর্বত কতোটা স্থির, কতোটা শান্ত। বছরের পর বছর ধরে আকাশ পানে চেয়ে থাকা বিশাল ভূমিরূপের নাম পর্বত। প্রাকৃতিক সম্পদ পাড়াড় ও পর্বত মহান সৃষ্টিকর্তার দান। মানুষের পক্ষে এটি তৈরি করা সম্ভব নয়। এটি প্রাকৃতিক সম্পদের অনন্য আধারের নাম ।
স্কটিশ-মার্কিন লেখক জন মুইর-এর একটা বিখ্যাত উক্তি আছে, ‘পর্বত ডাকছে, আমাকে অবশ্যই যেতে হবে।’ তিনি নাকি পর্বতের ডাক শুনতে পেতেন। তথ্য বলছে, পার্বত্য অঞ্চলে পৃথিবীর প্রায় ১০ ভাগ মানুষের বাস। পৃথিবীর প্রায় ২০ ভাগ পার্বত্য অঞ্চল। এই অঞ্চল প্রায় অর্ধেকের বেশি মিঠাপানি বা বিশুদ্ধ পানির উৎস। পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের জীবন নানা দিক দিয়ে বৈচিত্র্যময়। পর্বতমালা, নদ-নদী, বহু প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলকে করেছে বৈচিত্র্যপূর্ণ। ভঙ্গিল পর্বত ও স্তূপ পর্বতের উচ্চতা তুলনামূলক একটু কম হয়। তথ্য মতে, সমুদ্র সমতল থেকে ৬১০ মিটারের বেশি উঁচু বিশিষ্ট খাড়া ভূভাগকে পর্বত বলা যায়। ভূগোলবিদদের আরেক সূত্র বলছে, ১ হাজার মিটারের বেশি উচ্চতার শৃঙ্গকে পর্বত বলে।
সে হিসেবে আমাদের দেশে ৬১০ মিটারের বেশি উচ্চতার সাকা হাফং, মদক মুয়াল, যোগী হাফং, কেওক্রাডং, দুমলংসহ বেশ কিছু পর্বত বা পর্বতশৃঙ্গের দেখা মেলে। যদিও বাংলাদেশে এগুলো পাহাড় হিসেবে পরিচিত! বাংলাদেশ মূলত নিম্নভূমির দেশ। বাংলাদেশে শুধুমাত্র দক্ষিণ পূর্বে চট্টগ্রামের পাহাড়, উত্তর পূর্বে সিলেটের নিচু পাহাড় ও উত্তর এবং উত্তর-পশ্চিমে কিছু উচ্চভূমি রয়েছে। এই পাহাড় ও টিলা বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের আধার। বাংলাদেশের ৫ ভাগের ১ ভাগ পাহাড়ি অঞ্চল। এই সব পাহাড়ি বা পার্বত্য অঞ্চলে বিশাল একটা জনগোষ্ঠীর বাস। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুম এলেই পাহাড়ধসের মতো নেতিবাচক খবর পত্রিকার শিরোনাম হয়। পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর নিহত ও আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া বছরের বিভিন্ন সময় পাহাড় কাটার মতো পরিবেশ বিধ্বংসী কাজও দেখা যায়। এসব কাজের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় জীবনধারার সঙ্গে মিশে আছে পাহাড়ি অঞ্চল। পাহাড় ও প্রকৃতির ক্ষতি করা মানে এসব জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকার ওপর আঘাত আনা।
দেশে দেশে মানুষ পর্বত থেকে আহরিত সম্পদ আহরণসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে। পর্বত উদ্ভিদ ও প্রাণীর আরেক আশ্রয়স্থল । পর্বতের ক্ষতি মানে পৃথিবীতে মিঠা পানি প্রাপ্তির ওপর আঘাত। জীববৈচিত্র্যের বিশাল একটা ক্ষেত্র হলো পর্বত ও আশপাশের স্থান। কিন্তু বিভিন্ন কারণে পাহাড় ও পর্বতের ক্ষতি করা হচ্ছে। পাহাড় ও পর্বতের ওপর জেনে-বুঝে আঘাত করা হচ্ছে। পর্বতকে তার মতো করে থাকতে দেয়া হচ্ছে না। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপিরকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন, দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন, পাহাড়ের পাদদেশে চাষাবাদের ফলে ক্ষয়সহ বিভিন্ন কারণে পাহাড় ও পর্বতের ক্ষতি হচ্ছে। পর্বতের ক্ষতির অর্থই হলো প্রকৃতির ক্ষতি, পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়া।
প্রকৃতিতে প্রতিটি সৃষ্টির কোনো না কোনো কাজ আছে। যা তৈরি করা যায় না, তা ধ্বংস করার অধিকার কারো থাকা উচিত নয়। ভূমির ভারসাম্য রক্ষায় পাহাড়-টিলা গুরুত্ব অটুট রাখা আবশ্যক। পাহাড় ও পর্বত পর্যটন শিল্পের আরেক গুরুত্বপূর্ণ উৎস। বাংলাদেশসহ বিশ্বের পযটন খাতের বড় একটা আয়ের উৎস এই পাহাড় ও পর্বত। বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নের স্বার্থে পার্বত্য অঞ্চলের উন্নয়ন অপরিহার্য। শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র মানবজীবনে প্রকৃতির রহস্যময় সৃষ্টি পাহাড় ও পর্বতের গুরুত্ব অপরিসীম। জীববৈচিত্র্যের আধার বাঁচাতে না পারলে পরিবেশের ওপর নেমে আসবে চরম আঘাত। তাই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় প্রকৃতির গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ পাহাড় ও পর্বতকে রক্ষা করতে হবে। পর্বতকে পর্বতের মতো করে থাকতে দিতে হবে-আন্তজার্তিক পর্বত দিবসে এটাই চাওয়া।
লেখক: সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)