স্বাধীন আরাকানের সূর্য অস্তমিত হওয়ার ২৪০ বছর পর আরাকানের মানুষ নতুন বছরের সূর্যের সোনালী আলোর ছটায় আপাত স্বাধীনতার স্বাদ নিচ্ছে। এই জয় তাদের হারানো স্বাধীনতা ফিরে পাবার সূচনা বলা যায়। আরাকান আর্মি (এএ) ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাস থেকে শুরু হওয়া মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সংগ্রামের মাধ্যমে রাখাইনে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। সামনের দিনগুলোতে কী হবে সেটা না ভেবে বলা যায়, এটা রাখাইনের জনগণের জন্য বহু বছর ধরে প্রতীক্ষিত একটা গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। ২৭১ কিলোমিটার বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের, মিয়ানমার অংশের পুরো এলাকা এখন আরাকান আর্মির দখলে। মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ তাদের সীমান্ত পোস্টগুলো ফেলে পালিয়ে গেছে এবং সেসব পোস্ট এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। আরাকান আর্মির সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় তেমন কোনো অভিজ্ঞতা নেই। এই অরক্ষিত সীমান্ত বাংলাদেশের নিরাপত্তায় চাপ ফেলছে। বাংলাদেশের পক্ষে বিজিবি আরাকান আর্মিকে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা ও সীমান্ত সংক্রান্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে অবহিত করতে পারে। সীমান্তের দুপাশে আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে সীমান্তরক্ষীদের থাকার কথা, এবং তারা সীমান্ত ব্যবস্থাপনা এবং এ সংক্রান্ত কার্যক্রমে অভিজ্ঞ। সীমান্ত দিয়ে মাদক, অস্ত্র, চোরাকারবার এবং মানবপাচার বন্ধে সীমান্তরক্ষীরা প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ও তারা আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিজিবি ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীকে সতর্ক থাকতে হবে।
মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইনের সরবরাহ পথগুলো অবরোধ করে রাখার কারণে রাখাইন রাজ্য মিয়ানমারের বাকি অংশ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এর ফলে রাখাইনের জনগণ সরবরাহ সংক্রান্ত সমস্যায় রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে চিন রাজ্যের পালেতোয়া হয়ে রাখাইনে ওষুধ ও জ্বালানি আসছে। বাংলাদেশ থেকেও কিছু কিছু সামগ্রী এখন রাখাইনে যাচ্ছে। বর্তমানে রাখাইনের সঙ্গে প্রচলিত নিয়মে বাণিজ্য পরিচালনা সম্ভব না হলেও বিকল্প উপায় বের করে বাণিজ্য চালিয়ে যেতে হবে। দুদেশের ব্যবসায়ীদেরকে এজন্য উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। মিয়ানমারের সঙ্গে এ ধরনের পরিস্থিতিতে চিন, ভারত, থাইল্যান্ড তাদের বাণিজ্য চলমান রাখে ও সেখান থেকে লাভবান হয়। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরাও এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে লাভবান হতে পারে। মনে রাখতে হবে, যেকোনো সংকটে নানা ধরনের সুযোগও সৃষ্টি হয়, সেগুলোকে দ্রুত কাজে লাগিয়ে সমস্যাকে সম্ভাবনায় পরিণত করতে হবে।
চলমান পরিস্থিতিতে রাখাইনের যেকোনো সমস্যা মোকাবিলায় কূটনৈতিকভাবে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার পাশাপাশি আরাকান আর্মির সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতে হবে। স্বাভাবিক নিয়মে এটা সম্ভব না হলে ট্রাক ১.৫ ও ট্রাক ২ ডিপ্লোম্যাসির মাধ্যমে এই কাজ চালিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশের জন্য এটা একটা চ্যালেঞ্জ। তবে চিন, থাইল্যান্ড ও ভারত মিয়ানমারের সঙ্গে তাদের দ্বিপক্ষীয় সমস্যা সমাধানে এ ধরনের উদ্যোগ নেয়, বাংলাদেশ এই দেশগুলোর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নিজস্ব সমস্যা সমাধান করতে পারে। অনেক সুযোগ থাকার পরও বাংলাদেশ মিয়ানমারের রাজনৈতিক দল, জনগণ ও সুশীল সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন ও উন্নয়ন চলমান রাখতে পারেনি। এখন সময় এসেছে এই সম্পর্ক উন্নয়নে এগিয়ে আসার। দুদেশের জনগণের সঙ্গে সামনের দিনগুলোতে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করা একটা চ্যালেঞ্জ, আমাদেরকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এগিয়ে যেতে হবে। বর্তমানে আরকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের বেশিরভাগ অঞ্চলে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে ও সামনের দিনগুলোতে আরাকানে তাদের উপস্থিতি ও অবস্থানকে মিয়ানমারে যে সরকারই আসুক তাদেকে তা মেনে নিতেই হবে। ইউনাইটেড লিগ অব আরাকানকে বাদ দিয়ে সেখানে কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করা সম্ভব হবে না। মিয়ানমারে দুই প্রতিবেশী চীন ও ভারত এই বাস্তবতা বুঝতে পেরেছে এবং তারা আরাকান আর্মির সঙ্গে রাখাইনে তাদের অর্থনৈতিক ও ভুরাজনৈতিক স্বার্থ নিশ্চিত করার জন্য তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের স্বার্থ নিশ্চিত করতে হলে সব স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে মিলে রোহিঙ্গাদেরকেও রাখাইন ও মিয়ানমারের জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে ও সম্পর্ক উন্নয়নে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। এর আগে এনইউজি রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে তাদের অবস্থান তুলে ধরেছিলো। এর ধারাবাহিকতা এবং পরবর্তীতে এর কার্যক্রম এবং এনইউজির সঙ্গে রোহিঙ্গাদের যোগাযোগের বিশদ কোনো তথ্য নেই। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে মেনে না নেয়ার মিয়ানমার সরকারের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থানের প্রেক্ষিতে মাবাথা ভিক্ষুরা রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে যে ঘৃণা ছড়িয়েছিলো তার বিপরীতে রোহিঙ্গা ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে সরব হতে দেখা যায়নি।
রাখাইন রাজ্যের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থুরিন উত্তর রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমার সরকারের পক্ষে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহের দায়িত্বে ছিলো। এই সেনা কর্মকর্তা উত্তর রাখাইনের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত অঞ্চলে রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে পরিস্থিতিকে জটিল করে এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ানোর পরিকল্পনা করে। এর অংশ হিসেবে মংডুতে রোহিঙ্গাদের প্ররোচনা ও ভয়ভীতি দেখিয়ে জোরপূর্বক প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ করে, ভয় দেখিয়ে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে এবং পরবর্তীতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে অংশ নিতে বাধ্য করে। গ্রেফতার হওয়ার পর মিথ্যা সংবাদ ছড়িয়ে জাতিগত বিদ্বেষ উসকে দেয়ার জন্য তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। কিছু রোহিঙ্গা সামরিক জান্তার হয়ে আরাকান আর্মির বিপক্ষে যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছে, আরাকান আর্মি ও রোহিঙ্গাদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়েছে। সামনের দিনগুলোতে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত আলোচনায় সময় ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে সংকট সমাধানে এসব তথ্য যৌক্তিকতাসহ সব পক্ষের কাছে তুলে ধরতে হবে ।
রোহিঙ্গা নির্যাতন নিয়ে বিচারকার্য এগিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক আদালতের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশে পরিদর্শনে এসে সরেজমিনে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেছে। রোহিঙ্গারা যে নির্যাতিত তা প্রমাণিত এবং গত সাত বছরেরও বেশি সময় ধরে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে। রাখাইনে বিভিন্নভাবে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানো হচ্ছে এবং তা বেশ পরিকল্পিতভাবে আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও অন্যান্য জায়গায় প্রচার করা হচ্ছে। এর বিপরীতে বাস্তব প্রেক্ষাপট সম্পর্কে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থা বা বিদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গা নেতারা তথ্য ও উপাত্তগুলো জোরালোভাবে তুলে ধরতে পারছে না। আন্তর্জাতিক মহলে আরাকান আর্মির বক্তব্যগুলো সরব এবং বহির্বিশ্বে সবাই তাই বিশ্বাস করছে। রোহিঙ্গাদের স্বার্থ নিশ্চিত করার কাজে এই দুর্বলতা রয়েছে এবং এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতেই হবে।
অনেকের মতে রাখাইনকে রোহিঙ্গা শূন্য করতে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সেনাবাহিনী একত্রে কাজ করছে। আরাকান আর্মি এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নয় বলে জানা গেছে। তবে রাখাইন তাদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পর তারা রাখাইন ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে সম্প্রীতি বাড়ানোর জন্য কোনো উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা যায়নি। এ ব্যাপারে তাদের মনোভাব এখনো জানায়নি। তবে রোহিঙ্গারা তাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে যুদ্ধ করছে বলে বেশ জোরালো ভাবে তাদের অভিযোগ উপস্থাপন করেছে। এই সমস্যা সমাধানে এখন আরাকান আর্মিকে উদ্যোগ নিতে হবে এবং তাদের সদিচ্ছা থাকলে রাখাইনে রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের শান্তি পূর্ণ সহবস্থান নিশ্চিত করা সম্ভব। চলমান পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আরাকান আর্মির সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা চালাতে পারে, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অনানুষ্ঠানিক ভাবেও এসব আলোচনার সুযোগ রয়েছে।
রাখাইনে প্রায় এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা তীব্র সংঘাত বন্ধ হবে কিনা তা নির্ভর করছে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর। আরাকান আর্মি জানায়, তারা রাজনৈতিক সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে আগ্রহী এবং এই নীতি মেনে তারা আলোচনার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। সামনের দিনগুলোতে রাখাইনের পরিস্থিতি স্বাভাবিক না জটিল হবে তা নির্ভর করছে মিয়ানমার সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ রয়েছে বলে জানায়। বর্তমানে বাংলাদেশ–মিয়ানমার সীমান্তে বিজিবির জনবল বৃদ্ধিকরা ও গোয়েন্দা সংস্থার কার্যক্রম বাড়ানো হয়েছে। কিছু অসাধু দালালের সহায়তায় প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে এসেছে এবং তাদের নিবন্ধন এখনো হয়নি। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ সামনের দিনগুলোতে কার্যকরী উদ্যোগ নেবে বলে আশা করা যায়।
মিয়ানমারে চলমান সংকট নিয়ে ডিসেম্বরে ব্যাংককে বাংলাদেশ, চীন, ভারত, লাওস, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড এই ছয় দেশ বৈঠক করেছে। এই বৈঠকে মিয়ানমারের স্থিতিশীলতা, ভবিষ্যৎ রাজনীতি বা সীমান্ত ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশ ছাড়া কোনো দেশই রোহিঙ্গা নিয়ে কোনো আলোচনা করেনি যা বাংলাদেশকে বিস্মিত করেছে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান না হলে মিয়ানমারের সংকটের স্থায়ী সমাধান আসবে না বলে জানায়। এখানে উল্লেখ্য, মিয়ানমার বিষয়ক আলোচনায় প্রতিবেশী এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করছে এবং অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের মতো সমস্যা তুলে ধরতে পারছে যা এই সমস্যা সমাধানে একটা বিশেষ অগ্রগতি। বাংলাদেশে সমস্যা বাংলাদেশকেই উপস্থাপন করতে হবে তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশে ওপর চেপে বসা একটা কঠিন সংকট। এই সংকট সমাধানে সব দলমত নির্বিশেষে ঐক্যের দরকার। সাত বছরের বেশি সময় ধরে চলমান এই সংকটে আমাদের প্রাপ্তি নেই বললেই চলে। বর্তমানে এই সংকট সমাধানে বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা রোহিঙ্গা বিষয়ক একজন উপদেষ্টা নিয়োগ করেছে যা প্রশংসনীয়, সামনের দিনগুলোতে বাস্তবতার নিরিখে এই সংকট সমাধানে নিয়োগপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ও তার সহযোগীরা মিলে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্রিয় ভুমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।
লেখক: মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক