যেকোনো উন্নত জাতির ইতিহাস বলে দেয় তাদের উন্নতির নেপথ্যের কারণ বিশেষ কোনো যাদুমন্ত্র নয় বরং উপযুক্ত শিক্ষা ও শ্রমই তাদের একমাত্র যাদুরকাঠি। অন্ধ ও অক্ষরজ্ঞানহীন–এ দুটোর ফারাক অতি অল্পই। বাঁচার মতো বেঁচে থাকার জন্য, মানুষের মতো মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে চোখের ও মনের আলো–এ দুই-ই অতি আবশ্যক।
যে দেশের অধিকাংশ লোকই অশিক্ষিত, বিপুল জনগোষ্ঠী যেখানে অশিক্ষা ও অজ্ঞতার আলোকে হাবুডুবু খাচ্ছে সেখানে সামগ্রিক কল্যাণ একেবারেই অসম্ভব। দার্শনিকদের ভাষায়, জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট আর মুক্তি সেখানে অসম্ভব। নারী-পুরুষ, ধর্ম, বর্ণ ও বয়স নির্বিশেষে সবার জন্য সর্বজনীন শিক্ষা নিশ্চিত করাকেই আমরা গণশিক্ষা বলছি এবং এ শিক্ষা শুধু সাক্ষরতা অর্জন নয় বরং মানসম্পন্ন এবং বাস্তব জীবনে প্রায়োগিক হতে হবে।
শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধু সনদ অর্জন নয়, শিক্ষিত ব্যক্তিটি যখন ভালোমন্দ বুঝতে সক্ষম হবে, নিজের ও জাতির সমস্যা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করবে এবং সমস্যা সমাধানে প্রয়াসী হয়ে দক্ষতার সঙ্গে ওই সমস্যাসমূহ মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে, তখনই তাকে যথার্থ শিক্ষিত নাগরিক বলা যাবে।
প্রায়োগিক গণশিক্ষা বলতে আমরা সেই শিক্ষার প্রতি ইঙ্গিত করছি যে শিক্ষা মানুষকে আত্মকেন্দ্রিক চিন্তায় মগ্ন না রেখে দেশের সামগ্রিক চিন্তায় লিপ্ত রাখে, মানবতার মুক্তির বিষয়ে সজাগ রাখে এবং তাকে কল্যাণমুখী কর্মে ধাবমান হতে উৎসাহিত করে।
শিক্ষায় অর্থনৈতিক ও আত্মিক মুক্তি: কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত একটি জনগোষ্ঠীই পারে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া জমিদার শ্রেণির মুষ্টিমেয় কয়েকজন অশিক্ষিত ব্যক্তি হয়ত পারিবারিক পর্যায়ে আর্থিকভাবে সচ্ছল জীবনযাপনে সক্ষম কিন্তু সমাজ তথা দেশের সার্বিক উন্নয়নে তাদের কোনো অবদান নেই। এ ক্ষেত্রে গণশিক্ষার ভূমিকা অনস্বীকার্য।
একজন অশিক্ষিত মানুষ নিদ্রা যাপন, প্রাকৃতিক প্রয়োজন মেটান ও জৈবিক চাহিদা উপভোগ করা ছাড়া জীবনের আর কোনো অর্থ খুঁজে পায় না। এরা সামান্যতেই দুঃখভারাক্রান্ত হয়, আবেগে ভেঙে পড়ে কিন্তু যথার্থ শিক্ষিত ব্যক্তি জানেন জীবনকে কীভাবে সংগ্রামী করে তুলতে হয়, সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয় ও সীমিত সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার করে জীবনকে নানাভাবে উপভোগ্য করে জীবনকে অর্থবহ করে তুলতে হয়।
তারা মৃত্যুকে পর্যন্ত ভয় পান না বরং মৃত্যুকে স্বাভাবিক, অনিবার্য একটি প্রক্রিয়া হিসেবে মেনে নিয়ে মৃত্যুর জন্যও সবসময় নিজেকে তৈরি রাখেন এবং সে অনুযায়ী আহরিত সম্পদের সর্বোচ্চ সুষ্ঠু ও সময়োপযোগী ব্যবহারে সচেতন থাকেন। প্রতিটি শিক্ষিত মানুষ সাধারণ মানসিক ক্ষমতার সঙ্গে কিছু না কিছু বিশেষ মানসিক শক্তি অর্জন করে যা তাকে প্রতিটি কাজ সুষ্ঠুভাবে সমাধানে সাহায্য করে। আর্থিক সচ্ছলতা ও শারীরিক সুস্থতার সঙ্গে যে আত্মার শান্তি দরকার তা শুধুই একজন শিক্ষিত মানুষই অনুধাবন করতে সক্ষম। অস্বীকার করবার উপায় নেই, শিক্ষা মানুষের আত্মসচেতনতা বাড়িয়ে দেয়, মানুষের মধ্যে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করে, অভ্যাস ও রীতিনীতিকে বদলে দিয়ে মানুষকে সৃজনশীল মানুষে রূপান্তরিত করে।
মানবসভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় শিক্ষা অর্জনের আগে ও পরে মানুষের কী কী ভাবে পরিবর্তন সূচিত হয়েছিলো। একজন শিক্ষিত নাগরিক যোগাযোগ স্থাপনে অধিকতর ক্ষমতার অধিকারী, সচেতনতায় তীক্ষ্ণধী ও পরিবেশের ওপর অধিক নিয়ন্ত্রণের অধিকারী। একজন শিক্ষিত মানুষ আবেগ ও সংস্কারমুক্ত মন নিয়ে স্বচ্ছ চিন্তা করতে শেখেন ও অন্যকে শেখান। এর দ্বারা তারা উভয়েই আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে সঠিক কর্মপন্থা উদ্ভাবন ও সুচিন্তিত পরিকল্পনা প্রণয়নে সক্ষম হন। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি উদার ও গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠে। বলার অপেক্ষা রাখে না, একজন শিক্ষিত ব্যক্তির চিন্তা ও বিচার-বিশ্লেষণ, আত্মমূল্যায়ন ও সংশোধন, কর্মজীবনের কর্মসম্পাদন ও কর্মসূচি গ্রহণের ক্ষমতা অন্য একজন নিরক্ষর ব্যক্তির চেয়ে ঢের বেশি।
বাংলাদেশ ও গণশিক্ষা: অন্যান্য দেশের সঙ্গে শিক্ষা বিষয়ে আমাদের নিজেদের তুলনা করতে যাওয়া একদম বোকামি। শিক্ষার দিক থেকে আমরা শুধু পিছিয়ে নেই বরং আমাদের অবস্থান সর্বনিম্ন স্তরে বললে অত্যুক্তি হয় না। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশে আধুনিক যুগে এসে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী মূর্খ ও নিরক্ষর থাকবে এটি মেনে নিতে কষ্ট হলেও না মেনে আমাদের উপায় নেই, যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক, লজ্জাজনক, একই সঙ্গে পীড়াদায়ক।
এ পিছিয়ে থাকার পেছনে ব্রিটিশ বা পাকিস্তানিদের দোষারোপ করবার সময়ও অতিক্রান্ত হয়ে গেছে অনেক বছর আগেই কেনো না এই মুহূর্তে আমাদের স্বাধীনতা লাভের ৫৪ বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে। অতএব, ব্যর্থতার দায়ভার শুধুই আমাদের, অন্য কারো নয়। অশিক্ষা এবং কুশিক্ষার কারণেই যে আমরা আধুনিক বিশ্ব থেকে অনেকখানি পিছিয়ে আছি এ কথা বুঝতেও আমাদের আর সমস্যা হবার কথা নয়।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তরান্বিত, টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদি করার ক্ষেত্রে দক্ষ মানবসম্পদের বিকল্প নেই। অর্থসম্পদ ও ভৌত অবকাঠামো থাকা সত্ত্বেও যদি মানবসম্পদের দুষ্প্রাপ্যতা থাকে তবে সে ক্ষেত্রে সার্বিক উন্নয়নের প্রক্রিয়া ও গতি মন্থর হয়ে পড়ে।
কাজেই কর্মমুখী গণশিক্ষার সমস্যা নিয়ে আলোচনা, পর্যালোচনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও পদক্ষেপ নিতে কালবিলম্ব হলে অপূরণীয় ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের সামনে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়ে সবার জন্য উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সর্বাগ্রে দেশের সব নাগরিককে যথোপযুক্ত কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের অবস্থান শক্ত করে, সুদৃঢ়ভাবে ধরে রাখা। শুধু তাই নয়, একটি শিক্ষিত জাতি হিসেবে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন মোকাবিলা করে নিজস্ব সংস্কৃতির বিকাশ ও উন্নয়ন ঘটিয়ে জাতিকে সংস্কৃতিমান করে তোলা। একটি উন্নত সংস্কৃতি বিশ্বের দরবারে জাতিকে বিশেষভাবে পরিচিত করতে সহায়তা করে। এ সবকিছুর পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য যা জরুরি, তা হলো সরকার কর্তৃক একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ, যার লক্ষ্য হবে যেকোনো মূল্যে নিরক্ষর জাতিকে সাক্ষরতা জ্ঞান, কর্মদক্ষতা অর্জন ও উৎপাদনমুখী কর্মে উদবুদ্ধ করে প্রতিটি নাগরিককে আত্মনির্ভরশীল ও সাংস্কৃতিক মননশীল করে গড়ে তোলা।
উন্নয়নশীল বিশ্বের গতিশীলতার সঙ্গে নাগরিকদের পরিচয় করিয়ে তাদের বিবেক ও বুদ্ধির বিকাশ ঘটাতে হবে ও বিভিন্ন পেশা, বৃত্তিমূলক কাজ, কৃষি উন্নয়ন, সমাজকল্যাণ ও আর্থিক সচ্ছলতা অনুযায়ী সুখী জীবনযাপনে সক্ষম করে তুলতে হবে। জনগণকে শিক্ষার মাধ্যমে তাদের মধ্যে জ্ঞান, শক্তি, সহনশীলতা ও মানবীয় গুণের স্ফুরণ ঘটিয়ে নিজেদের অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে।
একুশ শতকের তথ্যপ্রযুক্তি আর বিশ্বায়নের চরম বিকাশের এ যুগে সকল প্রকার উন্নয়ন আর অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি হলো শিক্ষা। যেমন-তেমন শিক্ষা নয় গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা। শুধু কুয়ান্টিটি বা সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি নয়, প্রয়োজন সবার জন্য কুয়ালিটি এডুকেইশন নিশ্চিত করা। আমাদের শিক্ষার্থীরা যখন হার্ভার্ড, এমআইটি, অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সহজেই কথা বলতে পারবে, ভাব বিনিময় করতে সক্ষম হবে তখন বুঝতে হবে তারা কুয়ালিটি এডুকেইশন গ্রহণে সক্ষম হয়েছে।
আশার কথা, ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রনালয় এ বিষয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে এবং কাজ শুরু করেছে। বিভিন্ন দেশি-বিদেশি এনজিও তাদের শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় গণশিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে । এ বিষয়ে ব্র্যাক অত্যন্ত কার্যকরী ভুমিকা পালন করে চলেছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। ফরমাল ও নন-ফরমাল মিলে প্রায় শতাধিক শিক্ষা প্রোগ্রামের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়টি বিশাল একটি অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত করবার এক মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে এবং তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সামনে এগিয়ে চলেছে। তবে উল্লিখিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের শিক্ষার মান নিয়ে প্রায়ই প্রশ্ন উঠছে ও প্রশ্ন ওঠাটাই খুব স্বাভাবিক। কারণ, কোয়ালিটি এডুকেইশন নিশ্চিত করতে যেসব অতি প্রয়োজনীয় উপাদান থাকা আবশ্যক, যেমন- প্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামো, যথেষ্ট সরকারি অনুদান, পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক মানসম্পন্ন শিক্ষক-এর সব কটির ঘাটতি রয়েছে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। তবে ক্রমশই অবস্থার উন্নতি ঘটছে। আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দূর হবে, দেশে অশিক্ষিত নাগরিকের সংখ্যা শূন্যের কোটায় নেমে আসবে এবং অতি দ্রুতই বাংলাদেশিরা একটি উন্নত, শিক্ষিত জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশে সক্ষম হবে।
লেখক: যুগ্মপরিচালক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়