ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে খসে যাবে পুরাতন বছর, আসবে নতুন বছর । একটি বছর শেষে যখন আসে নতুন বছর তখন পরম করুণাময় বিধাতার আমাদের কামনা হওয়া উচিত আগামীর দিনগুলো যেনো শুভ ও সুন্দর হয়, পুরাতন বছরের সব গ্লানি ও অপ্রাপ্তি ঝেড়ে ফেলে নবউদ্যমে সন্মুখপানে এগিয়ে যাওয়ার প্রার্থনা হওয়া উচিত।
বাস্তবে আমরা কী দেখি? থার্টিফার্স্ট নাইটের অনুষ্ঠানের নামে রাজধানী ঢাকায় প্রতিবছর যে চিত্র দেখতে পাই, তা সত্যিই লজ্জা ও বেদনাদায়ক। বিশেষ করে ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী ও টিএসসিতে যে হইহুল্লোড় উন্মত্ত উল্লাস, ‘মাদকের হাতে খড়ি’, আতশবাজি, বাদ্য-বাজনা, নাচ-গান, যুবক-যুবতীর ফ্রি স্টাইলে চলাফেরা, ওপেন এয়ার কনসার্ট, লাইভ ড্যান্স, বেলেল্লাপনা আর লাল, নীল, পানীয় পানের যে সমারোহ চলে তাতে করে নতুন বছরের কামনা-বাসনা আর প্রত্যাশার বেদিমূলে ধ্বংসের খড়গ চলে। সংস্কৃতির অর্থ হলো সংস্কার, উন্নয়ন, উৎকর্ষ সাধন, উত্তম বা উন্নত মানের চরিত্র, কর্ষণ, সংশোধন, পরিমার্জন, শুদ্ধীকরণ, সৌন্দর্য প্রকাশ ইত্যাদি।
নোংরামি, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, হইহুল্লোড়, শ্লীলতাহানি ইত্যাদি অপকর্ম সংস্কৃতি নয়। আমরা এখন ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ এর অধিবাসী ও বিশ্ববাসীকে একই এলাকার বাসিন্দা হিসেবে চিহ্নিত করি। গ্লোবাল ভিলেজের যুগে বিশ্ববাসী একই ছাদের নিচের বাসিন্দা হতে গিয়ে যেসব শর্তে ঐকমত্য হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ন উৎসবসমুহ সমস্ত বিশ্ববাসী একসঙ্গে উদযাপন করবে। তবে এক এক দেশের একেক রকম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও আবহ রয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশসমূহের সব উৎসব আমাদের সভ্যতা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে মানানসই নয়।
আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, যেনো বিশ্বের এমন সব উৎসব পালন শুরু করা না হয় যাতে আমাদের নিজস্ব উৎসবের প্রতি মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং বিশ্বের অন্যান্য জাতির সেসব উৎসব আমাদের সমাজে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ না পায়। বিশ্বায়নের যুগেও আমাদেরকে আমাদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও সভ্যতাকে লালন করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। কারণ, একটা দেশের উৎসব অনুষ্ঠান দিয়ে সে দেশের মানুষের সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায়।
নিজেদের বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তা বজায় রেখে আচার অনুষ্ঠান বা উৎসব পালন করা প্রয়োজন। আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে অন্যান্য দেশের যেসব উৎসব যায় না সেগুলোকে এড়িয়ে যেতে হবে এবং দেশবাসীকে এর কুফল সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে।
কোনো জাতির জন্য অন্য দেশের সংস্কৃতিকে অন্ধভাবে অনুসরণকরা সমীচিন নয়। তাই নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্বকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আমাদেরকে সেসব ক্ষতিকর উৎসবকে চিহ্নিত করে বর্জন করতে হবে আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারণ করতে হবে মনে প্রাণে।
থার্টি ফার্স্ট নাইটের ইতিহাস বেশ পুরাতন। ঈসা (আ.) এর জন্মের প্রায় ৪৬ বছর আগে ব্যবিলনের সম্রাট জুলিয়াস সিজার ইংরেজি নববর্ষ পালনের সূচনা করেন। তৎকালীন সময়ের মানুষের মধ্যে অধিকাংশ মানুষ সভ্যতার গণ্ডির বাইরে বাস করার কারণে তাদের দৈনন্দিন জীবন পালনে উচ্ছৃঙ্খলতাই বেশি পরিলক্ষিত হতো । সে উচ্ছৃঙ্খলতা থেকে সময়ের আবর্তে হাজার বছর পরে আজ পৃথিবী নামক গ্রহবাসী অসুস্থ সভ্যতার আলোতে বাস করছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইংরেজি নববর্ষ পালনের দিনটিকে যথেচ্ছা পালন করলেও আমাদের বাংলাদেশ ও আমাদের মতো আরো বেশ কিছু দেশ তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে থার্টি ফার্স্ট নাইটের নামে কোনো উন্মাদ উশৃঙ্খল মানুষের অনুষ্ঠান পালন করা সমীচিন নয়।
সাধারণত খ্রিষ্টাব্দের শেষ মাস ডিসেম্বরের শেষ দিনের অর্ধরাত্র অতিবাহিত হওয়ার পর রাত ১২.০১ মিনিট থেকেই থার্টি ফার্স্ট নাইটের অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়। তবে গ্রিনিচমান সময় অনুযায়ী অস্ট্রেলিয়ার শহর সিডিনিতে সবার প্রথম রাত ১২.০১ মিনিট হয়। সিডনিতে যখন রাত ১২.০১ মিনিট তখন বাংলাদেশে সন্ধ্যা ৭.০১ মিনিট বাজার কারণে অনেকেই থার্টি ফার্স্ট নাইটের প্রথম প্রহর এ সময়ে উদযাপন করেন। বিভিন্ন দেশে থার্টি ফার্স্ট নাইটকে বিভিন্ন নামে নামকরণ করা হয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হল, ‘থার্টি ওয়ান ফার্স্ট নাইট’, ‘থার্টি ফার্স্ট ডিসেম্বর’ অথবা ‘মাদকের হাতে খড়ি’ দিবস হিসেবে অভিহিত করেছেন। নাম যাই হোক এ দিবসের উদ্দেশ্য আমাদের দেশের সঙ্গে মানানসই নয়।
রাজধানীসহ বড় বড় শহরগুলোর অভিজাত ক্লাবগুলোসহ বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট, আবাসিক হোটেল এবং কিছু বাসায় রাতভর বসে অসামাজিক কর্মকাণ্ডের পসরা। তরুণ-তরুণীদের ধ্বংস করা জন্য যা চাই তার সবটার রসদ এ সব অনুষ্ঠানে পাওয়া যায়। এ রাত উদযাপন করতে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকমের নিজস্ব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালন করে। গায়ে পানি ছিটানো থাইল্যান্ডের উৎসব, আঙুর খাওয়া স্পেনের উৎসব, এ রাতে না ঘুমানো কোরীয়দের উৎসব, ১২টি ঘণ্টা বাজানো মেক্সিকোর উৎসব, শিক্ষকদের কাছে দীর্ঘায়ু কামানা করা ভিয়েতনামের উৎসব, পরিবারের সব সদস্যরা একসঙ্গে আহার করা আর্জেন্টিনার উৎসব এবং সাদা পোশাক পরিধান করা ব্রাজিলীয়দের উৎসব।
আমাদের দেশে থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন করার নামে আয়োজন করা হয় গান-বাজনা, নাচ-গান, ডিস্কো বা ডিজে (উলঙ্গ নৃত্য), পটকাবাজি, আতশবাজি, বেপরোয়া মটসাইকেল চালনা, আনন্দ শোভা যাত্রা, তরুণ-তরুণীদের রাত ভর উল্লাস, মদ-বিয়ারসহ ননা মাদকদ্রব্য সেবনে প্রলুব্ধ করতে ওপেন এয়ার কনসার্ট, লাইভ ড্যান্স, বিদেশি সংগীতানুষ্ঠান এবং এমন সব অপসংস্কৃতির আয়োজন যা তরুণ-তরুণীদেরকে বিভিন্ন অপকর্ম করতে প্রলুব্ধ করে, সমাজেকে উচ্ছন্নের পথে একধাপ এগিয়ে দেয়। ‘আমাদের দেশের যেসব শিক্ষার্থী ও তরুণ-তরুণীরা আগামী বাংলাদেশের কর্ণধার হবে তারা যদি এমন বিপথগামী হয়ে পড়ে তবে দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আমাদের দেশের ভবিষ্যতের স্বার্থে অভিভাবকদেরকে সচেতন হতে হবে। দেশি সংস্কৃতিকে ভুলে বিজাতীয় সংস্কৃতি গ্রহণ করতে গিয়ে আমরা যেনো অসভ্য না হই।
আমাদের নিজেদের ঐতিহ্য, সভ্যতা এবং সংস্কৃতি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সংস্কৃতি। সুতরাং বিদেশি সংস্কৃতির পিছে না ছুটে আমাদের সংস্কৃতিকে শক্তভাবে ধারণ এবং পালন করি। তাতে আমরা যেমন উপকৃত হবো তেমনি আমাদের দেশটাও বিশ্বের দরবারে নিজস্ব পরিচিতি নিয়ে পরিচিত হবে। নতুন বছরের প্রাক্কালে শুভেচ্ছা বিনিময় সুস্থ সংস্কৃতির অংশ। বছরের প্রথম দিনে ফূর্তি করা দোষের নয়। দোষ তখনই ঘটে যখন দেখা যায়, বিভিন্ন স্থানে চলে কনসার্টের নামে তারুণ্যের বাঁধভাঙা উন্মাদনা, নগ্নতা, বেহায়াপনা। এর থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
সুস্থ বিনোদনের মাধ্যমে, অন্যের অসুবিধা না করে, রাত জেগে উন্মত্ততার খোলস থেকে বেরিয়ে এসে মার্জিত আনন্দ আয়োজনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত অনুষ্ঠান করা যেতে পারে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে নেতিবাচক কাজ থেকে বিরত থেকে ইতিবাচক কাজের মাধ্যমে সমাজ ও দেশকে এগিয়ে নিতে পারে সেজন্য সরকার ও জনগণকে সচেতনতার পরিচয় দিতে হবে। অভিভাবকদেরও দায়িত্ব রয়েছে তার ছেলে মেয়ে যাতে অপসংস্কৃতির জোয়ারে গা ভাসিয়ে না দেয় সেদিকে খেয়াল রাখা। নতুন বছর আসুক আগামীর নব সম্ভাবনার পসরা সাজিয়ে । নতুন বছর হোক মহামারি ও যুদ্ধমুক্ত।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ