এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, দুর্নীতি ও সন্ত্রাস--আলিফ লায়লার ভয়ংকর এ দুই দৈত্য দীর্ঘদিন ধরে গ্রাস করে চলেছে আমাদের শিক্ষা, নীতি-নৈতিকতা, আচরণ, তথা আমাদের জাতীয় চরিত্রকে। বিষধর এ দুই কালনাগিনীর বিষাক্ত ছোবলে যেনো নীল হয়ে গেছে জাতির শরীর, এখনো বিষের যন্ত্রনায় ছটফট করছে আর প্রতিনিয়তই প্রহর গুনছে সুস্থ হবার অপেক্ষায়। সমুদ্রের গভীরে নিমজ্জমান তরণীর যাত্রীরা যেমন ভাসমান খড়কুটা ধরে কূলে উঠবার একটা মৃদু আশা নিয়ে ভাসতে থাকে, তেমনি অসহায় জাতির আশাপ্রদীপের নিঃশেষিত সলতেটুকু এখনো টিমটিম করে জ্বলে আছে যদি কোনো উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা বিদ্যুতবেগে ছুটে আসে অথবা আরব্য রজনীর গল্পের সেই ত্রাণকর্তা সিন্দাবাদ ঈশ্বরের আদেশে হঠাৎ করেই আবির্ভূত হয়ে পুনর্জীবন দান করেন।
অনেকের ধারণা শুধু ঘুষ গ্রহণের নামই দুর্নীতি। একেবারেই তা নয়। ঘুষ গ্রহণ, বল প্রয়োগ, ক্ষমতার অপব্যবহার, অর্থ বা সম্পদ আত্মসাৎ, ভীতি প্রদর্শন, স্বজনপ্রীতি, প্রভাব বিস্তার, সরকারি ক্রয়ে অনিয়ম, সম্পদের অপব্যবহার, অযোগ্য ব্যক্তিকে সুবিধা প্রদান, দায়িত্ব পালনে অবহেলা, যথাসময়ে অফিসে উপস্থিত না হওয়া, টেবিলে কাজ ফেলে রাখা–এ সবই দুর্নীতির অন্তর্ভুক্ত। শুধু তাই নয়, একজন দুর্নীতিবাজকে সমর্থন করা বা তাকে আইনের হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করার নামও দুর্নীতি।
দুর্নীতির জন্ম কবে হয়েছিলো এর সঠিক ইতিহাস জানা যায় না। তবে সুদূর অতীতে এমনকি সুপ্রাচীনকালেও সমাজে দুর্নীতি বিদ্যমান ছিলো–এমন প্রমাণ পাওয়া যায় চাণক্য বা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে। সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে কৌটিল্য রাজ্যের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কার্যকরি পদক্ষেপ ও তাদের বিরুদ্ধে নানান শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছিলেন। আমাদের দেশে শুধু ইংরেজ বা পাক-শাসকদের শাসনামলেই নয়, খোদ স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিলো দুর্নীতির পাখায় ভর করে। সংগ্রামী ও স্বাধীনতাকামী কোটি জনতার স্বপ্নকে পদদলিত করে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ব্যাপক গণহত্যা, ডাকাতি, রাহাজানি, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ভীতি প্রদর্শন, জবরদখল কোনোকিছুরই খামতি ছিলো না। এমনকি ১৯৭৩ এ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচন ছিলো নির্বাচন নামের একটি প্রহসন। তবে সব দুর্নীতির ইতিহাসকে ছাপিয়ে মহাদুর্নীতির চরম শিখরে আরোহণ করেছিলো বিগত ১৫/১৬ বছরের আওয়ামী দুঃশাসন, যা সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্ম সম্যক অবহিত। দুর্নীতিই যেনো ছিলো প্রশাসনযন্ত্রের মূল চালিকা শক্তি। বিশ্বব্যাংকের ‘কান্ট্রি প্রকিউরমেন্ট অ্যাসেসমেন্ট’ সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিলো সরকারি অফিসে ঘুষ ছাড়া ফাইল নড়ে না, বাংলাদেশে ঘুষ এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যেনো এটি বেতনেরই একটি অংশ। নৈতিকতার এমন চরম অবক্ষয় জাতি ইতোপূর্বে আর প্রত্যক্ষ করেনি।
শিক্ষাঙ্গন একটি পবিত্র স্থান যেখানে বিকশিত হয় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবন। এখানে জ্ঞানের আলোর বিচ্ছুরণ ঘটবার কথা থাকলেও প্রায়শই বিস্ফোরণ ঘটানো হতো ককটেল অথবা হাতবোমার, দৃশ্যমান হতো সন্ত্রাসীর আগ্নেয়াস্ত্রের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। স্বৈরাচারী শাসক এরশাদের আমলে বিশ্বিবিদ্যালয়গুলো প্রায়ই বন্ধ ঘোষিত হতো। বিগত ১৬ বছরে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষিত না হলেও বিশেষ একটি ছাত্রগোষ্ঠী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস এবং আবাসিক হলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চালিয়েছে হত্যাসহ নানান জঘন্য কর্মকাণ্ড। বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহিম হত্যার ঘটনা প্রমাণ করে দেয় কতো নিষ্ঠুরতা ও পাশবিক কর্মকাণ্ড চালানো হতো আবাসিক হলগুলোতে। সতীর্থদের মধ্যে যেখানে হৃদয় জুড়ে সৌহার্দ্যের উষ্ণতা থাকবার কথা, সেখানে চালানো হতো হকিস্টিক, চাকু, ছুরি ও আগ্নেয়াস্ত্রের নির্মম ব্যবহার। দলের সমর্থনে আমদানি করা হতো ভাড়াটে গুণ্ডাদের যারা মুহূর্তেই তাণ্ডবলীলা চালিয়ে কেটে পড়তো।
সরকারের বিভিন্ন খাতগুলোর মধ্যে শিক্ষা খাত অন্যতম। মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং জাতীয় উন্নয়নে এই খাত বিশাল ভূমিকা পালনে করে কিন্তু অতীব পরিতাপের বিষয় প্রায় সব সরকারের আমলেই এই শিক্ষা খাত শুধু অবহেলিতই হয়নি বরং অপর্যাপ্ত বাজেট এবং ব্যাপক দুর্নীতি যেনো শিক্ষা খাতে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে দেখা দিয়েছিলো। স্বাধীনতা পরবর্তী কয়েক দশকেও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সর্বজনীন, গণমুখী এবং শিক্ষিত জাতি গঠনে সহায়ক হতে পারেনি। শিক্ষাব্যবস্থা পাক এবং তৎপূর্ববর্তী আমলে যে তিমিরে ছিলো এখনো সামান্য পরিবর্তন ছাড়া সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। পার্থক্য হলো এই যে সরকার শিক্ষা-প্রসার এবং শিক্ষার সার্বিক মানোন্নয়নে কাগজে-কলমে দৃশ্যমান কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে কিন্তু মন্ত্রীসহ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নজিরবিহীন দুর্নীতির কারণে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে সেই পরিকল্পনাসমূহ মুখ থুবড়েপড়েছে। উল্লেখযোগ্য, দুর্নীতির মধ্যে রয়েছে নিয়োগ-বাণিজ্য অর্থাৎ ডোনেশন বা ঘুষের বিনিময়ে অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ, প্রকল্পের টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগ-বণ্টন, ছাত্রদের কাছে অতিরিক্ত ফি আদায়, অর্থের বিনিময়ে সার্টিফিকেট জালিয়াতি ও ভুয়া সার্টিফিকেট প্রদান, যাবতীয় সরকারি ক্রয়ে ভুয়া ভাউচার দাখিল করে অর্থ আত্মসাৎ, সন্ত্রাসের মাধ্যমে টেন্ডার ণ্ডার দখল ইত্যাদি। স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা না থাকায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্বাস্থ্য খাতের মত শিক্ষা খাতকে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে। শিক্ষায় দুর্নীতির মধ্যে আরো যা যা প্রকটভাবে দেখা দিয়েছিলো তা হলো – পরীক্ষায় ব্যাপক নকলপ্রবণতা, ক্লাসে না পড়িয়ে প্রাইভেট টিউশনি, কোচিং সেন্টারে পাঠদান, শিক্ষকদের নিয়মিত ক্লাসে না এসে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে প্রাইভেট কোচিং বা অন্যান্য ব্যবসায়ে আত্মনিয়োগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের মত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দলীয় বিবেচনায় অযোগ্যদেরকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান ইত্যাদি।
দুর্নীতির কারণে শুধু যে জাতীয় উন্নয়নই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তা নয়, ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকার ও জনগণ। জনগণ ইতোমধ্যেই গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে, আস্থা হারিয়ে ফেলেছে নির্বাচন ও তথাকথিত নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি। ভোটে নির্বাচিত বা সরকারের মনোনীত প্রতিনিধিরা দেশে একটি ভীতির সংস্কৃতি তৈরি করে একনায়কতন্ত্র কায়েমের মাধ্যমে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা তথা দেশের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে বাংলাদেশে দুর্নীতি কমানো গেলে জনগণের মাথাপিছু আয় বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ করা সম্ভব হবে। কিন্তু সে আশা সুদূর পরাহত, স্বপ্ন ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। স্বপ্ন এ পর্যন্ত শুধু স্বপ্নই রয়ে গেছে। দেশের বিভিন্ন সংবাদ মিডিয়া এবং সুশীল সমাজ দুর্নীতির বিরুদ্ধে মাঝে মাঝে উচ্চকন্ঠী হলেও দুর্নীতিবাজদের ধরার কোনো পদক্ষেপ এবং শাস্তির ব্যবস্থা না থাকায় ওরা দিনদিন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলো। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিষবাষ্পের মত ছড়িয়ে পড়া সর্বগ্রাসী দুর্নীতির ভয়াল কালো থাবায় আটকে পড়ে জাতি যেনো মরণযন্ত্রনায় ছটফট করছে। শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শুরু করে অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য সর্বক্ষেত্রই মহাদুর্নীতির করালগ্রাসে নিপতিত। দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ক্রমাগত যে রিপোর্ট পেশ করে গেছে তাতে বাংলাদেশ বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়নশীপ অর্জনের জন্য যা খুবই লজ্জাজনক। রাজনৈতিক নেতারা ক্রমাগত জনগণকে ধোঁকা দিয়ে চলেছে। নির্বাচনের পূর্বে দেয়া অঙ্গীকারের বরখেলাপ, পবিত্র সংসদে নেয়া শপথ ভঙ্গ, ক্ষমতায় থেকে নিজ পদ ও ক্ষমতা ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধাকে নিজের, আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব এবং অন্ধ দলীয় স্বার্থসিদ্ধিতে কাজে লাগানো, নির্মাণ কাজের ঠিকাদারি অথবা হাট-বাজারের ইজারা গ্রহণে ভয়ভীতি প্রদান করে কমিশন গ্রহণ ও চাঁদাবাজিকরণ, নিজস্ব ক্যাডারবাহনীকে অস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান-এ সবই যেনো স্বাভাবিক রীতিতে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো প্রায় দুই দশক ধরে।
দেশে দুর্নীতি দমন কমিশন নামে একটি কমিশন আছে যা দন্তহীন ব্যাঘ্রের মতোই, শুধু অসার তর্জন-গর্জন ছাড়া তাদের আর তেমন কোনো ভূমিকা আছে বলে জনগণ মনে করে না। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন দুর্নীতিদমন ব্যুরো দেশে দুর্নীতি হ্রাসকরণে আজ পর্যন্ত তেমন কোনো ভূমিকাই রাখতে পারেনি। ব্যুরোতে জমে থাকা অনিষ্পন্ন মামলার সঠিক সংখ্যা কতো এটি বোধ হয় ওই ব্যুরোতে কর্মরত কেউই বলতে পারবেন না। তবে এটি যে পাহাড়সম স্তূপীকৃত হয়ে আছে এটাতে কারো সন্দেহ নেই। দুর্নীতি দমন ব্যুরোতে দীর্ঘসূত্রতা এবং লালফিতার দৌরাত্ম্য এতো বেশি যে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা অবসরে চলে যান কিন্তু মামলার তদন্ত শেষ হয় না। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় কমিশন নিজেই জর্জরিত, কাজেই সেখান থেকে সাধারণ মানুষ কী প্রত্যাশা করবে? স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে-এখন কি তবে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে? সময়ই এর উত্তর বলে দেবে।
দুর্নীতি প্রতিরোধ করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক পবিত্র দায়িত্ব। এ জন্য দরকার প্রচলিত আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার, তার কঠোর প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন এবং এ বিষয়ে সর্বস্তরের জনগণকে সচেতন করা। দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের মূলোৎপাটনের লক্ষ্যে সৎ, যোগ্য, অভিজ্ঞ ও দক্ষ নাগরিকদের সমন্বয়ে অনতিবিলম্বে একটি শক্তিশালী টাস্কফোর্স গঠন করে অভিযান পরিচালনা করে দোষীদের চিহ্নিত করে অতি দ্রুত তাদেরকে আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। গত জুলাইয়ের পট পরিবর্তনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দেশের আপামর জনগণের প্রত্যাশা অনেক বেশি। যদিও এ সরকারের মূল লক্ষ্য কিছু সংস্কারের পর একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। অতীব দুঃখের সঙ্গে বলতেই হয় দুর্নীতিবাজ সরকারের পতনের পরও দেশের আনাচে-কানাচে এখনো বাজার ও টোল দখল, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি পুরাদমে অব্যাহত রয়েছে যার জন্য দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শিক্ষাব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধনসহ দেশকে সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের হাত থেকে মুক্ত করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনবেন–এটি সবার আশা, এটিই একান্ত কাম্য।
লেখক: যুগ্মপরিচালক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।