দেশে শিক্ষার কোনো স্তরই সন্তোষজনক অবস্থায় নেই। গ্লোবাল ভিলেজের নাগরিক হিসেবে শিক্ষার্থীদের যে যোগ্যতা অর্জন করার কথা, যে কারিকুলাম অনুসরণ করার কথা সেটি মহা তালগোলের মধ্যে দিয়ে চলছে। রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে প্রথম থেকে উচ্চ মাধ্যমিকের কারিকুলাম নির্মিত হয় এবং সে অনুযায়ী বই, পড়াশোনা, শিক্ষকদের উন্নয়ন ইত্যাদি কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় এর প্রতিটি ধাপে মহাঝামেলা বেধে আছে গত কয়েক বছর ধরে।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে ধরে নেয়া হয় এগুলো স্বায়ত্তশাসিত অর্থাৎ প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় দেশ, চাহিদা ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় নিয়ে নিজ নিজ কারিকুলাম অনুসরণ করবে, উচ্চশিক্ষায় আগত শিক্ষার্থীদের সঠিক মানবসম্পদে পরিণত করবে।
এসব প্রতিষ্ঠান থেকে যারা বের হবেন তারা সঠিক গুণসম্পন্ন, ব্যত্তিত্বসম্পন্ন, নেতৃত্বের গুণাবলিসহ সব মানবিক গুণাবলি অর্জনের মাধ্যমে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও গোটা বিশ্ব ও মানবতার জন্য এক বিশেষ সম্পদে পরিণত হবে।
কিন্তু এর প্রতিটি জায়গাতে লেগে আছে সংকট। বিষয়গুলো নিয়ে দেশে প্রথমবারের মতো সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হলো ‘উচ্চশিক্ষা সম্মেলন’। তবে এই সম্মেলনে যারা যোগদান করেছেন এবং সাংবাদিকদের কাছ থেকে জানতে পারলাম, সম্মেলনের মূলধারা যেমন লিখিত পেপার উপস্থাপন জাতীয় কিছু হয়নি। সংবাদপত্রে যেসব ছবি ছাপা হয়েছে তাতে দেখলাম, আলোচকরা ওভাল আকারে চেয়ারে বসে অনেকটা গোলটেবিল আলোচনা কিংবা অনানুষ্ঠানিক মেজাজে শুধু কথা বলেছেন। তার মধ্যে দিয়েই উঠে এসেছে অনেক কথা যার অধিকাংশই শিক্ষা নিয়ে আমরা যারা লেখালেখি করি মূলত সেসব বিষয়ই আলোচিত হয়েছে। তারপরেও আয়োজকরা ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।
রাষ্ট্রপরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের লেজুড়বৃত্তিক দলীয় রাজনীতি, ছাত্ররাজনীতির নামে দখলদারিত্ব এবং দৃর্বৃত্তায়নের মধ্যে দিয়ে পুরো শিক্ষাব্যবস্থা পঙ্গুত্ব বরণ করতে বসেছে। এই আর্টিকেলের সূচনায় উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থীরা যা হবেন বা যা যা শিখবেন সেগুলো বলে উল্লেখ করেছি, সেগুলো থেকে তারা বহু দুরে অবস্থান করছেন।
দেশের আনাচে কানাচে, দরকারি অদরকারি, ব্যবসায়িক, দলগত, প্রেস্টিজগতসহ বিভিন্ন কারণে সর্বত্র সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে ও হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে কতোগুলোর প্রয়োজন আছে কি না সেদিকে কাবোরই খেয়াল নেই। হাতেগোনা দুচারটি বাদে বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল ও কলেজের মধ্যে পার্থক্য করাও মুশকিল হয়ে পড়েছে। আর প্রশাসন হয়েছে অনেকটা বেসরকারি স্কুল কলেজের ম্যানেজিং কমিটির মতো।
এলাকার কিছু মাতব্বর নিজেদের ইচ্ছেমতো শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষক বাদ, প্রতিষ্ঠানোর অর্থ নিজেদের অর্থ মনে করে খরচ করাসহ সবকিছুই নিজেদের দখল রাখতেন। এনটিআরসিএ কর্তৃক শিক্ষক বাছাই প্রক্রিয়ার পরেও রাজনৈতিক কারণে বেসরকারি স্কুল কলেজগুলোতে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি-না মানের দিক থেকে, না দক্ষ প্রশাসনের দিক বিবেচনায়। সরকারিগুলোর অবস্থা যেনো আরো করুণ। সবকিছুর পেছনেই রয়েছে দুষ্ট রাজনীতি, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন! বেসরকারি স্কুল ও কলেজগুলোর মতো দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রভাষক পদে শিক্ষক নিয়োগে প্রচণ্ড অনিয়ম করেছে বিগত সরকার, যার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পুরো শিক্ষাকে পণ্ড করে দেয়ার অবস্থায় ফেলে গেছে।
একইভাবে মেধাবী শিক্ষার্থীরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন তখন শুরুতেই তাদেরকে রাজনৈতিক দুর্বত্তায়নের কারণে দারুণভাবে বঞ্চিত করে রাখা হয়। হলগুলোতে প্রাধ্যক্ষ বা আবাসিক শিক্ষকেরা সিট বরাদ্দ করতে পারতেন না, নেতারা দাস-দাসীর মতো খাটার বিনিময়ে তাদের হলে থাকতে দিতেন। নেতারা বললেই মিছিলে আসতে হতো, আর নেতা মানে বিরাট এক মাস্তান। কোথায় শিক্ষা, কোথায় গবেষণা, কোথায় আন্তর্জাতিক মানের মানবসম্পদে পরিণত করার চিন্তা? এগুলো সবই হয়েছিলো রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদে। জাতি ধ্বংসের এক মহা ব্যবস্থা! আর প্রাথমিকে ও মাধ্যমিকের বিষয়টি শুরু করেছিলো কল্পিত কারিকুলাম আর মূল্যায়ন ব্যবস্থা নিয়ে। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশুনা উধাও। শিক্ষার্থীদের যা হওয়ার কথা তারা হচ্ছিলো হলো তার উল্টো। অথচ উর্বর ধানের জমি নষ্ট করে শুধুমাত্র রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ফায়দা লাভের জন্য ছোট ছোট বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন শুরু হলো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত ধারণাকে জলাঞ্জলি দিয়ে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কয়েক হাজার উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার কলেজ যেগুলো দেশে তথাকথিত শিক্ষিত বেকার তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে। তারা না করছে নিজ নিজ বিষয়ে পড়াশোনা, না অর্জন করছে সফট স্কিল ও ভাষাগত দক্ষতা। অথচ উচ্চশিক্ষার অর্ধেক ছেয়ে আছে এসব অনার্স আর মাস্টার্স ডিগ্রি দেয়া কলেজগুলো।
উচ্চশিক্ষা সম্মেলনে একজন বক্তা বলেছেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমকি শিক্ষা উন্নত না হলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা পর্যন্ত জনসম্পদ যদি দক্ষ না হয়, শুধু প্রতিষ্ঠানগত কিছু পরিবর্তন এনে শিক্ষা খাতে বড় পরিবর্তন সম্ভব নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে কী ধরনের শিক্ষার্থী আসবে, বা শিক্ষক আসবে তা নির্ভর করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার বুনিয়াদ কতোটুকু তার ওপর। চমৎকার কথা বলেছেন, যা আমরা সব সময়ই বলছি, শিক্ষার ভিত মজুবত না হলে উচ্চশিক্ষা তো ভেঙে পড়বেই। তাই হয়েছে, গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্সে ১৪১টি দেশের মধ্যে মধ্যে আমাদের অবস্থান ১১৩। গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্সে অবস্থান ১২৯তম। রাজনৈতিক কারণে সরকারসহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরাও দায়ী। তারা উচ্চ-মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষার কারিকুলাম, সিলেবাস ও পড়ানোর ধরন সম্পর্কে একেবারেই অন্ধকারে, দু-চারজন ছাড়া। এ বিষয়টি কোনোভাবেই হওয়ার কথা নয়। কারণ, শিক্ষা একটি চেইন, এখানকার একটি বা দুটি আংটা ঢিলা হলে বা নষ্ট হলে পুরো চেইনই কিন্তু নষ্ট হয়ে যায়।
আর একটি আলোচনা উচ্চশিক্ষা নিয়ে প্রায়ই হয়ে থাকে সেটি হচ্ছে গবেষণা। অর্থ বরাদ্দ নেই তাই গবেষণা হয় না, গবেষণার পরিবেশ নেই তাই গবেষণা হয় না ইত্যাদি। যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন তারা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, তাদের গবেষণার প্রয়োজন হয় না, এর গুরুত্বও তারা বোঝেন না। তারা বোঝেন ক্যাডার লালান-পালন করা, কীভাবে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে হবে এসব কাজে তারা পারদর্শী। তৃতীয় বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই একই খেলা। গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরদেরকেই করতে হবে ও তার ফল শিক্ষা সংশ্লিষ্ট মানুষ এবং দেশকে প্রদর্শন করতে হবে। গবেষণা একটি উদ্দীপনা, প্রেষণা, একটি নেশা। এটি অর্থ বরাদ্দ থাকলেই যে হবে তা নয়। এটি বিএড কোর্স নয় যে, এটি করতে হবে উচ্চতার স্কেল পাওয়ার জন্য। কৃষিতে যারা গবেষণা করে নতুন নতুন জাতের শস্য, ফল ও সবজি উৎপাদন করছেন তার ফল দেশ ও জনগণ সরাসরি ভোগ করছে। বেশি গবেষণা দরকার বিজ্ঞানে, স্বাস্থ্য বিজ্ঞানে ও আইসিটিতে। এসব জায়াগয় কিন্তু সে রকম কিছু হচ্ছে না। এখণ গবেষণা মানে হচ্ছে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন আর সেটি হচ্ছে সমাজ বিজ্ঞান, সাহিত্য ও ভাষায়। এ ধরনের পিএইচডিতে দেশ ছেয়ে গেছে কিন্তু শিক্ষার কোনো পরিবর্তন হয়নি। পিএইচডির একটি সার্টিফিকেট নেয়া আর প্রকৃত গবেষণা এক কথা নয়! বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এ কথাও বুঝতে হবে। পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে তিনি নতুন কী আবিষ্কার করলেন, শিক্ষায় নতুন কী করলেন, সেটি মানুষ দেখবে। আমরা দেখি কোনো একজন পিএইচডি করে কিংবা জার্নালে কোনো আর্টিকেল ছেপে নিজেই তার ছবি ও খবর ফেসবুকে দিয়ে প্রচার করছেন। লাখ লাখ জার্নাল আছে কোথাও একটা গবেষণা প্রকাশ হলেই হবে না, সেটা কেউ ওয়ান, কিউ টু মানের হতে হবে। একজন আলোচক বলেছেন, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পিএইচডি ডিগ্রি দিচ্ছেন, বেসরকারিগুলো দিতে পারছেন না। এ ধরনের সার্টিফিকেট দেয়া বা বিক্রি করা শিক্ষায় কি অবদান রাখছে সেটি ভাবতে হবে। এসব সার্টিফিকেটের পরিবর্তে যদি ইন্ডাস্ট্রি ও উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করা যায় তাহলে শিক্ষার্থীরা বাস্তবজ্ঞান লাভ করবেন, যা নিজের ও দেশের কাজে লাগবে। তাদের বেকার তো থাকতেই হবে না বরং অন্যদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে সক্ষম হবেন।
সরকারী হোক বেসরকারি হোক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্তর্জাতিকমানের শিক্ষা-সংস্কৃতি তৈরি হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ার ক্যাম্পাস নিরাপদ নয়, মানহীন শিক্ষা, উন্নত বিশ্ব থেকে কেউ এখানে পড়া কিংবা গবেষণার জন্য আসে না। উচ্চশিক্ষার সার্টিফিকেট গ্রহণ করে যে কালচারে রাষ্ট্রীয় ক্লার্ক হওয়ার জন্য সমস্ত শক্তি ও মেধা ব্যয় করেন সেই সংস্কৃতির বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন কীভাবে হবে? যেখানে মাস্তান তৈরি আর লাঠি বাহিনীর খেলায় ক্যাম্পাসগুলো সরগরম থাকে! আফ্রিকা কিংবা আশেপাশের দরিদ্র দেশগুলো থেকে কিছু শিক্ষার্থী আমাদের কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসেন সেটিও অত্যন্ত জটিল। তারা স্টুডেন্ট ভিসায় আসতে পারেন না। আসতে হয় ভিজিট কিংবা অন্য কোনো ভিসায়। এটি রাষ্ট্রের হাতে, কিন্তু রাষ্ট্রের তো এদিকে খেয়াল নেই। ভবিষ্যৎ সরকারি যদি বিষয়টি চিন্তা করে তাহলে দেশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের আর একটি পথ খুঁজে পাবে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) অনুমোদন নিয়ে বিদেশ থেকে মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়ে আসতে হয়। কিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় বিদেশি শিক্ষক আনতে চান কিন্তু রাষ্ট্রীয় এসব বাধার কারণে সেটি প্রলম্বিত হয় কিংবা বাদ পড়ে যায়। রাষ্ট্রকে এ বিষয়টিও দেখতে হবে।
ইউজিসির ভূমিকা ও জনবল নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। শিক্ষা পদ্ধতি, গবেষণা, কারিকুলামসহ বিভিন্ন বিষয়ে ইউজিসি এবং মন্ত্রণালয় যেণো আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ফেলে দেয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে। একটি কোর্স অনুমোদনের জন্য পাঠানো হলে সেটি কার্যকর হতে বছরের পর বছর সময় লেগে যায়। ভিসির ফাইল ইউজিসি তিন বছর ধরে আটকে রাখা হতো। ইউজিসি থেকে দুটি সেমিস্টার করার কথা বলা হয়েছে কিন্তু দুই ও তিনটি সেমিস্টারের মধ্যে ভালোমন্দ দুটো দিকই আছে। এটা নিয়ে ইউজিসি কোনো গবেষণা না করে দুই সেমিস্টারের কথা বলছে। দেশে ১১৪টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে অথচ ইউজিসিতে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো প্রতিনিধির কথা আমরা শুনতে পাই না। বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত বিষয়গুলো যাতে ইউজিসিই সমাধান করতে পারে, বার বার যাতে মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হতে না হয় সে ধরনের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।
দেশে রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে তারা তো তাদের নিজস্ব রাজনীতি নিয়ে চিন্তা করবেন এটি স্বাভাবিক। কিন্তু দেশের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য উচ্চশিক্ষার বিষয়গুলোতে আন্তর্জাতিকমানের আইনকানুন যাতে প্রতিষ্ঠিত করা হয় সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখার অনুরোধ করছি। এ বিষয়টি পুরোপুরি রাজনীতির বাইরে রাখা প্রয়োজন।
লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক