ঢাকা সোমবার, ১৩ জানুয়ারি ২০২৫ , ২৯ পৌষ ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

প্রাথমিকের সময়সূচি বৃদ্ধির অভিপ্রায় কাম্য নয়

মতামত

মো. সিদ্দিকুর রহমান, আমাদের বার্তা

প্রকাশিত: ০৮:০০, ১২ জানুয়ারি ২০২৫

আপডেট: ১৬:৫০, ১২ জানুয়ারি ২০২৫

সর্বশেষ

প্রাথমিকের সময়সূচি বৃদ্ধির অভিপ্রায় কাম্য নয়

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সময়সূচি নিয়ে তিন ধরনের মতাভেদ বা  দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রথমত- কর্মকর্তাবান্ধব সময়সূচি, দ্বিতীয়ত- শিক্ষকবান্ধব সময়সূচি, তৃতীয়ত- শিশুবান্ধব সময়সূচি। এই তিন ধরনের সময়সূচি উপস্থাপন করা হলো : 

কর্মকর্তাবান্ধব সময়সূচি : প্রাথমিক শিক্ষকেরা সরকারি কর্মচারী। সরকারি নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তারা তাদের কর্মঘন্টা তথা সময়সূচি তাদের মতো করে ভাবেন। তাদের সরকারি কর্মচারীর কর্মঘন্টা তাদের মনের মাঝে ঘুরপাক খায়। কর্মকর্তাদের মাঝে শিশু শিক্ষার কাঠিন্য, শিশুর ধৈর্য্য তথা দীর্ঘ সময় পাঠ গ্রহণের সক্ষমতা সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই। তারা প্রায়ই বাংলাদেশের শিশুদের পাঠদানের সময় উন্নত বিশ্বের সময় কম বলে সমালোচনা করে থাকেন।  

আমাদের দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে শিশুদের তাদের মা-বাবাকে সংসারের নানা কাজে সহযোগিতা করতে হয়। তাদের কেউ কেউ পরিবারের জন্য উপার্জন করে বলে বিদ্যালয়ে যেতে পারছেনা। কারো কারো নিয়মিত বা সময়মত বিদ্যালয়ে উপস্থিত হওয়া সম্ভব হয়না। বর্তমান সময়সূচির ফলে শিক্ষার্থী দুপুরে টিফিন পিরিয়ডে স্কুল পলায়ন বা কিন্ডারগার্টেন তথা বেসরকারিভাবে সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখায় ভর্তি হয়। তখন কর্মকর্তা সুধিজন সকলে মিলে মিশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী স্বল্পতার জন্য শিক্ষকদের দোষারোপ করে থাকেন। এছাড়া প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়ায় ব্যাপক বিরূপ সমালোচনা পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। যা ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’ প্রবাদের মত। বিদ্যালয়ের সময়সূচি শিশুবান্ধব তথা মনোবিজ্ঞান হলে শিশুর শিক্ষা হয়ে উঠবে অধিকতর গ্রহণযোগ্য। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কনসালটেন্ট কমিটির কর্মঘন্টা বৃদ্ধির সুপারিশ হবে জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ধ্বংসের চক্রান্ত। সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে  শিক্ষার্থীবিহীন বিদ্যালয়গুলো অবস্থান করবে তা অনেকটা তাল গাছের মতো এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার মত। 

শিক্ষকবান্ধব সময়সূচি: শিক্ষকেরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সময়সূচি দাবি করে থাকেন সকাল দশটা থেকে তিনটা পর্যন্ত। শিক্ষকরা মনে করেন,  সকালবেলায় শিশুরা মক্তবে বা বাসায় ধর্মীয় কায়দা, আমপারা ও সহি কুরআন তেলাওয়াত অনুশীলন করে ১০টায় বিদ্যালয়ে যাবে। বিকাল ৩ টায় ছুটির শেষে বাড়ি ফিরবে। এই সময়সূচিতে সকাল ১০ টার পূর্বে শিক্ষকরা তাদের পারিবারিক কাজ করে, বিদ্যালয়ে প্রস্তুতি নিয়ে যেতে সুবিধা হয়। অনেক শিক্ষকেরা বাসা-বাড়ি অনেক দূরে বিধায়, তাদের যথাসময়ে কর্মস্থলে আসতে অসুবিধা হয়। অপরদিকে সকাল দশটায় বিদ্যালয়ের সময়সূচি হলে মহিলা শিক্ষকেরা রান্নাবান্না বা পারিবারিক কাজ করে, খানিকটা ভারি খাবার খেয়ে যথাসময়ে বিদ্যালয়ে যেতে পারেন। দুপুর তিনটায় বাসায় এসে অল্প সময়ে গরম ভাত রান্না করে, ফ্রিজে সকালে রান্না করা তরকারি বের করে খেয়ে নেন। এই সময়সূচি সারাদেশের শিক্ষকদের জন্য অতি উত্তম। 

শিক্ষক, অভিভাবক, কর্মচারী, কর্মকর্তা, মহাপরিচালক, মন্ত্রী, সচিব, উপদেষ্টাসহ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশাল জনগোষ্ঠী নিয়োজিত প্রাথমিক শিক্ষা তথা শিশু শিক্ষা সমৃদ্ধকরণের উদ্দেশ্যে। কর্মকর্তা ও শিক্ষকবান্ধব সময়সূচি যদি শিশুশিক্ষা বিপর্যস্ত হয়,  তবে এই সময়সূচি হবে আগামী প্রজন্মের জন্য ক্ষতিকর। শিশু শিক্ষার জন্য আমাদের দেশের পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে শিশুরা পাঠের ধৈর্যধারণের ক্ষমতা অনুযায়ী নির্ধারণ করা প্রয়োজন। প্রায় সকল বাংলাদেশি নাগরিকের মতো দুপুরে গরম খাবার খাওয়া, বিশ্রাম, বিকেলবেলা বিনোদন তথা খেলাধুলা সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য দুপুর ২টার মধ্যে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম সমাপ্ত করতে হবে। শারীরিক মানসিক বিকাশের মাধ্যমে আগামী দিনের সমৃদ্ধ জাতি গঠনের শিশু বেড়ে উঠুক। এই প্রত্যাশা হোক শিক্ষকসহ নীতিনির্ধারকদের। 
শিশুবান্ধব সময়সূচি : শিশু মন সাধারণত চঞ্চল প্রকৃতির হয়ে থাকে। তাদের ও আমাদের বড়দের একই কাজ দীর্ঘক্ষণ করলে ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। 

দীর্ঘক্ষণ স্কুলে শ্রেণির কার্যক্রম করলে পড়াশোনার প্রতি শিশু আগ্রহ হারিয়ে অন্যদিকে ধাবিত হয়। তখন অভিভাবক, শিক্ষক, সুশীল সমাজ সকলে মিলে মিশে শিশু শিক্ষাথৃীকে গালমন্দ বা বিরূপ মন্তব্য করতে ভুল করেনা। অনেক শিক্ষার্থীরা দুপুরে টিফিন পিরিয়ডে বাড়িতে খেতে যেয়ে আর ফিরে আসেনা। এ সভ্যযুগে আমরা শিশুদের শাস্তি দেই বা তাদের বিরূপ আচরণ করে থাকি। প্রতি শিক্ষকরা তথা কর্মকর্তারা এই বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করিনা। এর প্রধান কারণ ৯ টা থেকে ৪ টা ১৫ মিনিট বা এক শিফটে তিনটা সময়সূচি । সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দেখে তাদের পার্শ্ববর্তী বেসরকারি বা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখা ও কিন্ডারগার্টেন শিশুদের দুপুর ১:৩০ টার মধ্যে ছুটি হয়। তখন তাদের মাঝে জননন্দিত শিল্পী মমতাজের গানের লাইনটি ভেসে ওঠে - ‘বন্ধু যখন বউ নিয়া বাড়ির সামন দিয়া, রঙ্গ কইরা হাইট্টা যায়। বুকটা ফাইট্টা যায়।’

প্রতিদিন আমাদের শিশু শিক্ষার্থীদের পাঁচটা শ্রেণির কার্যক্রম অংশগ্রহণ করতে হয়। ৩/৪ ক্লাসের পর পরই শিক্ষার্থী-শিক্ষক উভয়েরই মাঝে বিরক্তি ও ক্লান্তি জন্মাতে থাকে। এর ফলে পরবর্তী শ্রেণির কার্যক্রম শিক্ষক দায়সারাভাবে বাড়িতে কাজের চাপ বা পড়া দিয়ে দায়িত্ব শেষ করে থাকেন। এছাড়া ক্লান্ত শরীরে শিক্ষকের বিকল্প কিছু করার থাকে না। প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাক-প্রাথমিকসহ সাধারণত ছয়টি শ্রেণি থাকে। প্রাক-প্রাথমিকে একনাগাড়ে আড়াই ঘন্টা সরব থেকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি ৪ টা পিরিয়ড করে মোট আটটা পিরিয়ড। তৃতীয় চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির পাঁচটা পিরিয়ড মোট ১৫ পিরিয়ড। সর্বমোট প্রত্যহ শিক্ষকদের ২৫ টি পিরিয়ড প্রতিদিন পাঠদান করতে হয়। প্রতিদিন ১ জন শিক্ষককে ৫/৬/৭ পিরিয়ডের শ্রেণির কার্যক্রম করতে হয়। প্রাথমিক শিক্ষকেরা অধিকতর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। প্রাথমিক শিক্ষকেরা সকল পর্যায়ের শিক্ষকের সমাজের মধ্যে শিশুশিক্ষায় বিশেষজ্ঞ। সাব ক্লাস্টার, ইউ আর সি তে বিষয়ভিত্তিক, সি.ইন.এড, ডিপ.ইন.এড ছাড়া অনেকেই বিএড, এমএড প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। সদ্য নিয়োগ প্রাপ্ত ছাড়া প্রায় সকল শিক্ষকের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। বর্তমান সময়সূচি ও কর্ম ঘন্টা শিক্ষকদের ট্রেনিং কাজে লাগানো তেমন সুযোগ নেই। 

একনাগড়ে ৯টা থেকে ৪:১৫ মিনিট শ্রেণির কার্য্যক্রম করে ক্লান্ত শরীরে আনন্দদায়ক ও ফলপ্রসু পাঠদান সম্ভব হয়না। অপরদিকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া বিলম্বিত হওয়ায় শিক্ষক শূন্যতার মাঝে চলে আসছে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো। অনেকটা ‘নদীর একূল ভাঙ্গে ওকূল গড়ে’ গানের মত।

শিশুর বাড়িতে এসে হাতমুখ ধুঁয়ে বা গোসল করে সকল নাগরিকের মতো গরম খাবার খাওয়ার সুযোগ বর্তমান সময়সূচিতে নেই। যার ফলে শিক্ষার্থীদের ক্ষুধার তাড়নায় পেট-পিঠ একাকার হয়ে যায়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ দুপুরে টিফিনে খাবার খেতে এসে আর বিদ্যালয়ে আসেনা। 

 শিশু বান্ধব সময়সূচি কার্যকর করার কতিপয় প্রস্তাবনা :  

১। শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয় ছুটি ২ টার মধ্যে প্রদান করা প্রয়োজন। যাতে তারা দুপুরে গরম খাবার খেতে পারে। খাবার পর খানিকটা বিশ্রাম বা ঘুমিয়ে বিকাল ৪ টায় সুস্থ শরীরে ফুরফুরে মেজাজে খেলাধুলা, বিনোদন বা হাঁটাহাঁটি করতে পারে। এতে শিক্ষার্থীর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ গড়ে উঠবে। 
২। প্রাক-প্রাথমিকে দুইজন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে দুই ঘন্টা শ্রেণির কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির তিনটা পিরিয়ড ও তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির চারটা পিরিয়ড শ্রেণির কার্যক্রম রাখা। প্রতিটি পিরিয়ড ১ ঘন্টা হওয়া প্রয়োজন যাতে শিক্ষার্থীর বাড়িতে পড়ার চাপ তথা গৃহ শিক্ষকের প্রয়োজন অনুভব না হয়।  
৩। শিশুর ধর্মীয় বিষয়ে পড়ানোর জন্য প্রত্যেক বিদ্যালয় এর এক বা একাধিক ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। যাতে প্রাথমিকের শিশুরা মক্তব, মসজিদ বা এবতেদায়ী মাদরাসা মুখী না হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয় বর্তমান সময়সূচি ধর্মীয় শিক্ষা ব্যাহত বা যথাযথ হয়না বিধায় অভিভাবকেরা শিক্ষার্থীকে মাদরাসায় ভর্তি করে থাকেন।
৪। আনন্দময় পাঠদানের জন্য প্রাথমিকের শিক্ষক সংকট শুন্য সহিষ্ণুতায় নামিয়ে আনতে হবে।
৫। বিশেষ করে শিশু শিক্ষার সঙ্গে জড়িত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যথাক্রমে কিন্ডারগার্টেন সরকারি বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখা এক ও অভিন্ন সময়সূচি, বই ও বাৎসরিক ছুটি নির্ধারণ করা প্রয়োজন। বিশেষ করে উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখা বিলুপ্ত করে জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে সমৃদ্ধ করতে হবে। 
আমাদের বয়স্করা দীর্ঘ সময় একনাগাড়ে অনেকক্ষণ একই কাজ করতে ক্লান্তি বা অবসাদবোধ হয়। প্রাথমিক, উচ্চ বিদ্যালয়,কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কঠিন কাজ শিশু শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষকেরা এ বিষয়ে অভ্যস্ত। এক নাগাড়ে দীর্ঘক্ষণ পাঠদান শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের মেধার বিকাশের পরিবর্তে মস্তিষ্কের ক্ষয় পরিলক্ষিত হয়। উন্নত বিশ্বের শিশুর কর্মঘন্টার সঙ্গে তুলনা না করে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে শিশুর বিদ্যালয়ের পাঠদান দুপুর ২টার মধ্যে সমাপ্ত হওয়া দরকার। বিদেশি কর্ম ঘন্টা আমাদের দেশের শিশু শিক্ষা ধ্বংস করবে বিষয়টি সংশ্লিষ্টরা ভেবে দেখবেন। 

লেখক: - শিক্ষাবিদ

জনপ্রিয়