ঢাকা মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫ , ৩০ পৌষ ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন: দেশকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়

মতামত

ইমরান ইমন, আমাদের বার্তা

প্রকাশিত: ০৭:০০, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫

সর্বশেষ

নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন: দেশকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়

স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের নাট্যআন্দোলনের প্রবাদপুরুষ প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব ড. সেলিম আল দীনের ১৭তম প্রয়াণ দিবস আজ। ঔপনিবেশিক সাহিত্যধারার বিপরীতে দাঁড়িয়ে বাংলা নাটককে আবহমান বাংলার গতিধারায় ফিরিয়ে এনেছিলেন তিনি। বাংলা নাটকে বিষয়, আঙ্গিক আর ভাষা নিয়ে গবেষণা ও নাটকে তার প্রতিফলন তুলে ধরেন তিনি। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে বাংলা নাটকের যে আন্দোলন, তার পেছনেও রয়েছে সেলিম আল দীনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের শেকড়ের সন্ধানে মগ্ন ছিলেন। রবীন্দ্রপরবর্তী যুগের সবচেয়ে শক্তিশালী নাট্যব্যক্তিত্ব সেলিম আল দীন।

নাট্যকার সেলিম আল দীন ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ আগস্ট ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার সেনেরখীল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মফিজউদ্দিন আহমেদ ও ফিরোজা খাতুনের তৃতীয়সন্তান তিনি ৷ শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ফেনী, চট্টগ্রাম, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও রংপুরের বিভিন্নস্থানে। বাবার চাকরির সূত্রে এসব জায়গার বিভিন্ন স্কুলে পড়াশোনা করেছেন তিনি ৷

সেলিম আল দীন ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে ফেনীর সেনেরখীলের মঙ্গলকান্দি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ফেনী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন৷ দ্বিতীয়বর্ষে পড়ার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে গিয়ে ভর্তি হন টাঙ্গাইলের করোটিয়ায় সাদত কলেজে। সেখান থেকে স্নাতক পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মধ্যযুগের ‘বাঙলা নাট্য’-এর ওপর গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন সেলিম আল দীন।

 

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই নাটকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন সেলিম আল দীন, যুক্ত হন ঢাকা থিয়েটারে। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শেষে যোগ দেন বিজ্ঞাপনী সংস্থা বিটপীতে, কপিরাইটার হিসেবে। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যোগ দেন। ওই বছরই বেগমজাদী মেহেরুন্নেসার সঙ্গে বিয়ে হয় তার। তাদের একমাত্র সন্তান মইনুল হাসানের মৃত্যু হয় অল্প বয়সেই।

মধ্যযুগের বাংলা নাট্যরীতি নিয়ে গবেষণা করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। বাংলাদেশে একমাত্র বাংলা নাট্যকোষেরও তিনি প্রণেতা। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনাচরণকেন্দ্রিক নিও এথনিক থিয়েটারেরও তিনি উদ্ভাবনকারী। উপন্যাসের মঞ্চভ্রমণ শিরোনামে তিনি ‘কাঁদো নদী কাঁদো’-সহ কয়েকটি উপন্যাসকে মঞ্চে এনেছিলেন। বাংলা নাটকের শিকড় সন্ধানী এ নাট্যকার ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্যের বিষয় ও আঙ্গিক নিজ নাট্যে প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলা নাটকের আপনবৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন।

বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রতিষ্ঠা সেলিম আল দীনের হাত ধরেই। তার সম্পাদনায় ‘থিয়েটার স্ট্যাডিজ’ নামে পত্রিকা প্রকাশিত হতো নাট্যতত্ত্ব বিভাগ থেকে। তার অধীনে অনেক গবেষক গবেষণা করে এম.ফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ঢাকা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সেলিম আল দীন ১৯৮১-৮২ খ্রিষ্টাব্দে নাট্য নির্দেশক নাসির উদ্দীন ইউসুফকে সাথী করে গড়ে তোলেন বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার। গ্রাম থিয়েটারের প্রথম সংগঠন হিসাবে গড়ে তোলেন মানিকগঞ্জের ‘তালুকনগর থিয়েটার’।

সেলিম আল দীনের প্রথম পত্রিকায় প্রকাশিত ‘একাঙ্কিকা’ নাটক বিপরীত তমসায় ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে দৈনিক পূর্বদেশের সাহিত্য সাময়িকীতে বের হয়। প্রথম রেডিও নাটক বিপরীত তমসায় ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে এবং টেলিভিশন নাটক আতিকুল হক চৌধুরীর প্রযোজনায় লিব্রিয়াম (পরিবর্তিত নাম ঘুম নেই) প্রচারিত হয় ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে। আমিরুল হক চৌধুরী নির্দেশিত এবং বহুবচন প্রযোজিত প্রথম মঞ্চনাটক সর্প বিষয়ক গল্প মঞ্চায়ন করা হয় ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে।

 

তিনি শুধু নাটক রচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি, বাংলা ভাষার একমাত্র নাট্যবিষয়ক কোষগ্রন্থ বাংলা নাট্যকোষ সংগ্রহ, সংকলন, প্রণয়ন ও সম্পাদনা করেছেন। তার রচিত হরগজ নাটকটি সুয়েডীয় ভাষায় অনূদিত হয় এবং এ নাটকটি ভারতের রঙ্গকর্মী নাট্যদল হিন্দি ভাষায় মঞ্চায়ন করেছে।

সেলিম আল দীনের লেখা নাটকের মধ্যে ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’, ‘মুনতাসির ফ্যান্টাসি’, ‘শকুন্তলা’, ‘কীত্তনখোলা’, ‘কেরামতমঙ্গল’, ‘যৈবতী কন্যার মন’, ‘চাকা’, ‘হরগজ’, ‘প্রাচ্য’, ‘হাতহদাই’, ‘নিমজ্জন’, ‘ধাবমান’, ‘পুত্র’, ‘বনপাংশুল’ উল্লেখযোগ্য। ময়মনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে তার গবেষণাধর্মী নির্দেশনা ‘মহুয়া’ ও ‘দেওয়ানা মদিনা’। তার রচিত ‘চাকা’ ও ‘কীত্তনখোলা’ অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে।

পাশ্চাত্য শিল্পের সব বিভাজনকে বাঙালির সহস্র বছরের নন্দনতত্ত্বের আলোকে অস্বীকার করে এক নবতর শিল্পরীতি প্রবর্তন করেন সেলিম আল দীন, যার নাম দেন ‘দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্ব’। দ্বৈতাদ্বৈতবাদী রীতিতে লেখা তার নাটকগুলোতে নিচুতলার মানুষের সামাজিক নৃতাত্ত্বিক পটে তাদের বহুস্তরিক বাস্তবতাই উঠে আসে।

‘চাকা’ সেলিম আল দীনের অন্যতম আলোচিত একটি নাটক, যেটি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করে। দেশ ছাড়িয়ে এটি ভারত, যুক্তরাষ্ট্রে মঞ্চায়িত হয়। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে ‘চাকা’ নাটকটির প্রথম মঞ্চায়ন হয় যুক্তরাষ্ট্রে। ইংরেজি অনুবাদে নামকরণ করা হয় The Wheel। সৈয়দ জামিল আহমেদ নাটকটির ইংরেজি অনুবাদ করেন। ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে ভারতে দিল্লিস্থ ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা ‘চাকা’ নাটকটি প্রযোজনা করেন।

এ নাটকটি রচনার পেছনে একটি রাজনৈতিক ঘটনার প্রভাব রয়েছে। ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দের দিকে যখন বাংলাদেশে স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন চলছিলো তখন নূর হোসেন নামের প্রায় অচেনা অজানা এক যুবক বুকে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লিখে রাস্তায় নেমেছিলেন। তিনি স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। নূর হোসেন ১০ নভেম্বর আকস্মিকভাবে পুলিশের গুলিতে মারা যান। এ ঘটনাটি নাট্যকার সেলিম আল দীনের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। এ লাশের দায় কে নিবে? এই অজানা অচেনা যুবকের লাশটির কী হবে? কিভাবে পৌঁছে দিবে তার স্বজনের কাছে? রাষ্ট্রের এমন বিমূঢ় ঘটনায় নানাভাবে আন্দোলিত হয়ে ওঠেন নাট্যকার। নাটকটিতে নানা উক্তি, নানা বর্ণনায় সে-শঙ্কার রূপই প্রতিভাত হয়ে ওঠে। নাটকটিতে যখন বলেন—‘শহর থেকে একটি সরকারি লাশ এসেছে’, ‘কল্যাণমূলক রাষ্ট্র মানেই লাশের গন্তব্যে লাশকে পৌঁছানো’ বা ‘নয়ানপুর কলেজের ছাত্রী রেহানা (১৯) যে ছেলেটাকে ভালোবাসে গোপন একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কাজ করে’, কিংবা ‘এখন করুণা জাগে তাদের জন্য যারা তাকে হত্যা করেছে—যারা তাকে ভুল ঠিকানার দিকে প্রেরণ করেছে—করুণা জাগে তাদের জন্য যারা পেট চিরেছে, হত্যার কারণ গোপন করেছে’ ইত্যাদি সংলাপ থেকে সহজেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে নাট্যকার কোন বিষয়কে ইঙ্গিত করেছেন।

নাট্যাচার্য ড. সেলিম আল দীন ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে সাহিত্যে (মরণোত্তর) স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন। উল্লেখ্য, সেলিম আল দীনের আসল নাম ড. মুহাম্মদ মঈনুদ্দিন আহমেদ। সেলিম আল দীন নামে লেখালেখি করতেন বলেই তিনি এ নামেই সমধিক পরিচিত।

স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, বাংলা অ্যাকাডেমি ও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কারপ্রাপ্ত ড. সেলিম আল দীন রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বাংলাদেশের নাট্যজগতে নেমে আসে নিকষ কালো আঁধার। তিনি মৃত্যু প্রসঙ্গে তার ‘ধাবমান’ নাটকের এক স্থানে লিখেছেন- ‘সে মৃত্যু কষ্টজয়ী হোক, সে দুঃখ জয়ী হোক/ শোক পারায়ে যাক সবল পায়ে...।’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।

 

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

জনপ্রিয়