মাধ্যমিকে বিভাগ বাছাইয়ের সময়টাতে অধিকাংশ শিক্ষার্থী সিদ্ধান্ত নিতে বেকাদায় পড়েন! নবম শ্রেণির শুরুতে মানবিক বা বিজ্ঞান অথবা ব্যবসায় এই তিনটির মধ্যে কোন বিভাগ নিয়ে সন্তান পড়বে-তা নির্বাচন করতে অভিভাবকের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা বিচার-বিশ্লেষণ না করেই সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে টেনশনে ভোগেন।
একেক বিভাগের পড়ালেখা ও ক্যারিয়ার গঠনের ধরন ভিন্ন। সঠিকভাবে বিভাগ বাছাই করতে না পারলে জীবনের শুরুতেই অনেক শিক্ষার্থীর লেখাপড়ায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অনেক সময় পুরো জীবনটাই এলোমেলো হয়ে যায়। তাই মাধ্যমিকে রেজিস্ট্রেশনের সময় জেনে বুঝে বিভাগ বাছাই করতে হবে। যেসব শিক্ষার্থীরা মানবিক বিভাগ নিয়ে ক্যারিয়ার বা জীবন গড়তে চাই লেখাটি তাদের জন্য।
মূল আলোচনায় আসা যাক। মানবিক বিভাগ সহজ না কঠিন? মানবিকে পড়লে কোন কোন চাকরি পাওয়া যায়? এমনসব প্রশ্ন বিভাগ নির্বাচনের সময়টাতে ঘুরপাক খায় মাথার মধ্যে। অনেক অভিভাবকও চিন্তায় পড়ে যান।
সন্তানকে কোন বিভাগে পড়ালে সুবিধা হবে? কোন বিভাগে পড়লে দ্রুত চাকরি পাবে? অনেকের ধারণা, মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান বিভাগে পড়েন আর দুর্বল শিক্ষার্থীরা মানবিক বিভাগে পড়েন। অপরদিকে মাঝামাঝি মানের শিক্ষার্থীরা ব্যবসায় বিভাগে পড়েন! কিন্তু এ ধারণা কোনোভাবেই সঠিক নয়! সমাজে বসবাস করতে হলে সব শ্রেণি-পেশার শিক্ষার্থী তথা মানুষের দরকার আছে। কোন শিক্ষার্থী ভালো আর কোন শিক্ষার্থী খারাপ-সেটা শাখা যাচাই হতে পারে না।
এক বিভাগের শিক্ষার্থীদের বাদ দিয়ে অন্য একক শিক্ষার্থীদের দিয়ে কখনো সমাজ ও দেশ চলতে পারে না বা চালানো সম্ভব নয়। তাই এককভাবে কোনো বিভাগের শিক্ষার্থীদের ভালো বা খারাপ বলার সুযোগ নেই। একজন শিক্ষার্থী যদি মনে করে সে গণিত ও বিজ্ঞানে কিছুটা দুর্বল সে বিজ্ঞান বিভাগ না নিয়ে মানবিক বিভাগ নেয়ার চিন্তা করতে পারে। এর মানে এই নয় যে, মানবিক বিভাগে গণিত ও বিজ্ঞান নেই।
তবে তুলনামূলকভাবে মানবিক বিভাগে বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলো নেই। মাধ্যমিকের সব বিভাগে বাংলা, গণিত, ইংরেজি ও আইসিটি তো থাকেই। তবে বিভাগ বিভাজনের বিষয়গুলো আলাদা। মানবিক বিভাগের বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে-ভূগোল ও পরিবেশ, বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা, পৌরনীতি ও নাগরিকতা ও অর্থনীতির মতো বিষয়। পাশাপাশি অতিরিক্ত একটি বিষয় (কৃষিশিক্ষা/গার্হস্থ্য) পড়তে হয়। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় বলা যায়, দেশের মোট শিক্ষার্থীর চারভাগের দুইভাগ শিক্ষার্থী মানবিক বিভাগ নিয়ে থাকে। চারভাগের একভাগ শিক্ষার্থী নিয়ে থাকে বিজ্ঞান বিভাগ। বাকি আরেক ভাগ শিক্ষার্থী নিয়ে থাকে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ। বিভাগ যাই হোক, ভালো করে পড়লে ও মনোযোগী হলে সব বিভাগেই ভালো ফলাফল সম্ভব।
মানবিকে ক্যারিয়ার গঠন: অনেকে বলে থাকেন, মানবিক বিভাগ হলো ক্যারিয়ার গঠনের প্রাণ। বাংলাদেশের শিক্ষাপদ্ধতি হিসেবে চাকরি পাওয়ার বা লেখাপড়া শেষে কোনো কিছু করার চিন্তা শুরু হয়ে যায় মাধ্যমিকের বিভাগ বিভাজন থেকেই। ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন কী? কী হতে চাই? কোন জায়গায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই? সেটা অনেকটা নির্ভর করে মাধ্যমিকের বিভাগ বিভাজন থেকেই। মাধ্যমিকে মানবিক বিভাগ নিয়ে পড়লে উচ্চ মাধ্যমিক ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে মাধ্যমিকের মতো বিষয় যেমন-ইতিহাস, ভূগোল, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, সমাজকর্ম, যুক্তিবিদ্যা, আইন, সাংবাদিকতা, অর্থনীতি এমন বিষয়সমূহ পড়তে হয়। এই বিভাগ নিয়ে পড়ালেখা করলে ভালো চাকরি হবে না-এমন কথা অনেকের মুখে বলতে শোনা যায়! এসব নেতিবাচক বাক্য গুজব ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রতিযোগিতার বাজারে যে পড়ালেখায় ভালো, অ্যাকটিভ ও সতর্ক তার চাকরির অভাব নেই, সে যে বিভাগেই হোক না কেনো। মানবিক বিভাগে পড়লে সুনির্দিষ্ট কিছু চাকরি ছাড়া প্রায় সব চাকরিতে ক্যারিয়ার গঠনের সুযোগ রয়েছে। প্রগতিশীল ধারার ও নিজের স্বাধীন মতো চাকরির সুযোগ রয়েছে মানবিক বিভাগে। বিজ্ঞান ও ব্যবসায় বিভাগের চেয়ে মানবিক বিভাগের চাকরির ক্ষেত্র ব্যাপক।
অনেক শিক্ষার্থীর স্বপ্ন থাকে বড় হয়ে আইনজীবী কিংবা বিচারক হবার-সে নিশ্চয় মানবিক বিভাগ নিয়েই পড়তে চাইবে। এ বিভাগে আইনের বিভিন্ন পেশায় যেমন-সহকারী জজ, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, আইনি পরামর্শক, ব্যারিস্টার ও আইন অফিসার হওয়ার সুযোগ রয়েছে। মানবিকে পড়ালেখা শেষ করে বিসিএসের পররাষ্ট্র, প্রশাসন, খাদ্য, কর, স্বরাষ্ট্র, ডাক, রেলওয়ে ও শিক্ষাক্যাডারসহ বিভিন্ন ক্যাডারে প্রবেশের সুযোগ রয়েছে। এছাড়া স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ইংরেজি ও গণিতের বিষয়ের শিক্ষক, দূতাবাসে চাকরি, আন্তর্জাতিক সংস্থায় চাকরি, ব্যাংক অফিসার, পুলিশ, সাংবাদিক, পত্রিকার সম্পাদক, এনজিওতে চাকরি, সশস্ত্র বাহিনীতে চাকরি, লেখালেখি, সমাজ ও উন্নয়নকর্মী, রাজনীতিবিদ, গ্রাফিক্স ডিজাইনার, ভিডিও এডিটর, নিজের মতো কিছু করাসহ সরকারি-বেসরকারি চাকরির বিভিন্ন ক্ষেত্র রয়েছে। মানবিকে পড়ে সরাসরি ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার না হতে পারলেও পরোক্ষাভাবে ডাক্তারি পর্যায়ের নাসিং পেশা, হোমিও চিকিংসক, প্যারামেডিকেল ডাক্তার হওয়ার সুযোগ রয়েছে। মানবিকে পড়ে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ারও সুযোগ রয়েছে।
বিভাগ বিভাজন মুখ্য নয়, বিষয় হলো অধ্যবসায় আর একাগ্রতা। পূর্ণ মনোযোগ ও লক্ষ্য ঠিক রেখে এগিয়ে যেতে পারলে মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত-এতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক: শিক্ষক