অবিনশ্বর ধরিত্রীতে ক্ষুদ্র মানবজীবনে পাওয়া-নাপাওয়ার হিসাব-নিকাশের মেলায় দাসত্বহীন সময় বয়ে চলে নিরবধি পুরনো অ্যালবাম থেকে নবীনত্বের পানে। প্রতিটি বছর যুগ যুগ ধরে অচেনা পথিক হয়ে পালাবদল করে থাকে তার পথচলা। আনন্দ-বেদনা, আশা-নিরাশা, সুখ-দুঃখ, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, সাফল্য-ব্যর্থতা এই পথচলার ক্ষণিক কালের সঙ্গী হয়ে থাকে। এই পূর্ণতা-অপূর্ণতার জগতে মানুষ আত্মতুষ্টির জন্য জীবনকে আগলে রাখতে শূন্যতা, ক্লান্তি, হতাশা, জরাজীর্ণতাকে মুছে স্বপ্ন, প্রত্যাশা, উদ্দীপনা, ও নবীনত্বের পূজারী হয়ে ছুটে চলছে শতাব্দী থেকে শতাব্দীতে। বাংলা নববর্ষ বরণের মতোই ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দকে বরণে বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষের হৃদয় মন্দিরে রয়েছে বিচিত্র রকমের কল্পনার আশ। তাদের মাঝে বইছে পুরনো অপ্রত্যাশিত স্মৃতির বিসর্জন দিয়ে নানান রঙিন স্মৃতির দেয়াল গড়ার মনোবাসনা। এই ভুবনে অক্ষয় থাকুক সকলের রঙিন স্মৃতি গড়ার প্রত্যাশা, দূরীভূত হোক অমঙ্গলকর শক্তি।
নববর্ষ বলতে নতুন বছর বা বছরাম্ভকে বোঝায়। বিশ্বের সব দেশ এবং জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে নববর্ষ পালনের রীতি বিরাজমান। বর্ষবরণ উৎসব মনুষ্য জাতির প্রাচীন ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির ধারক হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে। বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বেশি দেশে প্রচলিত অব্দ হলো এই খ্রিষ্টাব্দ। ৫৩০ খ্রিষ্টাব্দে দিউনিসউথ প্রথম এই অব্দের প্রচলন করেন। তখন ২৫ ডিসেম্বর থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত (খ্রিষ্টাব্দে) বছরের প্রথম দিনটি পড়ত। আধুনিক গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ও জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে জানুয়ারির ১ তারিখ থেকে শুরু হয় নতুন বছর। তবে খ্রিষ্টীয় নতুন বছর উদযাপনের ধারণাটি আসে প্রায় ৪ হাজার বছর আগে, অর্থাৎ খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ অব্দে। তখন মেসোপটেমিয় (বর্তমান ইরাক) সভ্যতার জনগণ প্রথম নতুন বছর উদযাপন শুরু করে।
নতুন বছরের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা-প্রতিটি মুহূর্ত আনন্দ, সুখ, আন্তরিকতা, সহযোগিতার ধারায় উজ্জীবিত হোক। এই প্রার্থনা অতীতের দুর্দশা, অকৃতকার্যতা, অন্যায়, পাপকে মুক্তি দিয়ে ভিন্নরূপে বিশ্বকে ভোরের সূর্যের আলোর ন্যায় আলোকিত করে তুলুক। জীবন পরিচালিত হোক স্বপ্নজয়, উন্নয়ন, জাতীয়তাবোধ, মূল্যবোধের মতো ধারা অব্যাহত রাখার তরে। মানবজাতি নতুন বছরে বিশ্ব পরিস্থিতি প্রেক্ষিতে গতবছরের জঞ্জাল মুক্তিদান এবং পৃথিবী শান্ত ও সুস্থ, মানব সম্পদ উন্নয়ন, শিক্ষার বিকাশ, অশুভ শক্তির বিনাশ, রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গতিশীলতা এবং সমাজের অগ্রগতি ও প্রগতির ক্ষেত্রগুলোতে সংকল্পবদ্ধ হোক। পৃথিবীর প্রতিটি স্থান হোক মানবজাতির জন্য কল্যাণময়, সময় হোক সুখময় এবং সম্পর্ক হোক অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারায়। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে খ্রিষ্টীয় নতুন বছরের ছোঁয়া ও সুভাষ ছড়িয়ে পড়ুক প্রতিটি হৃদয়ে। এই আর্জি যুগ যুগ ধরে, প্রতিটি বছর জুড়ে: আশা, চাওয়া, পাওয়া, প্রত্যাশার দেয়ালের স্মৃতির স্মারক হয়ে থাক।
আমার ভয় হয়, আমাদের বর্তমান প্রজন্মের অত্যাধুনিকতার লালনকে নিয়ে। আমরা বাংলা নববর্ষ পালনের প্রতি এতোটা উপচে পড়ি না, যতোটা খ্রিষ্টীয় নববর্ষের ছোঁয়ার পানে ছুটে চলি। আমরা দিন দিন পশ্চিমা বিশ্বের খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, চিন্তাভাবনা আগলে রাখার প্রয়াস করে যাচ্ছি। ফলশ্রুতিতে, আমাদের বাঙালি জাতির যে স্বতন্ত্র আদর্শ, মূল্যবোধ, জাতীয়তাবোধ, ঐতিহ্য, ইতিহাস রয়েছে তা মুছে যাবার পানে নুয়ে পড়ছে। আমাদের উচিত চিন্তা-চেতনার বিকাশ ঘটিয়ে তরুণ প্রজন্মকে সচেতন করা, তা না হলে বাঙালি জাতির সংস্কৃতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। যে জাতির সংস্কৃতি ছিন্নভিন্ন হবে, সে জাতির ধ্বংসও অনিবার্য। কারণ, সংস্কৃতি জাতির মেরুদণ্ড।
জীবনের সমস্ত টানাপোড়েন এবং যুক্তি-তর্কের ঊর্ধ্বে গিয়ে খ্রিষ্টীয় নতুন বছর উদযাপনে নেতিবাচক কর্মকাণ্ড পরিহার হোক, ইতিবাচক দৃষ্টি থাকুক প্রতিটি কর্মে। আসুন আমরা নতুন বছরের প্রতিটি মুহূর্ত সততা, পরিশ্রম, উদারতা এবং আন্তরিকতার মন-মানসিকতা নিয়ে বাঙালি জাতির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য, বৈষম্যহীন সমাজ, বিবেদহীন জাতি, প্রগতিশীল তরুণ প্রজন্ম, রাষ্ট্রের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সমৃদ্ধিশীল অর্থনীতি গঠনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সংকল্পে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। বর্ষবরণ উৎসব চলুক জীবনের প্রতিটি মুহূর্ততে। দেশপ্রেম জাগ্রত হোক হৃদয়ে, নিপাত যাক অপশক্তি।
(মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন)
লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ