‘লেট দেয়ার বি লাইট অ্যাণ্ড দেয়ার ওয়াজ লাইট এভরিহয়্যার’ (ঈশ্বর বললেন, আলোকিত হোক, আর সঙ্গে সঙ্গে চারদিক আলোকিত হয়ে গেলো)--উক্তিটি বাইবেলে বর্ণিত হয়েছে। আর বাইবেলের নাম উচ্চারিত হলেই যার নামটি অতি আবশ্যকভাবে সামনে এসে পড়ে তিনি হলেন মহান যিশু। পবিত্র কোরআনে যিনি মরিয়ম-পুত্র, ঈসা মাসীহ নামে পরিচিতি লাভ করেছেন। নিউ টেস্টামেন্টের বর্ণনা অনুযায়ী তিনি নেজারেথের বেথেলহেম ইন নামক স্থানে জন্মেছিলেন, গ্যালিলিতে ধর্মপ্রচার করেন এবং ত্রিশ বছর বয়সে জেরুজালেমে উপস্থিত হন।
খ্রিস্টের জন্ম তারিখ নিঃসন্দেহে কল্পিত, অনুমান করা হয় তিনি প্রকৃতপক্ষে ইতিহাসে বর্ণিত তারিখের ৪ (চার) বছর আগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। যিশুর সঠিক আত্মজীবনী কোথাও পাওয়া যায়নি, বিভিন্ন জনের বর্ণনায় ব্যাপক গরমিল লক্ষ্য করা যায়। লুক রচিত সমাচারে (লুক ২:১-৭) বলা হয়েছে জোসেফের সঙ্গে যিশুর মা মরিয়মের বিয়ে ঠিক হয়েছিলো কিন্তু তারা এক সঙ্গে বাস করবার আগেই পবিত্র আত্মার শক্তিতে মরিয়মের গর্ভ-সঞ্চার হয়েছিলো। পবিত্র আত্মার দৈববাণী শুনেই শিশুটির নাম রাখা হয়েছিলো যিশু। যিশুর জন্ম নিয়ে নয় বরং তার ধর্ম, কর্ম, আদর্শ এবং আদেশ-প্রত্যাদেশের (কমান্ডমেন্টস) ওপর আলোকপাত করাই এ আলোচনার মুখ্য উদ্দেশ্য।
প্রাচীন রোমে অন্ধ ধর্মবিশ্বাসের ওপর খুব জোর দেয়া হতো। এর পেছনে যুক্তিও আছে--জনগণ যদি গোঁড়া ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয় তাহলে তাদের শোষণ করা আর দাবিয়ে রাখা খুব সহজ একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ইতালীয় রাজনীতিবিদ মেকিয়াভেলিও পরবর্তিতে রাজ্য শাসনে ধর্মের ওপরে গুরুত্ব আরোপ করেন। মিথ্যে হলেও কর্তব্যের খাতিরে অর্থাৎ জনগণের মগজ ধোলাই করতে রাজাকেও একটা ধর্ম মেনে চলতে হয়। জন্মগতভাবে যিশু ছিলেন একজন ইহুদি কিন্তু তিনি ইহুদি কিংবা হিব্রু ধর্মের অনুষ্ঠান-সর্বস্বতা ও পুরোহিতদের প্রাধান্য খুবই অপছন্দ করতেন। সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হওয়া সত্বেও যিশু তখন প্রচার করলেন ক্ষমা, প্রেম আর প্রীতির ধর্ম। তার মতে সব মানুষ এক এবং অদ্বিতীয় ঈশ্বরের সন্তান। তিনি বলেন, তোমাদের পিতা এক এবং তোমরা সবাই ভাই। তিনি অসীম, সর্বশক্তিমান এবং করুণাময় ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন। মোহাম্মদ আব্দুল হাই তার ‘বাঙালির ধর্মচিন্তা’ গ্রন্থে লিখেছেন, খ্রিস্ট ধর্মের বক্তব্যের মধ্যে ইসলামের একত্ববাদের সাদৃশ্য আছে। অন্যদিকে ভ্রাতৃত্ব-প্রেম-প্রীতির দিক থেকে বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে কিছুটা মিল লক্ষণীয়।
ইহুদিরা বহু প্রাচীনকাল হতেই এক অদ্ভুত নাছোড়বান্দা শ্রেণির জাতি। ওরা দীর্ঘদিন ধরে একজন ত্রাণকর্তার অপেক্ষায় ছিলো এবং ভেবেছিলো ওল্ড টেস্টামেন্টে যে মেসিয়াহ্র উল্লেখ রয়েছে যিশুই সেই প্রতিশ্রুত মহামানব এবং যিশুই তাদের সেই কাঙ্ক্ষিত ত্রাণকর্তা। কিন্তু খুব শিগগির তারা যিশুকে অপছন্দ করতে শুরু করলো। কারণ, যিশু সেই সময়ের মানুষদের আচার-ব্যবহার, সমাজব্যবস্থা, প্রচলিত কুসংস্কার সবকিছুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান । বিশেষ করে তিনি ধনী আর ভণ্ড ধর্মধ্বজী ব্যক্তিদের তীব্র নিন্দা করতে লাগলেন। তার আদর্শ প্রচারের কৌশল ছিলো অত্যন্ত অভিনব। গল্প ও কাহিনির ছলে তিনি উপদেশ দিতেন। তখন স্পষ্টই বোঝা গেলো তিনি আজন্ম বিপ্লবী এবং নির্ভিক একজন প্রচারক। প্রচলিত সমাজ-ব্যবস্থা তিনি মোটেই বরদাস্ত করতে পারলেন না, তাই সমাজ-সংস্কারের জন্য তিনি উঠেপড়ে লেগে গেলেন। ইহুদিরা এসব পছন্দ করলো না। অতএব অনেকেই প্রকাশ্যে তার বিরোধিতা করতে লাগলো। তিনি বলতেন, ঈশ্বর একটি ভালোবাসার নাম, যাদের অন্তরে ভালোবাসা আছে তারা ঈশ্বরকে জানে। মানুষকে ভালোবাসার মাধ্যমেই ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ ঘটে। যিশু এক মহান আদর্শ তার চরিত্রে ধারণ করেছিলেন। তিনি কখনই প্রতিহিংসা বা প্রত্যাঘাতের কথা বলেননি। বরং তিনি শিষ্যদের বলতেন, কেউ এক গালে চড় দিলে তোমরা অন্য গালটিও পেতে দিও, তবুও আঘাতের প্রতিশোধে আঘাত করো না। অপরাধীকে ক্ষমা করে দেয়াই তার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট ছিলো। সামাজিক কর্তব্য, দায়িত্ব এবং সচেতনতাকে তিনি খুব বড় করে দেখতেন এবং অনুসারীদেরকেও সেই শিক্ষাই দিতেন। ‘সর্বত্র ঈশ্বরের রাজত্ব’ এই চেতনাই খ্রিষ্ট ধর্মের প্রধান আদর্শ। যিশু তার শিষ্যদের উদ্দেশে বলতেন, হে খ্রিস্ট পুত্ররা, যতো শ্রান্তভ্রান্তের দল তোমরা আমার কাছে এসো, আমি তোমাদের বিশ্রাম দেবো।
যিশুকে সেই সময়ের সবচেয়ে জ্ঞানী ও উত্তম ব্যক্তি মনে করা হতো। কারণ, তিনি ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাসসহ মঙ্গলময় নৈতিকতার ওপর জোর দিতেন। ক্ষুধার্তদের খাদ্যদানে ও পীড়িতদের সেবায় তার কোনো ক্লান্তি ছিলো না। কোমল হৃদয়ের এই মহাপুরুষ মানুষের পাপময়, পংকিলময় জীবনাচারণ নিয়ে উৎকন্ঠিত ছিলেন। তার সুসমাচারগুলোতে দেখা যায় তিনি পাপীদের উদ্দেশে বলছেন, ওরে শয়তানগ্রস্ত, ওরে বিষধর সর্পের বংশধর, তোরা কি নরকের করালগ্রাস থেকে কোনোভাবে উদ্ধার পাবি? এ থেকে বোঝা যায় তিনি মানবকে পাপমুক্ত করবার চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠতেন। তিনি মানুষকে শিক্ষা দিতেন কীভাবে নিজে পায়ে দাঁড়াতে হবে এবং খোলা চোখে দেখতে হবে জগতের সৌন্দর্য তথা ঈশ্বরের সৌন্দর্য, ভালোমন্দ দিকসমূহ। মানব চরিত্রের কুৎসিত দিকগুলো তাকে চিন্তিত করতো, তাই তিনি সবসময় শিষ্যদেরকে সেইসব বিষয়ে সতর্ক করে দিতেন। তিনি একটি মঙ্গলময় সমাজব্যবস্থা গড়তে চেয়েছিলেন দয়া, জ্ঞান এবং সৎসাহস দিয়ে। খ্রিস্টের বারো জন শিষ্যের আদর্শমণ্ডিত ও কষ্টসহিষ্ণু জীবননীতি যেনো মানুষকে শিক্ষা দেয়ারই একটি প্রচেষ্টা। মঙ্গলময় জীবন হলো সেই জীবন, যা প্রেমের দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং বিশুদ্ধ জ্ঞান দ্বারা পরিচালিত। জ্ঞান ব্যতিত প্রেম অথবা, প্রেম ব্যতিত জ্ঞান–এর কোনোটাই মঙ্গলময় জীবন সৃষ্টি করতে পারে না। এতোকিছুর পরও অনেকেই যিশুর কড়া সমালোচনা করেছেন। সব স্তরের মানুষের প্রতি যিশুর অবারিত প্রেমকে জ্ঞানহীন বলে আখ্যায়িত করেছেন যিশুর তথা খ্রিস্ট ধর্মের প্রধান সমালোচক স্যার বার্ট্রাণ্ড রাসেল তার ‘হুয়াই আই অ্যাম নট আ ক্রিশ্চিয়ান’ নামক গ্রন্থে। তিনি যিশুকে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বিবর্জিত বলেছেন। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেছেন, সেই যুগে যখন কোনো দেশে মহামারি উপস্থিত হতো তখন সাধু মানুষরা জনগণকে গির্যায় সমবেত হয়ে উদ্ধার পাবার জন্য প্রার্থনা করতে উপদেশ দিতেন। এর ফল দাঁড়াতো এই যে বিনীতভাবে প্রার্থনাকারীদের ভিড়ে সেই রোগটি অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে আরো অধিক প্রাণহানি ঘটাত। এটিকে রাসেল জ্ঞানহীন প্রেমের নমুনা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মধ্যযুগে এমন ঘটনা ঘটলেও স্বয়ং যিশুই এমন ঘটনার অবতারণা করেছেন এর কোনো বাস্তব দলিল নেই। হ্যাঁ, যিশুর সময় মানুষের বিজ্ঞানের জ্ঞানের অভাব ছিলো। কারণ, বিজ্ঞান তখনও সেভাবে যাত্রা শুরু করেনি। কাজেই যিশুর মতো জ্ঞানীর পক্ষেও দুএকটি অবৈজ্ঞানিক আচরণ করা অসম্ভব কিছু নয়। কুষ্ঠ রোগীদের তিনি নির্ভয়ে সেবা দিয়েছেন এটি যিশুর মানবপ্রেমের একটি অন্যতম নজীর কিন্তু কুষ্ঠ রোগ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান না থাকা সে যুগে দোষের কিছু ছিলো না। তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোগীদের পাশে দাঁড়িয়ে সেবার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন এটিই মানুষের জন্য অনুসরণীয় এবং অনুকরণীয় একটি শিক্ষা। যিশুর দেয়া শিক্ষাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিলো ‘ঘৃণা নয়, প্রেম।‘ ঘৃণার চেয়ে প্রেম অবশ্যই উত্তম কেননা ঘৃণা বিবাদের সৃষ্টি করে আর প্রেম মানুষের মাঝে নিয়ে আসে সংগতি, তারা একসঙ্গে সফল অথবা ব্যর্থ হয়, এতে কারও প্রতি অন্য কারও ক্ষোভের জন্ম হয় না, নিজেদের মধ্যে শান্তি বিরাজমান থাকে।
উল্লেখ্য, খ্রিস্ট ধর্মের উৎপত্তি হয়েছিলো ইহুদি উপজাতিদের ওপর রোমান সাম্রাজ্যের ক্রমাগত নৃশংসতার ফলে। সশস্ত্র প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়ে একদল আধ্যাত্মিক বা পরলোকে মুক্তির সন্ধান খোঁজে। খ্রিষ্ট ধর্মের উৎপত্তি যেভাবেই হোক না কেনো, নেজারাথে যিশুর ভক্তদের প্রথমে খ্রিস্টান নামে অভিহিত করা হয় এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মতো খ্রিস্টানরাও পরবর্তীতে যিশুকে নিয়ে নানান অলৌকিক এবং কিংবদন্তি রচনা করে, যার অধিকাংশেরই ঐতিহাসিক সত্যতা নেই বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। যিশুকে নিয়ে খোদ ভারতীয় উপমহাদেশেও একটি গুরুত্বপূর্ণ কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে। পশ্চিম পাঞ্জাবের মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানি তার ‘মসীহ হিন্দুস্তান মেঁ’ বা ‘জেসাস ইন ইণ্ডিয়া’ বা ‘ভারতে যিশু’ নামক গ্রন্থে বলেন, যিশু ক্রশীয় মৃত্যু থেকে নিষ্কৃতি লাভ করে পালিয়ে এসে আফগানিস্তানে আগমণ এবং পরবর্তীতে কাশ্মীর শ্রীনগরে বসতি স্থাপন করেন এবং সেখানেই তিনি ১২০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। শ্রীনগরে তার কবর এখনো বিদ্যমান (সূত্র: বাঙালির ধর্মচিন্তা-মোহাম্মদ আব্দুল হাই)। কিংবদন্তি যাই প্রচলিত থাকুক না কেনো, মানবতার মুক্তির কল্যাণে, মানবাত্মাকে পাপমুক্তকরণে যিশু যে অবর্ণনীয় যাতনা ভোগ করে, নিজের জীবন উৎসর্গ করে মানবের মাঝে জ্ঞান বিতরণ করে গেছেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। ২৫ ডিসেম্বর যিশুর জন্ম হয়েছিলো বলে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের লোকেরা বিশ্বাস করেন এবং সেইদিনকে তারা বড়দিন হিসেবে পালন করেন। যিশু শুধু খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের জন্য নয়, তিনি কাজ করেছেন মানুষের জন্য, শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে, কাজেই আমরা মানবতার শিক্ষক হিসেবেই তাকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি।
লেখক: যুগ্মপরিচালক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়