জনপ্রশাসন সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত কমিশন সম্প্রতি সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে তাদের সুপারিশগুলো তুলে ধরেন। এতে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্যাডারকে ক্যাডারবহির্ভূত করে তাদের জন্য আলাদা কমিশন গঠনের কথা বলা হয়। উপসচিব পদে প্রশাসন ক্যাডার থেকে ৫০ শতাংশ (বর্তমানে তা ৭৫ শতাংশ) এবং বাকি ২৫টি ক্যাডার থেকে ৫০ শতাংশ (বর্তমানে তা ২৫ শতাংশ) কর্মকর্তা নিয়োগের প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাগণ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রয়া ব্যক্ত করেন। স্বাস্থ্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন বিসিএস হেলথ ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন ও শিক্ষাক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি পৃথক বিবৃতিও দেয়। পাশাপাশি কোটাপ্রথা বাতিল করে উন্মুক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে উপসচিব পদে শতভাগ নিয়োগের দাবিতে অন্যান্য ক্যাডার সার্ভিস কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক জোট হয়ে আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের ব্যানারে সভা, সেমিনার করছেন। অন্যদিকে প্রশাসন ক্যাডারদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন এক প্রেস রিলিজে পদোন্নতির কোটা পরিবর্তনের প্রতিবাদ ও প্রতিবেদন সংশোধনের দাবি করে। তারা নানা যুক্তি দেখিয়ে উপসচিব ও তদূর্ধ্ব সব পদ কেবল তাদের জন্য সংরক্ষণের দাবি করেন। সচিবালয়ে জমায়েত হয়ে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্যসচিব ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব ড. মোখলসে উর রহমানে এর সঙ্গে দেখা করে তাদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরনে। পরবর্তী সময়ে তারা কমিশনপ্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীর অপসারণও দাবি করনে। ক্যাডার কর্মকর্তাদের এ পরস্পরবিরোধী অবস্থান আবারও আলোচনায় নিয়ে এসেছে বিসিএস আন্তক্যাডার বৈষম্যজনিত দ্বন্দ্ব।
সরকারের শাসন বিভাগের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অরাজনতৈকি অংশ সিভিল সার্ভিস। ভারতে কোম্পানি শাসন ও ব্রিটিশের ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামোর অধীনে গড়ে ওঠে একটি আধুনিক সিভিল সার্ভিস। এক সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানি (রাজস্বসংক্রান্ত) প্রশাসন পরিচালনায় সৃষ্ট এ সার্ভিস দুটি রাষ্ট্রকাঠামো পার করে এসেছে। শুরুতে এ সার্ভিসের কর্মপরিধি এতো বেশি বিস্তৃত ছিলো না। ছিলো না এখনকার মতো এতো বেশি সংখ্যক ক্যাডার সার্ভিস। তাই এ সার্ভিসের কর্মবিভাগও সে অর্থে পৃথক পৃথক ছিলো না। জেনারেল, প্রফেশনাল ও কারিগরি মিলিয়ে বর্তমানে ২৬টি ক্যাডার সার্ভিসের একটি ব্যতীত বাকি সব সার্ভিসের রয়েছে নির্দিষ্ট ও স্বতন্ত্র কর্মবিভাগ। রাষ্ট্রের কার্যাবলি বিপুল ও বিস্তৃত। রয়েছে স্বাতন্ত্র্য ও বৈচিত্র্য। সামগ্রিকভাবে সব বিষয়ে ভাসা ভাসা ধারণা নিয়ে কোনো একটি বিষয়ে সরকারের নীতি-কৌশল নির্ধারণে কার্যকর ভূমিকা রাখা যায় না। বরং সংশ্লিষ্ট কাজে পেশাগত অভিজ্ঞতা, বাস্তব জ্ঞান ও দক্ষতা সেক্ষেত্রে অধিক ফলপ্রসূ হয়। তাই প্রতিটি ক্যাডারের জ্যেষ্ঠ, অভিজ্ঞ ও সবচেয়ে দক্ষ অফিসারদের নিয়ে গড়ে উঠা উচিত সংশ্লিষ্ট ক্যাডারের শীর্ষ প্রশাসনিক ইউনিট।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোর বাস্তবায়ন, সংযোজন, বিয়োজন, পরিমার্জন ও পরিবর্তন সবই সরকারের ইচ্ছা অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। তবে শিক্ষাক্যাডারকে ক্যাডারবহির্ভূত করার সুপারিশে উদ্ভূত ভাবনাগুলো প্রকাশ না করে পারছি না। শিক্ষাক্যাডারের অনেকে ব্যাংকসহ লোভনীয় অনেক আর্থিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন চাকরি ছেড়ে এসেছেন বা পেয়ে যাননি। এর পেছনে হয়তো ক্যাডারমর্যাদা একটি প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করেছে। এমনকি একই কারণে অনেকে নন-ক্যাডার অনেক আকষর্ণীয় চাকরি ছেড়ে এসেছেন বা পেয়েও যাননি। তাদের কাছে সম্ভাব্য শিক্ষা সার্ভিস কমিশনের উচ্চ বেতন-ভাতাদির তেমন কোনো আবেদন থাকবে না।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের এক প্রেস রিলিজে উপসচিব পদে পদোন্নতিতে বিদ্যমান কোটা বণ্টনের বিষয়টিকে আদালত দ্বারা মীমাংসিত বলা হয়েছে। অথচ তারাই আবার সেটাকে শতভাগ করার দাবি তুলেছেন। বিভিন্ন ক্যাডার থেকে উপসচিব পদে নিয়োগের অতীত প্রেক্ষাপটটা তুলে ধরা প্রাসঙ্গিক মনে করছি। ১৯৭৬ সালে সাবেক সচিব আবদুর রশীদ এর নেতৃত্বে গঠিত পে অ্যান্ড সার্ভিসেস কমিশন প্রজাতন্ত্রের ঊর্ধ্বতন পদগুলোতে পদায়নের একটি ন্যায্য ব্যবস্থার সুপারিশ করেছিলেন। এ কমিশনের প্রস্তাবের আলোকে ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ আগস্ট সিনিয়র সার্ভিসেস পুল (এসএসপি) আদেশ, ১৯৭৯ জারি করা হয়। সব ক্যাডারের উজ্জ্বল রেকর্ডের অধিকারী কর্মকর্তাদের নিয়ে সৃষ্ট একটি পৃথক ক্যাডারে রিক্রুটমেন্ট হবে উপ-সচিব পর্যায়ে যা ‘অ্যাপেক্স ক্যাডার’ হিসেবে পরিচিতি পাবে। বাংলা পিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, এসএসপ’ ধারণা ও কাঠামোতে ছিলো সচিবালয়ে নীতি ব্যবস্থাপনার পদগুলোতে সব ক্যাডারের জন্য সমান সুযোগ ও সার্ভিসের দক্ষ অফিসারদের একটি পুল গঠন। সরকারের সদিচ্ছা সত্ত্বেও অজ্ঞাত কারণে তা ১০ বছর ঝুলে থেকে শেষ পর্যন্ত ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে বাতিল হয়। তবে তার অনেক আগেই ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর জারি করা হয় বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসেস (পুনর্গঠন ) আদেশ, ১৯৮০। এতে সিভিল সার্ভিসে ১৪টি মূল ক্যাডার থাকে ও এগুলোর কয়েকটির সাব-ক্যাডার ছিলো। বিসিএস সচিবালয় নামক যে মূল ক্যাডার ছিলো এর কোনো সাব-ক্যাডার ছিলো না। বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের দুটি সাব-ক্যাডার ছিলো--প্রশাসন ও খাদ্য। সাধারণ শিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষা নামে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের দুটি সাব-ক্যাডার ছিলো। পরে সাব-ক্যাডারসমূহ স্বতন্ত্র ক্যাডারে পুনর্বিন্যস্ত করে ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ আগস্ট তৎকালীন সংস্থাপন বিভাগ থেকে একটি সংশোধনী আদেশ জারি করা হয়। লক্ষণীয় যে, রশীদ কমিশন উপ-সচিব পর্যায়ে রিক্রুটমেন্ট সব ক্যাডারের জন্য উন্মুক্ত রাখার পরামর্শ দেন। আর বাস্তবে তা না করে উল্টা ওই পদগুলো কেবল একটি ক্যাডারের অন্তর্ভুক্ত করে দেয়া হয়। ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের বিলুপ্ত হয়ে যায় সচিবালয় ক্যাডারের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্যাডার। তবে পুরোপুরি গ্রাস করা সম্ভব হয়নি। The Service (Reorganization and Conditions) ১৯৭৫ এর ৪ নং ধারা বলে ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দের ২ ফেব্রুয়ারি জারিকৃত একটি প্রজ্ঞাপনের ৬ নং দফায় উপ-সচিব পদে নিয়োগে ৭৫ শতাংশ প্রশাসন ক্যাডার ও বাকি ২৫ শতাংশ অন্যান্য ক্যাডারের জন্য সংরক্ষণ করা হয়। এসব পদের শতভাগ কেবল একটি ক্যাডার সার্ভিসের প্রাপ্য হলে অন্যান্য ক্যাডার সার্ভিসের জন্য ২৫ শতাংশ কোটা সংরক্ষণের প্রয়োজন হয়েছিলো কেনো? প্রশাসন ক্যাডারের প্রেস রিলিজে এটাকে অপরাজনীতির অংশ বলা হয়েছে। এই অপরাজনীতির সুবিধা সবচেয়ে বেশি কারা নিয়েছে তার ফিরিস্তি দিয়ে এই লেখার কলেবর আর বাড়াতে চাচ্ছি না। চরম বৈষম্যমূলক এই ব্যবস্থায় সংক্ষুব্ধ হয়ে ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে কয়েকজন তথ্য ক্যাডার কর্মকর্তা আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। যার ফলে ২০০২ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট উপসচিব পদে প্রশাসন ক্যাডারের জন্য ৭৫ শতাংশ কোটা সংরক্ষণকে অবৈধ ঘোষণা করেন এবং উক্ত পদগুলো সকল ক্যাডারের জন্য উন্মুক্ত করার নির্দেশ দেন। আদালতের এ রায় কার্যকর করতে গড়িমসি করায় আদালত অবমাননার মামলাও হয়। কিন্তু এর বিরুদ্ধে সরকারের করা আপিলে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ এপ্রিল আপিল বিভাগ বিদ্যমান ৭৫ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ বৈধ বলে রায় দেন। তাই বিষয়টি আদালত দ্বারা মীমাংসিত বলে দাবি করা হচ্ছে। আসলে The Service (Reorganization and Conditions) Act ১৯৭৫ এর ৪ নং ধারা বলে সরকারের এ ধরনের নোটিফিকেশন জারির বৈধতা নিয়েই আদালত রায় দিয়েছেন। ওই একই ধারা বলে সরকার চাইলে কোটা তুলে দিয়ে উপ-সচিব ও তদূর্ধ্ব পদগুলোতে কেবল মেধা ও দক্ষতার ভিত্তিতে সকল ক্যাডার সার্ভিস থেকে নিয়োগ দিতে পারেন। মেধা ও দক্ষতা যাচাইয়ের পরীক্ষার মাধ্যমে কেবল একটি ক্যাডারের কর্মকর্তারাই সুযোগ পেয়ে গেলে নিশ্চয় এ নিয়ে কারো কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়।
বিসিএস পরীক্ষার ক্যাডার পছন্দক্রমে শিক্ষাকে কেউই প্রথম বা একমাত্র পছন্দ হিসেবে দেন না তা শতভাগ সত্য নয়। বরং এরকম ধারণা পোষণ করা একটি ক্যাডার সার্ভিস অফিসারদের হেয় ও অপমান করার শামিল। মেধাতালিকায় অনেক অনেক পেছনে থেকেও কেবল কোটার জোরে অনেকে পেয়ে গেছেন পছন্দক্রমের প্রথমে থাকা ক্যাডার। তাই মেধাকোটায় অন্যান্য ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্তদের মেধার ভিত্তিতে পছন্দমাফিক ক্যাডার পাওয়া নিয়ে কোনো মন্তব্য করার নৈতিক ভিত্তি তাদের নেই।
ক্যাডারবহির্ভূত করে ক্যাডারবৈষম্য দূরীকরণ আরেকটি বৈষম্য হবে। যা বৈষম্যবিরোধী চেতনাকে ধারণ করা এই সরকারের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের পরিপন্থি। একটি ক্যাডার সার্ভিসে এক দশকেরও অধিক সময় পার করে একটি পদোন্নতির দেখা পাইনি। একই বিসিএস ব্যাচের অন্য ক্যাডার সার্ভিসের অনেকেই ইতোমধ্যে দুটি পদোন্নতি পেয়েছেন। এই আর্থিক বঞ্চনা ও পদবঞ্চনার কোনো প্রতিকার নেই। এরপর কর্মস্পৃহা আর কর্মোদ্দীপনার কথা শুনলে হাসি পায়। আন্তক্যাডার বৈষম্য দূর না করে আন্তক্যাডার দ্বন্দ্ব নিরসন সম্ভব নয়। আর একটি আধুনিক জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র নির্মাণে আন্তক্যাডার দ্বন্দ্ব নিরসন জরুরি।
লেখক: প্রভাষক, শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজ