ঢাকা বুধবার, ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ , ১ মাঘ ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

প্রাথমিকেও বঞ্চিতদের পদোন্নতি হোক

মতামত

মো. সিদ্দিকুর রহমান, আমাদের বার্তা

প্রকাশিত: ২০:০০, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫

আপডেট: ২০:১৭, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫

সর্বশেষ

প্রাথমিকেও বঞ্চিতদের পদোন্নতি হোক

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মচারী-কর্মকর্তা পদোন্নতি বঞ্চিত ছিলো। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বৈষম্য নিরসন এর প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। এরই ফলশ্রুতিতে যারা বৈষম্যের শিকার তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পদোন্নতির থেকে সুযোগ দেয়া হচ্ছে। সচিব পর্যায়ে যারা বঞ্চিত তাদের এ গ্রেডে পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে। জনপ্রশাসনে বঞ্চিত সাবেক ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ সুযোগ সুবিধাসহ পদোন্নতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। তাদের মধ্যে ১১৯ জনকে সচিব পদে পদোন্নতি পাচ্ছেন। এ বাস্তবধর্মী মহতি উদ্যোগ বৈষম্য নিরসনের শুভ সূচনা। প্রাথমিক শিক্ষকসহ শিক্ষার সঙ্গে জড়িত সবাই এই মহতি উদ্যোগকে সাধুবাদ জানান।

সারা দেশের পেশাজীবিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের বেড়াজালে আবদ্ধ প্রাথমিক শিক্ষা তথা এর জনবল। প্রাথমিক শিক্ষা একটি বৃহৎ মন্ত্রণালয়। অথচ নানা বৈষম্য শিশু শিক্ষা মারাত্মক পর্যুদস্থ। বঞ্চিত বিষয়গুলো হলো স্বতন্ত্র ক্যাডারবিহীন প্রাথমিক শিক্ষা, সমযোগ্যতা সম্পন্ন অন্যান্য সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে বেতন বৈষম্য, ২৬১৯৩ বিদ্যালয় এর মধ্যে যাচাই-বাছাইকৃত ৩৯টি বেসরকারি স্কুল জাতীয়করণ না করা, প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষক নিয়োগ করে প্রায় দুই হাজার প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের বেকার রাখা, প্রায় ৪০০০ হাজার জন প্রধান শিক্ষক টাইম স্কেল বঞ্চিত। এ ছাড়া প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে নিয়োগবিধি ও প্রাথমিক শিক্ষক কল্যাণ ট্রাস্ট ২০২৩ শিশু শিক্ষা তথা শিক্ষক কর্মচারীবান্ধব নয়। বিষয়গুলো দ্রুত সমাধান প্রয়োজন এ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করছি:

১, স্বতন্ত্র প্রাথমিক শিক্ষা ক্যাডার: স্বাধীনতার দীর্ঘ সময়ের পরও প্রাথমিক শিক্ষায় নিজস্ব ক্যাডার সার্ভিস না থাকায়, ভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কর্মকর্তারা কাজ করে যাচ্ছেন। প্রাথমিক শিক্ষা তথা তৃণমুলের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তা উচ্চপর্যায়ে নেই বলে প্রাথমিক শিক্ষা বারবার তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষে যেতে হোঁচট খাচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে তৃণমুলের সহকারী শিক্ষক পদকে এন্টি ধরে শতভাগ পদোন্নতি দিয়ে স্বতন্ত্র প্রাথমিক শিক্ষা ক্যাডার সার্ভিস সৃষ্টি করা জরুরি। এ বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কনসালটেন্ট কমিটিসহ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের উপদেষ্টা সচিব, মহাপরিচালকের নীরবতা দৃশ্যমান।

২. সমযোগ্যতা ও সমকাজে অন্যান্য সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষকদের বিশাল বৈষম্য: সারা দেশে প্রায় ৩ লক্ষ ৮০ হাজার প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক শিক্ষার গুণগতমান উন্নয়নে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে চলেছেন। এর পাশাপাশি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দায়িত্ব সফলতার সঙ্গে পালন করছেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের মর্যাদা ও আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়টি কখনো সঠিকভাবে বিবেচিত হয়নি। শিক্ষার মান উন্নয়নে শিক্ষকদের আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ তৈরি করতে হবে। শিক্ষকদের সামাজিক; অর্থনৈতিক মান উন্নয়ন ছাড়া শিক্ষার মান উন্নয়ন সম্ভব নয়। আপনারা শুনে অবাক হবেন, একজন সহকারী শিক্ষকের বেতন স্কেল ১৩তম গ্রেডে, ১১ হাজার টাকা। সর্বসাকুল্যে একজন শিক্ষক বেতন পান ১৭ হাজার ৫৬০ টাকা।

দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বোগতি ও জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় এই সামান্য বেতনে জীবন চালানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

সহকারী শিক্ষকদের ন্যূনতম বেতন ১০ম গ্রেডে নির্ধারণ করতে হবে। ১০ম গ্রেড বেতন স্কেল অর্থাৎ ১৬ হাজার টাকা, সর্বসাকুল্যে বেতন হবে ২৪ হাজার ১০০ টাকা। সরকারের আর্থিক সক্ষমতা বিবেচনায় রেখেই তৃতীয় শ্রেণির মর্যাদা থেকে ২য় শ্রেণির মর্যাদায় উন্নীত করার লক্ষ্যে এ দাবি করা হয়েছে।

সহকারী শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক ২য় শ্রেণি এবং ১ বছরের একটা ডিপ্লোমা (সি-ইন-এড/ডিপিএড) কোর্স। এই যোগ্যতা নিয়ে অধিকাংশ পেশাজীবি ১০ম গ্রেডের কর্মকর্তা হিসাবে যোগদান করেন। এই বৈষম্য দ্রুত দূর করার লক্ষ্যে নিচে কতিপয় উদাহরণ উপস্থাপন করছি:

ক্রমিক পদের নাম যোগ্যতা বেতন স্কেল

১ সহকারী শিক্ষক পরীক্ষণ, বিদ্যালয় স্নাতক সমমান ১০ম গ্রেড, ১৬,০০০ টাকা

২ সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক স্নাতক সমমান ১০ম গ্রেড, ১৬,০০০ টাকা

৩ পুলিশ সাব ইন্সপেক্টর স্নাতক সমমান ১০ম গ্রেড, ১৬,০০০ টাকা

৪ ইউনিয়ন পরিষদের সচিব স্নাতক সমমান ১০ম গ্রেড, ১৬,০০০ টাকা

৫ উপসহকারী কৃষি অফিসার এইচ এইচ এসসি (ডিপ্লোমা ইন কৃষি) ১০ম গ্রেড, ১৬,০০০ টাকা

৬ নার্স এইচ এস সি (ডিপ্লোমা ইন নার্সিং) ১০ম গ্রেড, ১৬,০০০ টাকা

প্রাথমিক সহকারী শিক্ষকদের কি অন্যায় করেছ? তারা একই যোগ্যতা নিয়ে তিনটি গ্রেড নীচে বেতন পাবেন। এটাতো সে আদিম সামন্ত জমিদারি প্রথা, নয় কি? এর অবসান জরুরি।

৩. পদোন্নতি বঞ্চিত প্রাথমিকের শিক্ষক সমাজ: ২০০৯ সাল থেকে প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকেরা পদোন্নতি বঞ্চিত। দীর্ঘ ৭ বছর যাবৎ বিপুল সংখ্যক সহকারী শিক্ষককে প্রধান শিক্ষকের চলতি দায়িত্ব দেওয়া হলেও আজও তাদের পদোন্নতির সুযোগ দেওয়া হয়নি। অনেকেই সহকারী শিক্ষকের বেতন ভাতা নিয়ে অবসরে বা কবরে চলে গেছেন। প্রায় ৩৪ হাজার প্রধানশিক্ষকের পদ দীর্ঘসময় ধরে শূণ্য। এ শূন্যতা শিশু শিক্ষা মারাত্মক বিপর্যস্থ হতে হচ্ছে। এ থেকে রক্ষা পেতে শতভাগ পদোন্নতি সময়ক্ষেপণ না করে দ্রুত করা কাম্য।

৪. যাচাই-বাচাইকৃত ৩৯টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ থেকে বাদ দেয়া:-

সীমাহীন দুর্নীতির সঙ্গে অতিক্রম করেছে প্রাথমিকের বিগত সরকারে জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো। অধিকাংশ জাতীয়করণকৃত বিদ্যালয়গুলোকে গুনতে হয়েছে লক্ষ লক্ষ ঘুষের টাকা। জাতীয়করণ বিদ্যালয়গুলোর সংখ্যা সরকারিভাবে দেখানো হয়েছে ২৬১৯৩টি। উক্ত বিদ্যালয়গুলো যাচাই-বাচাই করে প্রাথমিকের মন্ত্রণালয়ের জাতীয়করণ করা হয়েছে বলে প্রচার করা হয়। ৪১টি বিদ্যালয় বাদ রেখে জাতীয়করণের কাজ থেকে বিদায় হোন সাবেক মন্ত্রী মরহুম মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার। চাহিদা মত ঘুষের টাকা দিতে না পারায় আজও আটকে আছে ৩৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়। যা অনেকটা ‘কেতাবে আছে গোয়ালে নেই’ প্রবাদের মতো। ৩৯টি যাচাই-বাছাইকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয় বিগত সরকার জাতীয়করণ থেকে বঞ্চিত। এ বঞ্চনা শীঘ্রই দূর করা দরকার।

৫. পিটিআই প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের বঞ্চিতদের বাইরে রেখে নিয়োগ দেয়া হয়েছে প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষকদের: ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগবিধির মাধ্যমে পিটিআই প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের বঞ্চিত করে পুরুষ প্রার্থীদের স্নাতক ও নারীদের এইচএসসি পাসের যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে। এর ফলে এইচএসসি পিটিআই পাশ বেশিরভাগ পুরুষ প্রার্থী তাদের শিক্ষকতা পেশায় আবেদন করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। পরবর্তীতে প্রায় ২ হাজার পিটিআই পাস স্নাতক, মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করে বেকারত্বের গ্লানি বয়ে বেড়াচ্ছেন। যেহেতু তারা প্রাথমিকের শিক্ষকতার অভিপ্রায়ে প্রশিক্ষণসহ বিএ, এমএ ও অনার্স ডিগ্রি অজর্ন করেছেন, তাদের শিক্ষক হিসেবে পরিপূর্ণ যোগ্যতা রয়েছে। তারা বিগত সরকারের বঞ্চনার শিকার। যোগ্যতাসম্পন্ন, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এ জনবলকে সরাসরি প্রাথমিক বিদ্যালয় নিয়োগ প্রদানের নিবেদন রইলো।

৬. টাইমস্কেল বঞ্চিত প্রধান শিক্ষকেরা: ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩ এপ্রিল থেকে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ২০ হাজার প্রধান শিক্ষক টাইমস্কেল বঞ্চিত ছিলেন। এদের মধ্যে প্রায় ১৬ হাজার টাইম স্কেল পেয়েছেন। বাকি ৪ হাজার ঘুষ দুর্নীতির বেড়াজালেও তদবিরের কারণে টাইমস্কেল বঞ্চিত।

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২য় শ্রেণির পদটি গেজেটেড/নন গেজেটেড বিষয়ে স্পষ্টীকরণ বিষয়ে ২০২৪ এর ২৪ সেপ্টেম্বরে এক চিঠিতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক বর্ণিত রয়েছে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষকের পদটি ২য় শ্রেণিতে উন্নীতকরণের সময় গেজেটেড হিসেবে উল্লেখ না থাকায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চিঠি অনুযায়ী উক্ত পদটি নন-গেজেটেড কর্মচারী হিসেবে বিবেচিত। সে বিবেচনায় চাকরি বেতন ও ভাতাদি আদেশ ২০০৯ অনুযায়ী তাদের প্রাপ্য টাইম স্কেলসহ বেতন ভাতাদি নির্ধারণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার অনুরোধ স্বত্বেও প্রায় ৪ হাজার প্রধান শিক্ষক টাইমস্কেল বঞ্চিত। এ বৈষম্যমূলক আচরণ দুঃখজনক। বিষয়টি দ্রুত সমাধানের দাবি রাখে। প্রাথমিকের বৈষম্য নিরসনসহ সব বঞ্চনা দূর হোক এ আশাবাদ রাখছি।

লেখক: শিক্ষাবিদ

 

জনপ্রিয়