ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০২ জানুয়ারি ২০২৫ , ১৮ পৌষ ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

বাংলাদেশ ও আধুনিক বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থা

মতামত

মাহবুবুর রহমান, আমাদের বার্তা

প্রকাশিত: ০৮:৩০, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪

আপডেট: ১৬:৪৪, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪

সর্বশেষ

বাংলাদেশ ও আধুনিক বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থা

শিক্ষা একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান শক্তি, যা ব্যক্তি ও জাতির উন্নয়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে পরিবর্তনের মধ্যে থাকলেও এটি এখনও অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। অন্যদিকে, আধুনিক বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থা ক্রমাগত উদ্ভাবনী ধারণা, প্রযুক্তি ও বাস্তবমুখী পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে এগিয়ে চলেছে। এই প্রবন্ধে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এবং আধুনিক বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থার বিশদ তুলনামূলক আলোচনা উপস্থাপন করা হবে।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার চিত্র

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা মূলত তিনটি স্তরে বিভক্ত:

১. প্রাথমিক শিক্ষা (১ম থেকে ৫ম শ্রেণি):

বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক এবং এতে ভর্তির হার সন্তোষজনক। সরকারি উদ্যোগে বিনামূল্যে বই বিতরণ ও উপবৃত্তির ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের স্কুলে ধরে রাখতে সহায়তা করছে। তবে গ্রামীণ এলাকায় স্কুলে উপস্থিতির হার এবং মান নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।

২. মাধ্যমিক শিক্ষা (৬ষ্ঠ থেকে ১২শ শ্রেণি):

মাধ্যমিক পর্যায়ে পরীক্ষার চাপ অত্যাধিক। এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের জীবনে বড় ভূমিকা রাখে। তবে এই পরীক্ষা পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল চিন্তা এবং বিশ্লেষণধর্মী শিক্ষার বিকাশে প্রতিবন্ধক।

৩. উচ্চশিক্ষা:

উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রধান ভরসা। তবে, শিক্ষার গুণগত মান, গবেষণার সুযোগের অভাব এবং প্রযুক্তি ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা এখনও উচ্চশিক্ষায় বড় চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান সমস্যা:

১. পরীক্ষাকেন্দ্রিক পদ্ধতি: সৃজনশীলতার চেয়ে মুখস্থবিদ্যার ওপর নির্ভরতা। ২. শিক্ষকের প্রশিক্ষণ ঘাটতি: শিক্ষকরা অনেক ক্ষেত্রেই আধুনিক পাঠদান পদ্ধতিতে দক্ষ নন। ৩. অপর্যাপ্ত অবকাঠামো: গ্রামীণ অঞ্চলে স্কুলের অবস্থা এবং শিক্ষার সুযোগ সীমিত। ৪. গবেষণার অভাব: উচ্চশিক্ষায় গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট এবং সুযোগ নেই।

আধুনিক বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থা:

আধুনিক বিশ্বের শিক্ষা ব্যবস্থা উদ্ভাবনী, বাস্তবমুখী, এবং প্রযুক্তি নির্ভর। এই ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য শিক্ষার্থীদের দক্ষ, সৃজনশীল, এবং স্বাধীন চিন্তাবিদ হিসেবে গড়ে তোলা। উদাহরণস্বরূপ, উন্নত দেশগুলোর শিক্ষাব্যবস্থা:

১. ফিনল্যান্ড: পরীক্ষার পরিবর্তে সৃজনশীল প্রকল্প ও সমস্যা সমাধান পদ্ধতির ওপর জোর দেয়া হয়। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়।

২. জাপান: স্কুলে নৈতিক শিক্ষা এবং শৃঙ্খলা শিক্ষার ওপর গুরুত্ব। প্রযুক্তি ব্যবহারে অগ্রণী ভূমিকা।

৩. যুক্তরাষ্ট্র: STEM (Science, Technology, Engineering, Math) শিক্ষায় অগ্রাধিকার। অনলাইন শিক্ষা, মিশ্র শিক্ষণ (blended learning) এবং গবেষণা।

৪. জার্মানি: দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা। শিক্ষার্থীদের পেশাজীবনের জন্য প্রাথমিক স্তর থেকেই প্রস্তুত করা হয়।

আধুনিক বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য

শিক্ষা একটি জাতির উন্নয়ন ও সভ্যতার অগ্রগতির মূল শক্তি। একবিংশ শতাব্দীতে শিক্ষার ধারায় বিশাল পরিবর্তন এসেছে। প্রযুক্তি, উদ্ভাবন, এবং শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক পদ্ধতির মাধ্যমে আধুনিক বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থা এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এটি শুধু জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম নয়, বরং দক্ষতা উন্নয়ন, সৃজনশীলতা বৃদ্ধি, এবং বাস্তব জীবনের সমস্যার সমাধানে শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করার একটি কার্যকর উপায়।

১. শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক পদ্ধতি: আধুনিক বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন এবং দক্ষতার ওপর গুরুত্বারোপ করে।

ব্যক্তিগতকরণ: প্রতিটি শিক্ষার্থীর স্বতন্ত্রতা স্বীকার করে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী পাঠদান করা হয়।

সমান সুযোগ: শারীরিক, মানসিক বা আর্থিক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও প্রতিটি শিক্ষার্থী সমান শিক্ষার সুযোগ পায়।

সক্রিয় অংশগ্রহণ: শিক্ষার্থীরা ক্লাসে কেবল শ্রোতা নয়; তারা সক্রিয়ভাবে প্রশ্ন করে, বিতর্কে অংশ নেয়, এবং সমস্যার সমাধান খোঁজে।

২. প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা: প্রযুক্তি আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। ডিজিটাল ক্লাসরুম: ইন্টারঅ্যাকটিভ স্মার্ট বোর্ড, ভার্চুয়াল ল্যাব, এবং অনলাইন শিক্ষার মাধ্যম ব্যবহৃত হয়। অনলাইন শিক্ষা ও মিশ্র পদ্ধতি: শিক্ষার্থীরা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে নিজের মতো করে শেখার সুযোগ পায়।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: শিক্ষার্থীদের শেখার পদ্ধতি বিশ্লেষণ করে তাদের জন্য সেরা শিক্ষাক্রম নির্ধারণ করা হয়।

ভার্চুয়াল রিয়ালিটি এবং অগমেন্টেড রিয়ালিটি: বিজ্ঞান, ইতিহাস এবং প্রকৌশল শিক্ষায় বাস্তবমুখী অভিজ্ঞতা প্রদান করে।

৩. উদ্ভাবনী শিক্ষাক্রম: আধুনিক বিশ্বে শিক্ষাক্রম তৈরি করা হয় শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য।

STEM শিক্ষা: বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিতের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। কৌশলভিত্তিক শিক্ষা (Project-Based Learning): শিক্ষার্থীরা প্রকল্প তৈরি করে বাস্তব জীবনের সমস্যার সমাধান শিখে। সমস্যাভিত্তিক শিক্ষা (Problem-Based Learning): শিক্ষার্থীদের বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধানের জন্য তৈরি করা হয়। বহুমুখী শিক্ষা: ভাষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বিভিন্ন বিষয় শিখতে উৎসাহ দেয়া হয়।

৪. গবেষণাভিত্তিক শিক্ষা: গবেষণা আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শিক্ষার্থীদের গবেষণার দক্ষতা বাড়াতে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাগার এবং অনুদান প্রদান করা হয়। উদ্ভাবনী গবেষণার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক এবং সামাজিক সমস্যার সমাধানে ভূমিকা রাখে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা করে গবেষণার সুযোগ প্রসারিত করা হয়।

৫. সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষা: আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা শুধু একাডেমিক জ্ঞান নয়, নৈতিকতা, সামাজিক মূল্যবোধ এবং মানসিক স্বাস্থ্যেও গুরুত্ব দেয়। নৈতিক শিক্ষা: শিক্ষার্থীদের মানবিক মূল্যবোধ, পরিবেশ সচেতনতা এবং সহনশীলতার ওপর শিক্ষা দেওয়া হয়। মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন: শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে পরামর্শদাতা এবং মানসিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করা হয়। বহুসংস্কৃতি শিক্ষা: বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করা হয়।

৬. দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা: শুধু পঠন-পাঠন নয়, আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন জীবনমুখী দক্ষতা অর্জনের সুযোগ দেয়। যোগাযোগ দক্ষতা: শিক্ষার্থীদের যোগাযোগের দক্ষতা বাড়াতে ভাষা এবং উপস্থাপনা শেখানো হয়। সমস্যা সমাধানের দক্ষতা: শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবনের সমস্যাগুলোর সৃজনশীল সমাধান শেখে। টিমওয়ার্ক ও নেতৃত্ব: দলগত কাজের মাধ্যমে নেতৃত্বের গুণাবলি এবং সহযোগিতা শেখানো হয়।

৭. মূল্যায়নের আধুনিক পদ্ধতি: আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের পরিবর্তে তাদের সামগ্রিক উন্নয়ন মূল্যায়ন করা হয়। কাজের ভিত্তিক মূল্যায়ন: শিক্ষার্থীদের প্রকল্প, উপস্থাপনা এবং দলগত কাজের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হয়। সফট স্কিল মূল্যায়ন: সমস্যা সমাধান, সময় ব্যবস্থাপনা, এবং নেতৃত্বের গুণাবলিও মূল্যায়নের অংশ। স্বতন্ত্র মূল্যায়ন: প্রতিটি শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত উন্নয়ন এবং দক্ষতা বিবেচনায় নেয়া হয়।

৮. গ্লোবালাইজড শিক্ষা: আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনে সহায়তা করে। বহুমুখী শিক্ষা: আন্তর্জাতিক আদর্শ এবং জ্ঞানের বিনিময়ের সুযোগ। অনলাইন কোর্স: শিক্ষার্থীরা বিশ্বের যেকোনো দেশ থেকে আন্তর্জাতিক কোর্স করতে পারে। বিদেশি ভাষা শিক্ষা: শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন বিদেশি ভাষা শেখার সুযোগ।

তুলনামূলক বিশ্লেষণ

বাংলাদেশে শিক্ষার চ্যালেঞ্জ

১. মানসম্পন্ন শিক্ষা: শিক্ষার মানের ঘাটতি বাংলাদেশের অন্যতম বড় সমস্যা। আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষার জন্য যে ধরনের আধুনিক পদ্ধতি এবং প্রশিক্ষণের প্রয়োজন, তা এখনও অধিকাংশ ক্ষেত্রে নেই।

২. প্রযুক্তির অভাব: ডিজিটাল অবকাঠামো এখনও যথেষ্ট পরিমাণে গ্রামাঞ্চলে পৌঁছেনি। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইন্টারনেট বা কম্পিউটার সুবিধা নেই।

৩. শিক্ষক উন্নয়ন: শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং আধুনিক পাঠদান পদ্ধতিতে তাদের প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে।

৪. বাজেটের সীমাবদ্ধতা: শিক্ষাখাতে বাজেট বরাদ্দ তুলনামূলকভাবে কম, যা উন্নত অবকাঠামো তৈরিতে বাধা সৃষ্টি করে।

আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে সমতা আনতে করণীয়

১. প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রসার: ডিজিটাল শিক্ষা নিশ্চিত করতে প্রতিটি স্কুলে ইন্টারনেট ও প্রযুক্তি সরঞ্জাম সরবরাহ করতে হবে।

২. শিক্ষাক্রম আধুনিকায়ন: সৃজনশীল চিন্তা, উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং বাস্তব জীবনভিত্তিক দক্ষতা বাড়ানোর জন্য শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন আনতে হবে।

৩. শিক্ষকের উন্নয়ন: শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম চালু করতে হবে, যা তাদের আন্তর্জাতিক মানের পাঠদান পদ্ধতি আয়ত্তে সহায়তা করবে।

৪. গবেষণার ওপর জোর: বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণার জন্য বাজেট বরাদ্দ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সুযোগ তৈরি করতে হবে।

৫. অর্থায়ন বৃদ্ধি: শিক্ষাখাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশ এবং আধুনিক বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। শিক্ষা খাতে প্রযুক্তি, উদ্ভাবন এবং গবেষণার ওপর জোর দিয়ে আমরা আধুনিক বিশ্বের সাথে প্রতিযোগিতা করতে পারি। বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়ন কেবলমাত্র জাতীয় উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে না, বরং বিশ্বব্যাপী একটি প্রগতিশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে সাহায্য করবে।

লেখক: পিএইচডি গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

জনপ্রিয়