পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-ব্রহ্মপুত্র-কর্ণফুলী নদীবাহিত পৃথিবীর বৃহৎ বদ্বীপ বাংলাদেশের ইতিহাসে গৌরবময় মাস ডিসেম্বর। বাঙালির গৌরবময় বিজয়ের ইতিহাস পৃথিবীর ইতিহাসে অনন্য ও আলাদা। অন্যায়, অবিচার, নির্যাতন, শোষণ, বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি কখনো মাথানত করেনি। কবি সুকান্তের ভাষায়-‘শাবাশ বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়; জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার, তবুও মাথা নোয়াবার নয়।’ বাঙালিকে কখনো দমিয়ে রাখা যায়নি। পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার প্রায় ২০০ বছর পর সৃষ্টি হয় উপমহাদেশের দুটি দেশ পাকিস্তান ও ভারত। আর পাকিস্তানের শোষণ, বঞ্চনা, বৈষম্যে ও পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দি হয়ে বাঙালিরা তথা পূর্ব বাংলার জনগণ দিনের পর দিন নিষ্পেষিত হতে থাকে। বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস রক্তে রঞ্জিত ও বিভীষিকাময়। এর সূত্রপাত হয়েছিলো ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের যে বীজ রোপণ করা হয়েছিলো তা একের পর এক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কূটকৌশল, ষড়যন্ত্র ও বাঙালি নিধনযজ্ঞ থামেনি।
মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে এদেশে গড়ে ওঠেছিল জাতীয় ঐক্য। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে ছিলো সমগ্র জাতি। আর সে কারণেই মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ করা ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা সহজতর হয়েছিলো। পাকিস্তানি বাহিনীর বাঙালির ওপর সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের রাত ২৫ মার্চ। এরপর নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর আসে ঐতিহাসিক মহান বিজয়। বাঙালির চূড়ান্ত বিজয় বুঝতে পেরে বিজয়ের আগ মুহূর্তে পাকিস্তানি বাহিনী সুপরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে মেতে ওঠে। কিন্তু কোনো বাধাই বাঙালিকে রুখতে পারেনি। চূড়ান্ত বিজয়ের মাধ্যমে বাংলার মাটি থেকে চিরতরে বিদেশি শাসনের অবসান হয়। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর বাংলার আকাশে-বাতাসে মুক্তির আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে।
যে মাতৃভূমিকে ভালোবেসে মুক্তিযোদ্ধারা দেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো সে আত্মত্যাগ কখনো বৃথা যেতে পারে না। যে ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার জন্য বাঙালি জাতি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সে ভাষা ও সংস্কৃতি-মূল্যবোধ সমগ্র বাঙালি-বাংলাদেশিদের জন্য পথচলার অনন্ত প্রেরণা। লাখো শহীদের রক্তে রাঙানো আমাদের স্বাধীনতার সূর্য। স্বাধীনতা মানে চিন্তার স্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক মুক্তি। স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন! স্বাধীনতা তখনই গণমানুষের কাছে অর্থবহ ও স্বার্থক হয়ে ওঠে যখন প্রতিটি ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় থাকে এবং মানুষ যখন তাদের নাগরিক অধিকারগুলো নিয়ে কথা বলার সুযোগ পাবে। স্বাধীনতা মানে স্বাধীন সার্বভৌম জাতি হিসেবে টিকে থাকার চিরন্তন প্রয়াস। স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে হলে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হয়। সর্বদা সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ না হলে স্বাধীনতাকে রক্ষা করা যায় না।
জুলাই গণবিপ্লবে ছাত্র-জনতার বিজয় অর্জিত হয়েছে। বিজয় হয়েছে তরুণদের, বিজয় হয়েছে সাধারণ জনগণের। ৫৩ বছরে বাংলাদেশ একটু একটু করে বহুদূর এগিয়েছে। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প কোনো কোনো সময় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠতে চেষ্টা করলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-শক্তির কাছে সবসময় পরাস্ত হয়েছে। এখন সময় এগিয়ে যাওয়ার। প্রত্যেকটি নাগরিককে এখন দেশপ্রেমিক হতে হবে। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে সম্মিলিত প্রচেষ্টার বিকল্প নেই। যে অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার স্বপ্নে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলো হাজার হাজার বীর বাঙালি সে স্বপ্ন বাস্তবায়নে তরুণ জনগোষ্ঠীকে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করে যেতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে তরুণরাই সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতকারীদের সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিজয় দেখতে তরুণদেরকেই এখন কাজ করতে হবে। মাদক, ইভটিজিং, বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে তরুণ সমাজকে রুখে দাঁড়াতে হবে। অপহরণ, গুম, খুন, হত্যা, নারী ও শিশু নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে সমগ্র দেশবাসীকে সজাগ থাকতে হবে। নারীরা যেনো কোনো ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার না নয় সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। এখনকার তরুণরা হয়তো মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি কিন্তু তারাই অপশক্তিকে যুগে যুগে রুখে দিতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। তরুণদের এই চেতনা ও দেশপ্রেমকে কাজে লাগাতে নীতিনির্ধারকদেরও সঠিক ভূমিকা রাখতে হবে। তরুণ সমাজকে কোনো অদৃশ্য শক্তি যাতে বিপথে পরিচালিত করতে না পারে সে ব্যাপারে নীতিনির্ধারকদের সজাগ থাকতে হবে। প্রতিক্রিয়াশীলতা, উগ্র মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ রুখতে তরুণ সমাজকেই এখন অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় অবতীর্ণ হতে হবে। এককথায় সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও জঙ্গিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, মানব উন্নয়ন সূচক ও অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি লাভ করছে। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়তে এখন সবাইকে অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে হবে। তরুণদেরকে স্বপ্ন দেখাতে হবে। তরুণদেরকে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। তরুণদের উদ্যোক্তা হওয়ার পথে সব বাধা অপসারণ করতে হবে। এখনকার তরুণরা দেশকে মায়ের মতো ভালোবাসে। সে প্রমাণ তারা বিভিন্ন সময় দিয়েছে! মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারী তরুণ সমাজ নিজ নিজ অবস্থান থেকে যতো বেশি সক্রিয় হবে উন্নত সোনার বাংলা গড়তে জাতি তত আত্মবিশ্বাসী হবে। দেশসেরা মেধাবী তরুণদেরকে রাজনীতিতে আসার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। সর্বক্ষেত্রে গণতন্ত্র ও নিরপেক্ষতা থাকলে দেশ এগিয়ে যাবে-সন্দেহ নেই। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। রক্ত দিয়ে যে গৌরবোজ্জ্বল বিজয় অর্জিত হয়েছে তা কখনো বৃথা যেতে দেব না-বিজয়ের মাসে তরুণ সমাজের এই হোক অঙ্গীকার।
লেখক: শিক্ষক