ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪ , ২৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

দেশের মাদরাসা শিক্ষার সংকট ও সম্ভাবনা

মতামত

মাহবুবুর রহমান, আমাদের বার্তা

প্রকাশিত: ০০:১০, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪

সর্বশেষ

দেশের মাদরাসা শিক্ষার সংকট ও সম্ভাবনা

দেশের শিক্ষাব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো মাদরাসা শিক্ষা। ঐতিহাসিকভাবে মাদরাসা শিক্ষা ইসলামিক জ্ঞান ও ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রচার-প্রসার এবং সমাজে নৈতিকতা গঠনে ভূমিকা রেখে আসছে। তবে আধুনিক সময়ে মাদরাসা শিক্ষার সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা রয়েছে। মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা, বিশেষত কওমি ও আলিয়া মাদরাসা, বাংলাদেশে একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করছে। তবুও এটি অনেক চ্যালেঞ্জ ও সংকটের মুখোমুখি, যা শিক্ষার মানোন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করছে। একই সঙ্গে, মাদরাসা শিক্ষার আধুনিকায়ন এবং এর সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগিয়ে সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্ত করার সুযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশে মাদরাসা শিক্ষা মূলত দুই ধরনের। ১. আলিয়া মাদরাসা: এই মাদরাসাগুলো সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয় এবং পাঠ্যক্রমে ধর্মীয় বিষয়ের পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষাও অন্তর্ভুক্ত থাকে। আলিয়া মাদরাসার শিক্ষার্থীরা দাখিল, আলিম, ফাজিল এবং কামিল পর্যায়ে পড়াশোনা করতে পারে। বাংলাদেশে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় ১৯ হাজারের বেশি আলিয়া মাদরাসা রয়েছে। আলিয়া মাদরাসাগুলো আবার কয়েক প্রকারের হয়ে থাকে। প্রাইমারি লেভেলের এগুলোকে বলা হয় ফোরকানিয়া মাদরাসা বা ইবতেদায়ি মাদরাসা। সেখানে প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাদান করা হয়। অন্য আরেকটি প্রকার হলো দাখিল মাদরাসা। যেখানে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা দেয়া হয়। অন্য আরেক প্রকার হলো আলিয়া মাদরাসা। যেখানে কলেজ লেভেল পর্যন্ত পড়াশোনা হয়। অন্য আরেকটি লেভেল হলো ফাজিল মাদরাসা, যেখানে ডিগ্রি মানের পড়াশোনা করানো হয়। চূড়ান্ত মানের মাদরাসা হল কামিল মাদরাসা। যেটি অনার্স ও মাস্টার্স লেভেলের সমমান। 

২. কওমি মাদরাসা: কওমি মাদরাসা স্বায়ত্তশাসিত, এবং এর পাঠ্যক্রম মূলত ইসলামিক শিক্ষার ওপর ভিত্তি করে। এগুলো সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে পরিচালিত হয় এবং আধুনিক বিষয় অন্তর্ভুক্তি তুলনামূলকভাবে কম। বাংলাদেশের প্রায় ১৯ হাজার ৯০০ এর বেশি কওমি মাদরাসা রয়েছে। কওমি মাদরাসাগুলো আবার কয়েক ধরনের হয়ে থাকে। যেমন-হাফিজি মাদরাসা: যে মাদরাসাগুলোতে পবিত্র কোরআন বেসিক লেভেল থেকে শুরু করে তা মুখস্থ করানো হয়। যে পবিত্র কুরআন মুখস্থ করে তাকে হাফেজ-এ কোরআন বলা হয়। কওমি মাদরাসার আরেকটি লেভেল হলো যেখানে দাওরায়ে হাদিস বা মাস্টার্স লেভেল পর্যন্ত পড়াশোনা করা হয়। সেগুলোকে দাওরায়ে হাদিস মাদরাসা বলা হয়। কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ পড়াশোনা হয় গবেষণা ভিত্তিক। সেগুলো আবার কয়েক লেভেলে বিভক্ত। যদি কেউ ফিকাহ শাস্ত্রে উচ্চতর গবেষণা করেন তাহলে তাকে মুফতি এবং এই বিভাগকে ইফতা বিভাগ বলা হয়। যদি কেউ হাদিস শাস্ত্রে গবেষণা করেন তাহলে তাকে মুহাদ্দিস বলে। আর যারা আরবি সাহিত্যে গবেষণা করেন তাদেরকে আদিব বলা হয়। এ ছাড়া যারা পবিত্র কোরআনের উচ্চারণ এবং তিলাওয়াত বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করে তাদের ক্বারী বলা হয়। 

মাদরাসা শিক্ষার প্রধান সংকটসমূহ

১. পাঠ্যক্রমের সীমাবদ্ধতা: মাদরাসা শিক্ষার অন্যতম প্রধান সংকট হলো পাঠ্যক্রমের আধুনিকীকরণের অভাব। বিশেষ করে, কওমি মাদরাসাগুলোতে বিজ্ঞান, গণিত, তথ্যপ্রযুক্তি এবং ইংরেজি বিষয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষা দেয়া হয় না। ফলে শিক্ষার্থীরা আধুনিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। মূলত কওমি মাদরাসাগুলোতে কুরআন হাদিস ফিকশাস্ত্র আরবি সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়গুলো পড়ানো হয়। তাদেরকে উচ্চতর বাংলা ইংরেজি এবং গণিত বিষয়গুলো শিক্ষা দেয়া হয় না। আধুনিক বিষয়ের সাবজেক্টগুলো সেভাবে নেই। ফলে তারা সমসাময়িক যুগের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে   তাল মিলিয়ে চলতে পারে না। ফলাফলে মাদরাসা শিক্ষার্থীরা মূলধারার চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারে না। সমাজের অন্যান্য অংশের সঙ্গে তাদের একটি বিভাজন তৈরি হয়।

সমাধান: আধুনিক বিষয় অন্তর্ভুক্তি এবং একটি সমন্বিত পাঠ্যক্রম প্রণয়ন। কওমি ও আলিয়া মাদরাসার মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তৈরি। সিলেবাসগুলো সংশোধন করে সেখানে কোরআন হাদিসসহ জাগতিক শিক্ষার বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত করে বাস্তবসম্মত সিলেবাস প্রণয়ন করতে হবে। 

২. প্রযুক্তিগত শিক্ষা ও দক্ষতার অভাব: প্রযুক্তি নির্ভর বিশ্বে মাদরাসার শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে রয়েছে। বেশিরভাগ মাদরাসায় আধুনিক প্রযুক্তি শিক্ষা দেয়া হয় না, এবং ইন্টারনেট সুবিধা অপ্রতুল। কওমি  মাদরাসাগুলোতে তাদের শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারে তাদেরকে নিরুৎসাহিত করা হয়। অনেক মাদরাসায় মোবাইল ফোন ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ফলাফলে শিক্ষার্থীরা তথ্যপ্রযুক্তি দক্ষতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। তারা আধুনিক দুনিয়ার চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত হতে পারে না। 

সমাধান: প্রতিটি মাদরাসায় কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন। তথ্যপ্রযুক্তি প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা।

৩. কর্মসংস্থানের চ্যালেঞ্জ: মাদরাসা শিক্ষার কারণে অনেক শিক্ষার্থী কেবল ধর্মীয় পেশার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। আধুনিক দক্ষতা অর্জনের সুযোগ কম থাকায় তারা অন্যান্য

পেশায় প্রবেশ করতে পারে না। তাদের পড়াশোনাগুলো এককেন্দ্রিক হওয়ায় চাকরির বাজারে তাদের সেক্টর অনেক কম। ফলাফলে শিক্ষিত বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পায়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে তাদের ভূমিকা সীমিত থাকে। তার একটি শিক্ষা শিক্ষিত কিন্তু তাদের শিক্ষার কোনো স্মৃতি থাকে না। অন্যান্য সাধারণ শিক্ষার্থীর মতো তারা ভালো চাকরি পায় না।  

সমাধান: কারিগরি শিক্ষা অন্তর্ভুক্তি। বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান। সিলেবাস উন্নয়ন করে বাস্তবভিত্তিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা। সেই সঙ্গে প্রযুক্তিগত শিক্ষা তাদের হাতে-কলমে শিক্ষা দেয়া। তবে চাকরির বাজারে তারা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকবে। 

৪. মান নিয়ন্ত্রণের অভাব: বিশেষ করে কওমি মাদরাসাগুলো স্বতন্ত্রভাবে পরিচালিত হয় এবং এদের ওপর সরকারি তদারকি নেই। ফলে শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। যদিও এখন তারা কয়েকটি বোর্ডের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। ফলে তাদের এখন এসব মাদরাসার মান মূল্যায়ন করা হচ্ছে। যদি তাদেরকে তত্ত্বাবধায়ন করা ঠিকমতো না হয়  ফলাফলে মাদরাসাগুলোতে শিক্ষার মান একেক স্থানে একেক রকম হয়। শিক্ষার্থীদের অর্জিত জ্ঞান বাস্তব জীবনে প্রয়োগে সীমাবদ্ধতা থাকে।

সমাধান: মান নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি নিরপেক্ষ অথরিটি গঠন। সরকারি সহায়তা ও তদারকি বাড়ানো।

৫. নারী শিক্ষার সংকট: অনেক মাদরাসায় নারী শিক্ষার্থীদের জন্য পৃথক শিক্ষাব্যবস্থা নেই। এ ছাড়া, সামাজিক এবং পারিবারিক কারণে নারীরা মাদরাসা শিক্ষায় আগ্রহী হলেও সীমিত সুযোগ পায়। বাংলাদেশে কওমি মাদরাসাগুলো স্বতন্ত্র মহিলা মাদরাসা স্থাপন করলেও তাদের মান নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন ওঠে। এসব মাদরাসায় সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কোথায় কীভাবে গড়ে ওঠে সেগুলোর কোনো নিবন্ধন নেই। অন্যদিকে আলিয়া মাদরাসাগুলো স্বতন্ত্র কোনো মহিলা মাদরাসা সেভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারিনি। ফলাফলে নারীরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। কর্মক্ষেত্রে নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ কমে যায়।

সমাধান: নারীদের জন্য পৃথক মাদরাসা স্থাপন। মাদরাসাগুলোতে নারী শিক্ষকদের সংখ্যা বাড়ানো।

মাদরাসা শিক্ষার সম্ভাবনা 

১. নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ গঠন: মাদরাসা শিক্ষা সমাজে নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মাদরাসা শিক্ষার্থীরা সাধারণত ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষায় পারদর্শী হয়।

সম্ভাবনা: সমাজে অপরাধ কমানোর ক্ষেত্রে মাদরাস শিক্ষার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। একটি সুশৃঙ্খল এবং নৈতিকতাপূর্ণ সমাজ গঠনে সহায়ক।

২. আধুনিক শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষার সমন্বয়: আলিয়া মাদরাসাগুলোতে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হয়। এই সমন্বয় আধুনিক সমাজে শিক্ষার্থীদের বহুমুখী দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করতে পারে।

সম্ভাবনা: সঠিক পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন হলে মাদরাসা শিক্ষার্থীরাও আধুনিক চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারবে। সমাজের বিভিন্ন স্তরে ধর্মীয় ও আধুনিক জ্ঞানের সমন্বয় ঘটবে।

৩. কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা: মাদরাসা শিক্ষায় কারিগরি ও বৃত্তিমূলক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জন্য কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করা সম্ভব। 
সম্ভাবনা: দক্ষ কর্মী তৈরি হবে, যা অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। শিক্ষার্থীরা আত্ম কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে।

৪. সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা: মাদরাসা শিক্ষার্থীরা সমাজের বিভিন্ন স্তরে নেতৃত্ব দিতে পারে। বিশেষত, ধর্মীয় শিক্ষার কারণে তারা সমাজে ন্যায়বিচার, শান্তি ও সহনশীলতা প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

সম্ভাবনা: সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব। ধর্মীয় সম্প্রীতি এবং সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় সহায়ক।

পরিশেষে বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষার সংকটগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর সমাধান করা গেলে এই শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আধুনিক বিষয় অন্তর্ভুক্তি, প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি, এবং কর্মমুখী প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের মূলধারার সমাজে সম্পৃক্ত করা সম্ভব। মাদরাসা শিক্ষার সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগিয়ে একটি নৈতিক, দক্ষ এবং প্রগতিশীল সমাজ গঠন করা সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ এবং সময়োপযোগী পরিকল্পনা।

লেখক: পিএইচডি গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় 

জনপ্রিয়