প্রজাতন্ত্রের প্রশাসন যন্ত্র আসলে কিসের জন্য? ব্রিটিশরা যে পাক-ভারত উপমাহদেশ শাসন করতো তাদের প্রজা ও ভৃত্য বানানোর প্রয়োজন ছিলো। এখনো কি সেই প্রয়োজন আছে? এখন প্রশাসন হবে সত্যিকার অর্থে জনবান্ধব। কে কতো বড়, কে কতো ক্ষমতাবান এইসব প্রশ্ন ও প্রশাসনের ধরন রাষ্ট্র তথা জনগণ কাউকে কোনো সুবিধা দিতে পারে না। হয়তো কিছু লোভী ও অহমিকাসম্পন্ন মানুষদের চেয়ারকে সাময়িক ক্ষমতাবান বলে মনে করাতে পারেন। সেটি কোনো আধুনিক প্রশাসন নয়। জনগণ সেবাটা পেয়েছে কিনা সেই প্রশ্ন, সেই আলোচনা কেউ করছে না। সবাই কোন ক্যাডার কতো বড়, কতো পাওয়ারফুল ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করছে। জনগণ যে রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে বিনা হয়রানিতে কোনো কিছু অর্জন করতে পারছে না সেটি নিয়ে কার্যকরী কোনো কথা নেই। এখন যে, সংস্কারের কথা উঠছে সেখানেও যেসব প্রস্তাব করার কথা সেগুলোও বা কতোটা জনবান্ধব হবে সেটি চিন্তার বিষয়। রাষ্ট্রের কর্তৃত্বমূলক যে মেকানিজম আছে সেটি বাস্তবায়ন করে জনগণের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন একটি অবস্থা তৈরি করে রাজনীতিবিদ তথা কোনো দলকে ফায়দা লোটার এক ধরনের অস্ত্র হচ্ছে আমলাতন্ত্র। রাজনৈতিক সরকার কথায় জনগণের দ্বারা নির্বাচিত বললেও নির্ভর করে আমলাদের ওপর। একজন আমলা দীর্ঘদিন চাকরি করে কিছু প্রাতিষ্ঠানিক স্মৃতি অর্জন করেন এবং জানেন কোন কাজ কতো সময়ে ও কীভাবে করতে হয়। তারা এগুলো করতে গিয়ে কিছু দক্ষতাও অর্জন করেন, যা জনপ্রতিনিধি যারা মন্ত্রী হয়ে আসেন তারা জানেন না। ফলে তারা আমলাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। আর সেখান থেকেই তারা অতি ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন। তারপর যদি সরকার যেনতেন প্রকারে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত না হন তাহলে এই অবস্থা আরো শোচনীয় পর্যায়ে চলে যায়। যেমন বিগত সরকার নির্বাচনের ধার ধারতো না। তাই তারা প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডার দিয়ে সব করতে চেয়েছিলো এবং বেশ কয়েক বছর করেছেও। আর তাই সরকার তাদের অনেক অবৈধ সুবিধা দিয়েছে সব নিয়ম কানুন ভঙ্গ করে। যেমন একজন উপ-সচিব গাড়ি কেনার জন্য ৩০ লাখ টাকার বিনাসুদে ঋণ এবং গাড়ি মেনটেইন করার জন্য মাসিক ৫০ হাজার টাকা ভাতা পাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। এই দরিদ্র দেশে এটি কেনো? এই আমলারা দেশের জন্য, জনগনের জন্য কি করেন? রাষ্ট্রীয় স্মুথ কোনো কাজকে জটিল করা আর জনগনের সামনে প্রভু হিসেবে আবির্ভূত হওয়া ছাড়া তারা আর কী করেন?
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের ১৪টি সাধারণ ক্যাডার এবং ১২টি পেশাগত ক্যাডারের মোট সদস্য সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার জন। ২৬টি ক্যাডারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের সদস্য সংখ্যা ৭ হাজার ৭৬ জন। বিসিএস (স্বাস্থ্য ক্যাডারর সদস্য সংখ্যা ৩২ হাজার জন, বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের সদস্য সংখ্যা ১৫ হাজার ৫০০ জন। বিসিএস (কৃষি) ক্যাডারের সংখ্যা ৩২ হাজার জন, বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের সদস্য সংখ্যা ৩ হাজার ১০০ জন। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। অথচ সংবিধানের এই বিধান লঙ্ঘন করে প্রশাসন ক্যাডার উপ-সচিব ও তদূর্ধ্ব পদে কোটা পদ্ধতি চালুর মাধ্যমে অন্যান্য ক্যাডার সদস্যদের সাংবিধানিক অধিকার অনৈতিকভাবে হরণ করে চলেছে বলে বাকি ২৫টি ক্যাডারের দাবি। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা নীতি নির্ধারণ, পদ না থাকলেও পদোন্নতি, বিদেশ সফর, বিশেষ ক্ষমতাসহ সবধরনের সুযোগ-সুবিধা বেশি ভোগ করে আসছেন। আর প্রশাসন ক্যাডার দাবি করছে উপ-সচিব থেকে সচিব পর্যন্ত পদগুলো তাদের সহজাত ও লাইন পোস্ট। ১০০ শতাংশ কোটা তাদের জন্য সংরক্ষণ করতে হবে ও কোনো প্রকার লিখিত পরীক্ষা গ্রহণ করা যাবে না। অন্যান্য ২৫ ক্যাডার দাবি করছে উপ-সচিব থেকে সচিব পর্যন্ত পদগুলো সরকারের বিশেষ পদ। এই পদে কোনো ক্যাডারের সহজাত বা লাইন পোস্ট নয়। তারা বলছেন শতভাগ পদ উন্মুক্ত রেখে লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে সব ক্যাডার থেকে উপ-সচিব পদে নিয়োগ প্রদান করার কথা, এটি অত্যন্ত যৌক্তিক দাবি।
প্রতিটি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট দক্ষ, অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করার দাবি উঠেছে এটিও অত্যন্ত যৌক্তিক। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব হতে হবে একজন ডাক্তারকে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব হতে হবে একজন শিক্ষককে, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব হতে হবে একজন কৃষিবিদকে এবং একইভাবে একজন প্রকৌশলীকে সচিব বা সিনিয়ব হতে তার মন্ত্রণালয়ের। এখানে প্রশাসন ক্যাডারের সব দখল করে রাখার মধ্যে কোনো যৌক্তিকতা নেই। তারা কোনো বিশেষজ্ঞ নন, তারা শুধু ফাইল চালাচালি করা, জনগণের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে এক ধরনের হামবড়া ভাব দেখানো ছাড়া তেমন কিছুই না। এটি ঔপনিবেসিক আমলের কালচার, সেটি এখন চলবে না। শুধু কি তাই? প্রশাসন ক্যাডার নিয়োগের ৪৪ শতাংশ মেধা কোটায় হলেও ৫৬ শতাংশ কর্মকর্তা নিয়োগ হয়েছেন বিভিন্ন কোটায়। ফলে অন্যান্য ক্যাডারের মেধায় নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা মেধা তালিকায় প্রথম দিকে থাকার পরেও কোটার কারণে প্রশাসন ক্যাডারে জায়গা পাননি। যুক্তরাষ্ট্রের একটি স্টাডি বলছে বিশ্বের সবচেয় ইফিসিয়েন্ট ব্যুরোক্রেটিক টিম হলো সুইজারল্যান্ড এবং এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৯টি দেশের মধ্যে ৭১তম। যুক্তরাজ্যের একটি গবেষণা বলছে, পাবলিক অ্যাডিমিনিস্ট্রেশন ইন্ডেক্সের তালিকায় বাংলাদেশ ১১৮টি দেশের মধ্যে ৯৩তম। এই গবেষণায় পাবলিক পলিসিতেও শোচনীয় অবস্থা বাংলাদেশের। ১২০টি দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান ১১৩তম। এর কারণ হচ্ছে, প্রশাসন ক্যাডার থেকে প্রায় সব উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব, সচিব নিয়োগ হওয়ায় মেধাশূন্য জনপ্রশাসনে সৃজনশীলতা হ্রাস পেয়েছে। এমন যদি হতো যে, শুধুমাত্র মেধাবীরাই অতিরিক্ত সচিব, সচিব এবং সিনিয়র সচিব হয়েছেন তাহলেও কিছুটা মেনে নেয়া যেতো। কিন্তু না। জেলা কোটা, পার্টি কোটা এবং রাজনৈতিক তোষণ তাদের ওইসব পদে বসিয়েছেন। ফলে, প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে বাকি ২৫ ক্যাডারের মারাত্মক ব্যবধান তৈরি হয়েছে, যা সব সময়ই চেপে রাখা হতো। দেশ এখন যেহেতু অন্তর্বর্তী সরকার পরিচালনা করছে, তাই আন্তক্যাডার বৈষম্য বড় করে সামনে এসেছে। আর সরকার জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন করে দিয়েছে।
এই কমিশন বিসিএস শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডার হিসেবে না রেখে এ দুই ক্যাডারকে আলাদা করার সুপারিশ করতে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মতো স্বাস্থ্য ও শিক্ষার জন্য আলাদা কমিশন করার পক্ষে সংস্কার কমিশন। কমিশন প্রধান বলেন, শিক্ষা ক্যাডারটা অযৌক্তিক। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা আলাদা। এটি ক্যাডার রাখা যাবে না। একজন চোখের ডাক্তার, একজন দাঁতের ডাক্তার, আরেকজন জেনারেল ফিজিশিয়ান--তারা একসঙ্গে পাচ্ছেন না। এগুলোকে আলাদা করতে হবে। বেতন বাড়িয়ে দেয়া হোক, এটা বিশেষায়িত বিভাগ। এই দুই বিভাগ ছাড়া বাকি সবই ক্যাডার থাকতে পারবে। মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রদান, কৃত্য পেশাভিত্তিক মন্ত্রণালয় গঠন অর্থাৎ ক্যাডার যার মন্ত্রণালয় তার, এর বাস্তবায়ন, প্রশাসন ও অন্যান্য ক্যাডারের মধো বিদ্যমান বৈষম্য দূর করে সব ক্যাডারের মধ্যে সমতা আনা, পদ আপগ্রেডেশন, পদোন্নতিতে সমান সুযোগ প্রদান, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের সংশোধন ও পুনর্বিন্যাস, বিভিন্ন ক্যাডারের তফসিলভুক্ত পদ থেকে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার ইত্যাদি বিষয়গুলো সুপারিশের মধ্যে রয়েছে। দক্ষ সিভিল সার্ভিস গড়ে তোলার লক্ষ্যে বৈদেশিক প্রশিক্ষণ ও উচ্চতার শিক্ষা বৃত্তির ক্ষেত্রে সমতা আনা, গাড়ি ঋণ সুবিধার বৈষম্য দূরীকরণসহ আন্তক্যাডার বৈষম্য দূর করা প্রয়োজন।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে ক্যাডার বহির্ভূত রাখার সুপারিশ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডার যৌক্তিক কিছু কারণে মানতে চাচ্ছে না। মোট ৬০ হাজার ক্যাডার থেকে কৌশলে সাধারণ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারের ৪৭ হাজার ৫০০ জনকে ক্যাডার বহির্ভূত করতে পারলে অবশিষ্ট ক্যাডার থাকে ১২ হাজার ৫০০ জন যার মধ্যে ৭ হাজার ৭৬ জন প্রশাসন ক্যাডার এবং অবশিষ্ট ২৩টি ক্যাডারের সমষ্টি ৫ হাজার ৪২৪ জন। সেক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত পদগুলো দখলে বর্তমানের চেয়ে সুবিধা হবে। বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার সরকারি কর্মচারী হলেও তারা ক্ষমতার দাপটে উপরোক্ত কোনো ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পাত্তা দিতে চান না। সাধারণ জনগণ তো তাদের কাছে তুচ্ছ। বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণে সব মন্ত্রণালয় শীর্ষ পদ সচিব বা সিনিয়র সচিব থাকার কারণে সরকারের সিভিল সার্ভিসের অন্যান্য ক্যাডার সার্ভিসের অফিসাররা নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্তে অংশীজন হিসেবে অংশগ্রহণ করতে পারছেন না। ফলে সরকারের নীতি নির্ধারণে অহরহ ভুল সিদ্ধান্ত গৃহীত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় যেমন পিছিয়ে যাচ্ছে অন্যদিকে অর্থনৈতিক ক্ষতিরও সম্মুখীন হচ্ছে দেশ।
প্রশাসন ক্যাডারেরএকজন ডিসি ৩০২টি কমিটির সভাপতি এবং একজন ইউএনও ১৬৭টি কমিটির সভাপতি। একজন কর্মকর্তা এতোগুলো কমিটির সভাপতি থাকলে এবং ক্ষমতা কুক্ষিগত হলে যেকোনো ব্যক্তি কাজগুলো সুচারুরূপে সম্পাদন করতে পারেন না, হচ্ছেও তাই। ৩০২টি কমিটির অধিকাংশই তাদের অধিক্ষেত্রের বাইরের বিষয়। কিন্তু তাদের হস্তক্ষেপের কারণে কাজগুলো সঠিকভাবে হচ্ছে না। হওয়ার কথাও নয়। অন্য কর্মকর্তাদের সম্পাদিত কাজে সভাপতিত্ব করে শুধু ক্রেডিট ছিনতাই হয়। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে যোগদানের পর বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় মোট ২২টি মডিউলে। এই ২২টি মডিউল বিসিএস প্রশাসনসহ ২৬ ক্যাডারের একই, প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় মডিউল ধরে ধরে। পরবর্তীতে যে সব প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় সব প্রশিক্ষণে সব ক্যাডার কর্মকর্তাদের সমান্য হিস্যা আছে। সব ক্যাডার নিজ নিজ প্রশাসন পরিচালন করেন, পরিকল্পনা, আর্থিক ব্যবস্থাপনা, সরকারি ক্রয়, নথি ব্যবস্থাপান, বাজেটিং, বাজেটিং নিয়ন্ত্রণ, সমন্বয়, প্রকল্পের ডিপি তৈরি, প্রকল্প বাস্তাবয়ন-পরিচালনা, শৃঙ্খলা রক্ষাসহ সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অংশীজন হিসেবে কাজ করেন। অতএব, প্রশাসন ক্যাডারের মতো অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাগন তাদের নিজ নিজ বিভাগের প্রশাসন পরিচালনা করতে পারবে কিনা সেই প্রশ্ন অবান্তর। শিক্ষা ক্যাডারের মাধ্যমে ৮০ শতাংশ উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীর এবং কমপক্ষে ৬৫ শতাংশ উচ্চশিক্ষায় পড়ুয়াদের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এটির একটি আলাদা মর্যাদা আছে। ক্যাডার হওয়ার কারনে এটি মর্যাদাবান কিন্তু ক্যাডার না হলে সেই মর্যাদা থাকবে না এবং মেধাবীরা এই পেশায় আসতে চাবেন না। এ বিষয়গুলো কমিশনকে ভেবে দেখতে হবে।
লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক