ঢাকা বুধবার, ০৮ জানুয়ারি ২০২৫ , ২৪ পৌষ ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

শিক্ষকদের সর্বজনীন বদলির যৌক্তিকতা

মতামত

মাছুম বিল্লাহ, আমাদের বার্তা

প্রকাশিত: ০৮:০০, ৭ জানুয়ারি ২০২৫

সর্বশেষ

শিক্ষকদের সর্বজনীন বদলির যৌক্তিকতা

এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা কেনো বদলি চাচ্ছেন? প্রথমত যারা নিজ জেলা থেকে বহু দূরের জেলায় চাকরি করছেন, তারা এক ধরনের স্থানীয় সিন্ডিকেটের কবলে বন্দি। তাদের ওপর মানসিক টর্চার চলছে, যা দেখার কেউ নেই। তারা সহসা কোথাও যেতে পারবেন না ভেবে কমিটির কিছু সদস্য, কিংবা স্থানীয় রাজনৈতিকভাবে কিংবা অন্যভাবে পাওয়ারফুল স্থানীয় লোকজন কিংবা স্থানীয় কিছু শিক্ষক এনটিআরসিএর সুপারিশ পাওয়া দূর থেকে আগত শিক্ষকদের মানসিকভাবে টর্চার করছেন। এ কারণে যেসব শিক্ষক বিভিন্নভাবে মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন তাদের পক্ষে শান্তমনে শিক্ষাদান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারা দূরে থাকার কারণে নিকটাত্মীয়দের চরম অসুস্থতা এমনকি বাবা-মায়ের মৃত্যু পর্যন্ত অনেকে দেখতে পারেন না। এসব শিক্ষক নিজ জেলা বা নিকটস্থ জেলায় বদলি চাচ্ছেন। এই বদলির দাবি শিক্ষকদের বহুদিনের। কিন্তু বিভিন্ন জটিলতায় আটকে আছে বিষয়টি। পতিত সরকার শেষের দিকে এসে শিক্ষকদের পারস্পরিক বদলির কথা বলে একটু জনপ্রিয়তা চেয়েছিলো। কারণ, এটির কোনো মানে হয় না। শিক্ষকেরা কাকে খুঁজে বের করে বুঝবেন কার বদলি দরকার, কোথায় দরকার। এটি একটি অযৌক্তিক নিয়ম। এটি রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট বিভাগকেই করতে হয়। অর্থাৎ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরকেই করতে হবে। এ ধরনের বদলি হয়নি, হওয়ার কথাও নয়।

এর সঙ্গে আরো একটি অদ্ভূত বিষয় জুড়ে দেয়া হয়েছে। সেটি হলো- শুধু এনটিআরসিএর সুপারিশ পাওয়া শিক্ষকরাই এ সুবিধা পাবেন। আগের শিক্ষকেরা এই সুবিধা পাবেন না। এখানে বলে রাখা ভালো, প্রথম থেকে ১২তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের চাকরির জন্য স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির কাছে পরীক্ষা দিতে হতো। তাদের নিয়োগও দিতো স্কুল কমিটি। কিন্তু ১৩তম থেকে এনটিআরসিএ এর সুপারিশেই চাকরি কনফার্ম হওয়া শুরু হয়। যদিও তাদের নিয়োগ কর্তাও বেসরকারি কমিটিই। তাই ১২তম থেকে আগের ও পরের নিবন্ধন পরীক্ষা ও সনদের পার্থক্য আছে।

কিন্তু, এনটিআরসিএর বাইরে শিক্ষকেরা কি তাহলে শিক্ষকতা পেশায় এসে অপরাধ করে ফেলেছেন? এটি তাদের প্রশ্ন। এনটিআরসিএর সুপারিশকৃত সব ব্যচের শিক্ষকেরাই এই সুবিধা পাবেন না। এখানে এক পক্ষকে বঞ্চিত রেখে অপর পক্ষকে সুবিধা দেয়া মানে বৈষম্য সৃষ্টি করা। প্রথম থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত এনটিআরসিএর শিক্ষকরা বদলির আওতায় আসবেন না, তেরতম থেকে এনটিআরসিএর মাধ্যমে সুপারিশপ্রাপ্তরাই বদলি হতে পারবেন, বাকিরা নয়। এটি কেনো? এটি স্পষ্টভাবে বৈষম্য। এনটিআরসিএর সনদধারী শিক্ষকেরা তার বাইরের অর্থাৎ পূর্বে নিয়োগকৃত শিক্ষকদের বিভিন্নভাবে হেনস্তা করেন, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে কথা বলেন, ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছেন বলে অনেক শিক্ষক অভিযোগ করেছেন। তারা বলেছেন, তাদের বদলিতে আমাদের কোনো অভিযোগ নেই। বদলি তাদেরও হোক, আমাদেরও হোক। কিন্তু এই বদলি নিয়ে তারা অনেক অপমানজনক কথা বলছেন, যা শিক্ষকসুলভ নয়। শিক্ষকদের এ ধরনের আচরণ প্রদর্শন করা ঠিক নয়।

স্থানীয় শিক্ষকেরা সুবিধা পাবেন, দূর থেকে আগত শিক্ষকেরা আত্মীয়-স্বজন ও নিজ ছেলেমেয়েদের ও পরিবারের কাছ থেকে দূরে থেকে পারিবিারিক ও নিকটজনদের কাছে থাকার সুবিধা থেকে বঞ্চিত, নিজ ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খবর নিতে পারছেন না। এটি অবশ্য যে কোনো চাকরির ক্ষেত্রেই হতে পারে। কারণ, নিজ বাড়িতে বসে বা বাড়ির কাছে চাকরি করা অনেক সময়ই সম্ভবপর হয় না। তবে, অন্য পেশার কর্মকর্তা কর্মচারীরা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে সঠিকভাবে বেতন ভাতা পান, বাড়িভাড়া পান যেটি বেসরকারি শিক্ষকদের বেলায় অতি নগণ্য কিংবা হিসাবের বাইরে। তারা নির্দিষ্ট পরিমাণ নামমাত্র বাড়িভাড়া ও মেডিক্যাল অ্যালাউন্স পান তা দিয়ে বাকিদের সঙ্গে তুলনা করা সাজে না। তারা বরং নিজ এলাকায় চাকরি যাতে করতে পারেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সেই ব্যবস্থাই করা উচিত।

সরকারি চাকরি ছাড়াও প্রায় সব চাকরিতেই (বিশ্ববিদ্যালয়সহ দু-চারটি বিভাগ ব্যতীত) কর্মকর্তা কর্মচারীদের বদলি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বদলির কতকগুলো কারণও রয়েছে। কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী পদোন্নতি পেলে তাকে বদলি করা হয়, কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী অপরাধমূলক কিছু করলে তাকে বদলি করা হয়। তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য পরিবর্তনের জন্য বদলি করা হয়। বদলি চাকরিতে বৈচিত্র নিয়ে আসে, নতুনত্ব নিয়ে আসে, নুতন উদ্যম নিয়ে আসে। বদলিজনিত কারণে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একঘেয়েমি কেটে যায়। বদলি নেটওয়ার্ক বৃদ্ধি করে, অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে সহযোগিতা করে অর্থাৎ সরাসরি পেশাগত উন্নয়নে অবদান রাখে। বদলি বহু মানুষের সঙ্গে পরিচিতি, তাদের ভাব-ভঙ্গি, আচার-আচরণ ও সাইকোলজি বুঝতে সহায়তা করে।

বদলি চাকরির এক ধরনের নিরাপত্তাও বটে। বেসরকারি শিক্ষকেরা বদলিজনিত সুবিধা থেকে বিভিন্নভাবে বঞ্চিত। তাদের বঞ্চনার শেষ নেই। কোনো সার্ভিস রুলস ছিলো না, ছিলো না কোনো অর্থনৈতিক প্রণোদনা। বহু আন্দোলন, প্রতীক্ষা ও রাজপথ দখলের পর তাদের ভাগ্যে কিছুটা অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা জুটেছে। কিন্তু সেটি হু হু করে জিনিসপত্রে দাম বেড়ে যাওয়ায় তার সঙ্গে পাল্লা দিযে পারছে না। যারা চাকরির জন্য, একটি ইনডেক্স নম্বর পাবার জন্য নিজ এলাকা থেকে দূরের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়েছেন তাদের এখন অসহায় অবস্থা।

এটি ঠিক যে, রাষ্ট্র ইচ্ছে করলেই হুট করে কিছু করতে পারে না। অবজারভেশন ও নির্দিষ্ট কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তবে, আসম্ভব কিছু না। যেকোনো নিয়মই হোক তা মানুষের জন্য, রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য। আর রাষ্ট্রের যেসব কর্মকর্তা এগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন তাদেরও শিক্ষা তথা রাষ্ট্রের কল্যাণের কথা চিন্তা করে কিছু সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তাতে রাষ্ট্র লাভবান হয়। সমস্যা হচ্ছে আমাদের রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সেই দিক্ষায় দিক্ষিত করতে পেরেছি কি না। পারিনি বলেই সামান্য বিষয় যেটি টেবিলে সমাধান করা সম্ভব, অবহেলা আর অবজ্ঞার কারণে সেটি নিয়ে রাজপথে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যায়। সরাসরি বললে বলতে হয়, বেসরকারি শিক্ষকদের বদলির ক্ষেত্রে যেহেতু কোনো অর্থনৈতিক বিষয় জড়িত নেই, তাই তাদের বদলি মানে শিক্ষার উন্নয়নে একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা। তাদের বদলি মানে শিক্ষকদের প্রকৃতঅর্থে ক্ষমতায়িত করা। রাষ্ট্রের এটি অবশ্যই করা উচিত। তাদের যেহেতু ইনডেক্স নম্বর আছে সই নম্বর যাতে বাংলাদেশের যেকোনো স্থানে ব্যবহৃত হতে পারেন, সেই ধরনের ব্যবস্থা মন্ত্রণালয় থেকে অবশ্যই করা উচিত।

আমাদের শিক্ষার হাজারো সমস্যা একদিনে সমাধান করা সম্ভব নয়। কিন্তু কিছু সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান সম্ভব যদি অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয় কিছু সাহসী, দেশপ্রেমিক ও সর্বজনীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে।

লেখক : ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক

 

জনপ্রিয়