ঢাকা রোববার, ০৫ জানুয়ারি ২০২৫ , ২১ পৌষ ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

জুলাই বিপ্লব, সংস্কার ও নির্বাচন

মতামত

মাজহার মান্নান, আমাদের বার্তা

প্রকাশিত: ০৮:৩০, ৩ জানুয়ারি ২০২৫

আপডেট: ১৩:০৮, ৩ জানুয়ারি ২০২৫

সর্বশেষ

জুলাই বিপ্লব, সংস্কার ও নির্বাচন

সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আইনি ও মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেলেও আমরা আমাদের অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত রয়েছি। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে দেশে নির্বাচন ও ভোট নিয়ে ছলচাতুরির যেনো কোনো শেষ নেই।

সামরিক শাসন, স্বৈরশাসন, ফ্যাসিজম, একনায়কত্ব সব শাসনই আমরা দেখেছি। বহু আন্দোলন ও সংগ্রামের পর ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে জনগণ তাদের ভোট প্রয়োগের সুযোগ পায়। জনগণ স্বপ্ন দেখেছিলো গণতন্ত্রের শুভ সূচনা হলো। কিন্তু সেই সময়কার ক্ষমতাসীনরা জনগণের মতো অভিন্ন স্বপ্ন দেখেনি। তারা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলো যে জনম জনম তাদের হাতেই রাজ ক্ষমতা থাকবে।

আর সে স্বপ্নের বাস্তবায়নের জন্য দুনিয়ার যতো কূটকৌশল আছে সবই প্রয়োগ করা হয়েছিলো। কিন্তু দেশের মানুষের শরীরে ওইসব কূট মেডিসিন খুব একটা কাজ করেনি। গণ-স্বপ্নের কাছে দলীয় স্বপ্ন হার মেনেছে। কিন্তু রাজনৈতিক ময়দানে শুভ বুদ্ধি যেনো গা ঢাকা দিয়েছিলো। গণতন্ত্রের লেবাসে একনায়কতন্ত্র যাত্রা শুরু করলো। বাচনিক গণতন্ত্র আর মানসিক গণতন্ত্রের ফারাক ছিলো সীমাহীন।

৯১ তে ভোটের যে সংস্কৃতি শুরু হয়েছিলো সেটাও দুমড়ে মুচড়ে গেলো। রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলো না নিজেদের অতিমাত্রায় ক্ষমতার লোভ আর বিরোধী মতকে দমনের কারণে। ১৪, ১৮, ২৪ এর নির্বাচনের নামে প্রহসন জনগণ দেখেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিলো মানুষের অধিকারগুলোকে গলাটিপে ধরে রাখা হয়েছে। জন-ক্ষোভের বিস্ফোরণ জাতি দেখলো। অর্ন্তবর্তী সরকার গঠিত হলো।

জনমনে স্বস্তি ফিরে এলো। কিন্তু এই স্বস্তির দীর্ঘায়ন কতোটা সহজ? মোটেও সহজ না। যারা লুটেপুটে খেয়েছে তাদের মরণ কামড় কি থেমে যাবে? তাই বলে কি পথচলা স্তব্ধ হবে? না, সেটা কোনোভাবেই হতে পারে না। বহুমাত্রিক ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা করতে হবে সরকারকে। তবে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, এই সরকার একটি বিপ্লব পরবর্তী সরকার। বিপ্লবী চেতনাকে মূল্য দিয়েই পথ চলতে হবে এই সরকারকে।

এই সরকারের ওপর রয়েছে বহুবিধ চাপ, যেগুলো সামাল দেয়া কঠিন কাজ। প্রথম চাপটি রয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নিকট থেকে। জুলাই বিপ্লবে যারা নিহত হয়েছে ও যারা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তাদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে উপযুক্ত বিচার করা। এ সরকারকে অবশ্যই এটি করে যেতে হবে। যদি তারা ব্যর্থ হয় তবে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নিতে পারে। এই সরকারের ওপর দ্বিতীয় চাপটি হলো রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে নির্বাচন দ্রুততম সময়ে করা। এই চাপ সামাল দেয়া বড়ই কঠিন হবে।

সরকার নির্বাচনের মোটামুটি একটি রোডম্যাপ দিয়েছে। আশা করা যায় ২০২৬ খ্রিষ্টাব্দের মে বা জুনের আগেই নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। কিন্তু শুধু তারিখ ঘোষণা করলেই কি নির্বাচন হয়ে যাবে? নির্বাচনী সংস্কার না করে নির্বাচন দিলে যেই লাউ সেই কদুই আবার জনগণ দেখতে পাবে। নির্বাচনের একটি সময়সীমা সরকার জানালেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি কাজ করছে বিশেষ করে বড় দলগুলোর। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কি হবে সেটা একটি বড় প্রশ্ন।

বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চায়। কিন্তু সরকার চায় সংস্কার করে তারপর নির্বাচন দিতে। সরকার নির্বাচনী সংস্কারের সঙ্গে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অর্গানগুলোরও সংস্কার করতে চায়। কিন্তু বিএনপি মনে করে নির্বাচন করার জন্য যতোটুকু সংস্কার প্রয়োজন ততোটুকু করলেই চলে। বাকি সংস্কার নির্বাচিত সরকার করবে। প্রশ্ন হলো নির্বাচিত সরকারগুরোর ভূতপূর্ব চরিত্র জনগণ খুব ভালো জানে। জনগণ কি শুধু নির্বাচনী সংস্কারেই তৃপ্ত হবে? আমার তা মনে হয় না। যেসব পরিবার থেকে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে তাদের কাছে নির্বাচন মোটেও মূখ্য না। তাদের কাছে বিচারটা মূখ্য। আবার সুশীল ও নাগরিক সমাজ নির্বাচনের আগে রাষ্ট্র সংস্কারের আগে নির্বাচনের দাবি করে আসছে।

এই সরকার সংস্কার করলো এবং নির্বাচন দিলো। যারা ক্ষমতায় আসবে তারা কি সেটা সংসদে পাশ করবে? যদি তা না করে তবে সংস্কারের ভবিষ্যৎ কী হবে? সরকার সংস্কারের জন্য বেশ কয়েকটি কমিশন গঠন করেছে এবং কমিশনগুলো কাজ করছে। আমার জানা মতে এসব কমিশনে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি নেই। আবার রাজনৈতিক দলের পরামর্শ নিয়ে প্রতিনিধি দেয়া হয়েছে সেটাও মনে হয় না।

তাহলে রাজনৈতিক দলগুলো কি সংস্কারকে স্বাগত জানাবে? বিএনপি ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। সরকারের সংস্কারের সঙ্গে বিএনপির সংস্কারের কি সমন্বয় হবে? নানাবিধ প্রশ্ন এখন জনমনে। আওয়ামী লীগ বিভিন্ন দিকে থেকে চাপে পড়ায় এখন অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ শুরু হয়েছে।

কোনো কোনো দল আনুপাতিক হারে নির্বাচন দাবি করছে। কিন্তু বিএনপি সেটা চায় না। বিএনপি চায় গতানুগতিক ভোটের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা করতে। বিএনপির একটি বিশাল ভোট ব্যাংক রয়েছে। নির্বাচনে ভোট নিরপেক্ষ হলে বিএনপি বিপুল সংখ্যক আসনে জয় পেতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। তাই বিএনপি চায় সংক্ষিপ্ত পরিসরে একটি নির্বাচনী সংস্কার সম্পন্ন করে নির্বাচনে প্রতিযোগিতা করতে। কিন্তু নয়া রাজনৈতিক মেরুকরণ বিএনপিকে কিছুটা অস্বস্তিতে ফেলেছে বলে মনে হয়।

ইসলামি দলগুলো তাদের নিজেদের মতো করে আগানোর চেষ্টা করছে। ছোট ছোট দলগুলো আশাবাদী হয়ে উঠছে। তারাও সংসদে যেতে চায়। কিন্তু তাদের হাতে শক্তিশালী ভোট ব্যাংক নেই। বাংলাদেশের রাষ্ট্র সংস্কার ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিয়ে মোড়ল দেশগুলোর নজর রয়েছে, বিশেষ করে আমাদের প্রতিবেশী দেশের সতর্ক নজর রয়েছে। কাজেই রাষ্ট্র সংস্কার ও নির্বাচন যতো মসৃণ আর সহজ মনে হচ্ছে, আসলে সেটা মোটেও সহজ কোন কাজ নয়। ৫ আগস্টের পর সরকার গঠিত হয়েছে। প্রায় ৫ মাস হতে চললো। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো উল্লেখযোগ্য সংস্কার আমাদের চোখে পড়েনি। কি ধরনের সংস্কার হচ্ছে সেটা সম্পর্কেও আমরা খুব বেশি অবগত নই। গত পাঁচ মাসে সরকার যে খুব স্বস্তিতে রাষ্ট্র চালাতে পেরেছে তা কিন্তু নয়। হরেক পদের বিক্ষোভ আমরা দেখতে পেয়েছি। আনসার বিক্ষোভ থেকে শুরু করে অটোওয়ালাদের বিক্ষোভ আমরা দেখলাম। বিক্ষোভের পাশাপাশি ষড়যন্ত্র আর অপপ্রচারও থেমে নেই। সর্বশেষ সচিবালয়ে আগুনের ঘটনা ঘটলো। সেটার তদন্ত এখনো চলমান।

সরকার ও রাজনৈতিক দলের মধ্যে বোঝাপড়া কেমন অবস্থায় আছে সেটা একটি বড় প্রশ্ন। তাদের মধ্যে কি দূরুত্ব বাড়ছে? এ প্রশ্ন এখন অনেকের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। কেউ কেউ আবার নতুন রাজনৈতিক দল আসতে পারে বলেও ধারণা করছেন। সেটা হতেই পারে। এ ধরনের পরিস্তিতিতে নতুন রাজনৈতিক দল তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু নতুন রাজনৈতিক দল হলেই কি জনগণ তাদের ভোট দিবে? ভোটের ক্ষেত্রে একটি মাইন্ড সেটআপ থাকে। সেই মাইন্ড সেটআপ থেকে বের হয়ে এসে নতুন কিছু করা সত্যি কঠিন। কূট মেকানিজম ছাড়া তেমনটি হয় না বললেই চলে। এ মুহূর্তে সরকারের উচিত কী কী সরস্কার তারা করবে তার একটি সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন প্রকাশ করা। এলোমেলো সংস্কার হলে সেটা জনগণের কোনো কাজে আসবে না। সংস্কার হতে হবে জনকল্যাণে, রাজনৈতিক দলের স্বার্থ রক্ষার্থে নয়। আবার সংস্কার করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেই করা উচিত। অন্যথায় কোনো সংস্কার আলোর মুখ দেখবে না। বৈষম্যবিরোধী নাগরিক কমিটিকে আপাতত একটি প্রতিবাদ প্রাচীর হিসেবে প্রতিয়মান হচ্ছে। কিন্তু সেটা রাজনৈতিক প্লাটফর্মে যুক্ত হলে ভিন্ন রূপ নিতে পারে। এই সরকারের একটি অন্যতম দায়িত্ব রাষ্ট্র সংস্কার করা ও সেই সংস্কারগুলোকে সুরক্ষা বলয়ে রাখা যেনো সেটা মুখ থুবরে না পড়ে। সরকারের দেয়া রোডম্যাপ অনুযায়ী সরকারের হাতে এক বছর সময় আছে ধরে নেয়া যায়। এই এক বছরে কি সরকার সব সংস্কার দৃশ্যমান করতে পারবে? সরস্কার শেষ করেই এই সরকার নির্বাচন করতে চায়। প্রশ্ন হলো সংস্কার করতে যদি অধিকতর সময় প্রয়োজন হয় তবে নির্বাচনও কি বিলম্ব হবে? এমন প্রশ্নও অনেকের মনে আছে। সব কিছু মিলিয়ে একটি মিশ্র অবস্থা বিরাজমান। আপাতত মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার মতো মাথা তোলা নেতা নেই। কিন্তু নির্বাচনী তফশীল ঘোষণার পর দলটি ঘাপটি মেরে থাকবে বলে মনে হয় না। সর্বশক্তি দিয়ে তারা নির্বাচনী মাঠে থাকার চেষ্টা করবে। ভোটের রাজনীতির হিসাবটা এবার বেশ জটিল।

দুর্নীতি দমন ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এই সরকারের একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু বাজার অস্থিরতা যেনো থামছেই না। রাজনৈতিক দলগুলোর কথায় মনে হচ্ছে নির্বাচন দিলেই সব শান্তি বর্ষিত হবে। আসলে কি তাই! জুলাই বিপ্লব এবং রাষ্ট্র সংস্কার এখন এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। কিন্তু সংস্কারের বিষয়গুলোতে আরো পরিষ্কার গাইডলাইন দরকার ছিলো। শুধু কাগুজে সংস্কারে কোনো লাভ হবে না। সংস্কার বাস্তবায়ন হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সরকার চাইলে বিএনপির ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব বিবেচনায় নিয়ে আগাতে পারে। এতে বিএনপির মতো বৃহৎ দল দ্বিমত করবে না ভবিষ্যতে। বিএনপির ৩১ দফার মধ্যে বেশ কয়েকটি দফা আমার কাছে খুবই যৌক্তিক মনে হয়েছে। এই সরকারের হাতে যে সময় আছে তাতে রাষ্ট্রের বৃহত্তর কোনো পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তাই কলেবর বৃদ্ধি না করে প্রয়োজনীয় সংস্কারের দিকেই অধিক নজর দেয়া উচিত। জনগণের ভোটের অধিকার ও বাকস্বাধীনতা নিশ্চিতকরণে সংস্কার বড় প্রয়োজন। আরেকটি সংস্কার প্রয়োজন যেটা হল দুর্নীতি রুখে দেয়ার সংস্কার। দেশে একটি সুষ্ঠ নির্বাচনের সংস্কৃতি চালু হলে এবং দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে এলে অবশিষ্ট সংস্কারের পথ এমনিতেই মসৃণ হবে। যাই হোক না কেনো, জুলাই বিপ্লবের স্পিরিটকে সামনে রেখেই সংস্কার চালিয়ে যেতে হবে। গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে যেকোনো মূল্যে।

লেখক: কবি ও কলামিস্ট

 

জনপ্রিয়