এ কথা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই যে, বিগত সরকারের আমলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হয়েছে, তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, তা কোনো ন্যায়নীতির ভিত্তিতে হয়নি। সংসদ সদস্যদের চাহিদাপত্র অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, ফলে সম্পূর্ণরূপে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির মাধ্যমে জাতীয়করণের এ পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। এ বিষয়ে আমি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অব্যবস্থাপনা নিয়ে তখন একাধিকবার প্রসঙ্গক্রমে ফেসবুকে আলোচনায় এনেছি।
পুরো প্রক্রিয়াটি ছিলো কেনাবেচার মতো। ফলে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত বা গেজেট হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত রাজনীতিক ও কতিপয় শিক্ষক নেতার মাধ্যমে গণহারে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের নিকট থেকে অর্থ আদায় করা হয়েছে। তখন শিক্ষকেরা টাকা নিয়ে এমপির বাড়িতে দিনরাত দৌড়াদৌড়ি করেছে। বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা প্রতিষ্ঠানে জমাকৃত ভবিষ্যৎ তহবিলের অর্থ উত্তোলন করে নেতাদের হাতে তুলে দিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর দেখা গেলো অনেকেরই মাথায় হাত। যারা জাতীয়করণের তালিকায় আসেনি তারা টাকা ফেরৎ পেতে নতুন করে দৌড়ঝাঁপ শুরু হলো।
ততোদিনে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ অবসরে গেছেন, কোনো কোনো এলাকার এমপি মৃত্যুবরণ করেছেন বা নির্বাচনে হেরে ক্ষমতা থেকে সরে গেছেন। এ সুযোগে তারা একে অন্যকে টাকা নেয়ার দায় দিয়ে বেঁচে গেছেন। যেখানে অধ্যক্ষ ও এমপি অপরিবর্তিত ছিলেন, সেখানে ঘটেছে শিক্ষকের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা। এ ক্ষেত্রে দিঘলিয়ার আলহাজ্ব সরওয়ার খান ডিগ্রি কলেজের নাম বিশেষভাবে উল্লখযোগ্য।
অনেক স্থানে এমপিরা পুরাতন ও স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানটির নাম না দিয়ে নিজের নামে বা পরিবারের নামে করা নতুন প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে ডিও দিয়ে তালিকাভুক্ত করেছেন। কিংবা অন্য কোনো স্বার্থে পুরাতন ও মূল প্রতিষ্ঠানটির নাম না দিয়ে অখ্যাত প্রতিষ্ঠানটির নাম দিয়েছেন। যেমন বগুড়ার সারিয়াকান্দি ডিগ্রি কলেজটি বাদ দিয়ে এমপির নামে প্রতিষ্ঠিত নতুন কলেজটিকে জাতীয়করণ করা হয়েছে, খুলনার ফুলতলাতেও তাই। বরগুনার বামনা উপজেলার মূল কলেজ বামনা কলেজকে সরকারিকরণ করলেও এর পাশাপাশি একটি কলেজিয়েট বয়েজ স্কুলকে সরকারিকরণ করা হয়। ফলে এখানে মেয়েদের তথা নারী শিক্ষার দুই প্রতিষ্ঠান একটি মহিলা কলেজ ও একটি গার্লস স্কুল থাকা স্বত্ত্বেও তারা সুযোগ পায়নি। এখানে রাজনৈতিক বিবেচনা কাজ করেছে, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এ রকম শত শত উদারণ আছে, যা যৌক্তিকতার আলোকে তদন্ত করলে বেরিয়ে আসবে আসল রহস্য, তথা দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও দলীয় বিবেচনা।
এতে পার্শ্ববর্তী পুরাতন প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র ও যোগ্য শিক্ষকেরা চরম বৈষম্যের শিকার হয়েছেন, যা শিক্ষাব্যবস্থায় একটা চরম হতাশাজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। পুরাতন প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র শিক্ষকের ছাত্র নতুন প্রতিষ্ঠানে যোগদানের কিছুদিনের মধ্যেই জাতীয়করণের সুবিধাটি লাভ করলো। অথচ সিনিয়র শিক্ষকটি অনেক অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও জ্যেষ্ঠতা নিয়েও বেসরকারির মর্যাদায় রয়ে গেলেন, পাশেই তার ছাত্র সরকারি কলেজের শিক্ষক, প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা। এর নেতিবাচক প্রভাব শিক্ষাব্যবস্থায় এখনো বিদ্যমান। এ জন্য বিগত সরকারের আমলে বেসরকারি শিক্ষকরা জাতীয়করণের দাবিতে একটি সফল আন্দোলন গড়ে তুললেও সরকারদলীয় একটি গ্রুপের সাথে আঁতাত করে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকার প্রতারণ করে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে শিক্ষকদেরকে ফিরিয়ে দিয়েছিলো। পরবর্তীতে শিক্ষক নেতাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছিলো।
জাতীয়করণের এই বৈষম্যের একটা সমাধান হওয়া বাঞ্ছনীয়। তবে ন্যায় বিচার থেকে যারা বঞ্চিত হয়েছেন তাদেরকে সুবিধা দেবার কমন কোনো ঘোষণা দিয়ে নয়। তেমন ঘোষণা এলে আবার ব্যবসার সৃষ্টি হবে। এ ক্ষেত্রে আমি দুইটি প্রস্তাব করছি:
১. একটি নির্দিষ্ট সময় দিয়ে, যেমন-আগামী ১ জুলাই থেকে এমপিওভুক্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি করা হবে। এর মধ্যে বাছাই কাজ সম্পন্ন করবে, সম্পন্ন করতে না পারলেও এমপিও তালিকা অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয়ভাবে পদ সৃষ্টি করে এডহক নিয়োগ প্রদান করা হবে। শর্ত থাকবে, পরবর্তীতে বাছাইতে বড় ধরনের কোনো ত্রুটি ধরা পড়লে স্থায়ীকরণ হবে না। যেহেতু ১ জুলাই থেকে সকলকে একযোগে সরকারিকরণ করা হবে, তাই তদবিরের কোনো সুযোগ থাকবে না, কোনো দালালের আবির্ভাব হবে না।
২. আর্থিক কারণে যদি সকলকে একযোগে করা না যায় সেক্ষেত্রে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মধ্যে যাদের চাকরির বয়স ১০ বছর পূর্ণ হয়েছে বা হবে সেই দিন থেকে তিনি বা তারা সরকারিকরণের আওতায় অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ লাভ করবেন। ইতোপূর্বে যাদের চাকরির বয়স ১০ বছর পূর্ণ হয়েছে তাদের ১০ বছর পূর্তি থেকে তা কার্যকর হবে এবং তারা বকেয়া পাবেন।
এতে পরবর্তীতে পর্যাক্রমে সবাই একদিন সরকারিকরণের সুবিধা পাবেন। শূন্যপদে আর এনটিআরসিএ নয়, সরাসরি বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগ লাভ করবেন। শুধু নিয়োগপ্রাপ্ত এমপিওভুক্তরা এভাবে পর্যায়ক্রমে ১০ বছর পূর্ণ করে সরকারির আওতায় আসবেন।
এভাবে জাতীয়করণে সৃষ্ট বৈষম্য দূর করে সব শিক্ষককে একই মর্যাদায় আনা সম্ভব এবং বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থার জন্য আনা অপরিহার্য।
লেখক: সাবেক চেয়ারম্যান, যশোর শিক্ষা বোর্ড