ঢাকা শনিবার, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫ , ৪ মাঘ ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

সংবিধান: ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম রাষ্ট্রধর্ম

মতামত

মোস্তফা আবু রায়হান, আমাদের বার্তা

প্রকাশিত: ০৮:৩০, ১৭ জানুয়ারি ২০২৫

আপডেট: ১৬:০৪, ১৭ জানুয়ারি ২০২৫

সর্বশেষ

সংবিধান: ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম রাষ্ট্রধর্ম

অতীতের অন্ধকার থেকে মানবসমাজের সভ্যতার আলোর পথে যাত্রার একটি নির্দেশক হলো রাষ্ট্রব্যবস্থা। রাষ্ট্র একটি সাধারণ প্রতিষ্ঠান বা জনসঙ্ঘ, যা রাষ্ট্রভুক্ত সব মানুষের। এর সদস্যদের জন্য আলাদা আলাদা যেকোনো বিবেচনা ও মূল্যায়ন প্রচলিত থাকুক না কেনো এই প্রতিষ্ঠানের কাছে সবাই সমান।

আর সংবিধান হচ্ছে এই সংগঠনের গঠনতন্ত্র। সব নাগরিকের সাধারণ সংগঠন হিসেবে এটি কীভাবে চলবে, কী করবে কী করবে না সে সম্পর্কিত বিধিবদ্ধ দলিল। সংবিধান ছাড়াও রাষ্ট্রের থাকে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় অনুষঙ্গ: যেমন রাষ্ট্রীয় নাম, রাষ্ট্রীয় পতাকা, রাষ্ট্রীয় সংগীত, রাষ্ট্রীয় প্রতীক, রাষ্ট্রীয় মনোগ্রাম, বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি।

এখন এই প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের কোনো গ্রুপ যদি তাদের নিজস্ব গ্রুপ-লোগো এই প্রতিষ্ঠানের মনোগ্রামে যুক্ত করতে চায় অথবা তাদের ধর্মীয় সিল এই প্রতিষ্ঠানের গঠনতন্ত্রে, পতাকায় বা সংগীতে মেরে দিতে চায় সেটা কি ন্যায়সঙ্গত হবে? এ রকম যখন কেউ করতে চায় তারা আসলে ‘এই প্রতিষ্ঠান সবার’ এই সত্যকে মানে না।

এরা কেউ নৈরাজ্যবাদী দখলবাজ, কেউ অকাট মূর্খ কুয়োর ব্যাঙ, কেউ উগ্র সুরাগ্রস্ত মাতাল। শতকরার সংখ্যাগুরুত্বের পেশিশক্তিতে সর্বসাধারণের এই প্রতিষ্ঠানটিকে তারা দখল করতে চায়। এভাবে রাষ্ট্রে ও সংবিধানে বিশেষ জাতির বা ধর্মের প্রতীক-চিহ্ন ট্যাগ করে দিলেই অন্য জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মগোষ্ঠীগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংখ্যালঘু হয়ে যায়, বৈষম্যকবলিত হয়ে পড়ে।

রাষ্ট্র কি কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের জন্য? তা না হলে সংখ্যার গুরু-লঘু বিবেচনায় রাষ্ট্রের সংবিধান কারো একটু বেশি কারো একটু কম এমন মনে করার কারণ নেই। ‘রাষ্ট্র’ ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা জরিপের পরিসংখ্যান ব্যুরো নয়। বরং সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু ধারণাকে নাকচ করেই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্র এমনভাবে রচিত হওয়া উচিৎ যাতে সবার সমান অধিকার ও মর্যাদা রক্ষিত হয়।

বহুজাতিক ও বহুধর্মীয় রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্রে বিশেষ কোনো ট্যাগ অন্য মত ও বিশ্বাসের প্রতি অবিচার-বৈষম্যের সূত্র এবং নিরপেক্ষতার অন্তরায় হিসেবে কাজ করবে। তাই বিশেষ ধর্মের চোখ দিয়ে রাষ্ট্রকে দেখলে এবং বিশেষ ধর্মের রঙে রাষ্ট্রের অনুষঙ্গগুলোকে রঙিন করলে তা নাগরিকদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে। ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতায় দেশকে ‘ধর্মরাষ্ট্র’ হিসেবে ভাবার মধ্যে জবরদস্তি আছে। এর মধ্য দিয়েই উদ্ভব হয় ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের। সংখ্যাগরিষ্ঠতার উত্তেজনায় হাঙ্গামা সৃষ্টি করা, দখল করতে চাওয়া ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের লক্ষ্মণ।

অসাম্প্রদায়িক ও বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থার ভাবনা থেকেই বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা যুক্ত হয়েছিলো। ইংরেজি সেকুলার শব্দটির বাংলা ধর্মনিরপেক্ষতা হয়েছে অন্তর্ভুক্তিমূলকতা বা বহুত্ববাদ অর্থে। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটির বড় দুর্বলতা হচ্ছে আমাদের সমাজে এর একটি নেগেটিভ ইমেজ, একটি শ্রুতিগত নেতিবাচকতা তৈরি হয়ে আছে। এটি শুনলেই একদল লোক মনে করেন, হায় হায় গেলো গেলো, জাত রসাতলে গেলো, দেশে আর ধর্ম থাকলো না। সেকুলার রাষ্ট্র ধর্মগুলোকে সাপোর্ট করবে না বা ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা দেবে না, কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র নাগরিকদের ধর্মগুলোকে সমান অধিকার, মর্যাদা ও পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার কথা বলে।

ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় না, মানুষকে ধর্মবিমুখ করে না বরং সব মানুষের সাধারণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্র ও এর গঠনতন্ত্রের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করে। এটি ধর্মকে নির্বাসন পাঠানোর কথা বলেনি কখনো। ধর্ম যেভাবে আছে সেভাবেই থাকবে; কেবল রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের সংবিধানে বিশেষ কোনো ধর্ম-গোষ্ঠীর পতাকা ওড়ানো হবে না। ধর্ম যাতে রাষ্ট্র-কাঠামো ও রাষ্ট্রীয় বিষয়কে প্রভাবিত করতে না পারে তাই রাষ্ট্রকে থাকতে হবে ধর্মীয় কর্তৃত্বমুক্ত। সব নাগরিক যাতে ভিন্নমত ও বিশ্বাস নিয়ে সহাবস্থান করতে পারেন, বাধা ছাড়াই ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পালন করতে পারেন।

ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া মানে নাস্তিক হওয়া নয় বরং অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র ধারণায় বিশ্বাসী হওয়া। তবে ব্যক্তি সাধারণত ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারেন না। রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী ব্যক্তি মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান যা-ই হন, তিনি তার ধর্মের পক্ষেই থাকবেন। আবার ধর্মের পক্ষে থাকা ব্যক্তিরা তাদের ধর্মের টিপ রাষ্ট্রের কপালে মেরে দিতে চাইবেন না। তাই ধর্মনিরপেক্ষতা ব্যক্তির নয়, রাষ্ট্রের হবে। অর্থাৎ রাষ্ট্রে ধর্ম থাকবে কিন্তু রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকবে না। টাকার যেমন কোনো ধর্ম বা লিঙ্গ হয় না, রাষ্ট্রেরও তেমনি। রাষ্ট্রের নাগরিকদের থাকবে ধর্ম, রাষ্ট্রের থাকবে ধর্মনিরপেক্ষতা, সব ধর্মাবলম্বীর প্রতি সমান ও নিরপেক্ষ আচরণ।

সহজ কথায় ধর্মনিরপেক্ষতা হলো রাষ্ট্রের চোখে এমন এক চশমা লাগিয়ে দেয়া যাতে নাগরিকদের ধর্মীয় পরিচয় তার চোখে না পড়ে। যাতে সে ধর্মভেদে ব্যক্তির প্রতি পৃথক আচরণ করার সুযোগ না পায়। তাই ধর্মনিরপেক্ষতার মধ্যে ধর্মের যতোটুকু ‘হীনতা’ আছে সেটুকু রাষ্ট্রের ‘হীনতা’ ব্যক্তির নয়। রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা হচ্ছে, ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’। রাষ্ট্রের গায়ে কোনোরকম ধর্ম-ট্যাগ দিলে এই শ্লোগান মিথ্যা ও অবাস্তব হয়ে যায়। তাই ‘রাষ্ট্র সবার’ এই থিওরি যিনি মানবেন তাকে রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতাও মানতে হবে।

ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম খেতাব দিয়ে অন্যান্য ধর্ম থেকে বাংলাদেশকে আলাদা করে ফেলা হলো ও অন্যান্য ধর্মের তুলনায় শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হলো। প্রথম ধাক্কায় মর্যাদা হারানো অন্য ধর্মগুলো পর মুহূর্তেই আবার রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের সমান মর্যাদা পাচ্ছে কী করে? এ ধরনের তামাশা সংবিধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি দলিলে কল্পনা করা যায়! কেনোনা অনুচ্ছেদ ২ক তো বলছে না, রাষ্ট্রধর্ম একাধিক বা সবগুলো, ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্মকে তো রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে না। এখানে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে কেবল ইসলাম। এই সাংবিধানিক বৈষম্য ও সাংঘর্ষিকতা নিরসন করতে হলে হয় রাষ্ট্রের সকল ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করতে হবে, নয়তো বিতর্কিত রাষ্ট্রধর্ম অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করতে হবে।

এরপর ১২ অনুচ্ছেদ ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রসঙ্গে বলছে, ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য (ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার, (ঘ) কোনো বিশেষ ধর্মপালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার ওপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে’। সব ধর্মকে এড়িয়ে একটি ধর্মকে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ করে নিজের পক্ষে টেনে সব ধর্মের প্রতি নিরপেক্ষ আচরণ হলো কী করে? এতে তো একটি ধর্মকেই রাজনৈতিক মর্যাদা দেয়া হলো, যা রাজনৈতিক উদ্দেশে ধর্মের অপব্যবহারের পথকে সুগম করে। অথচ আবার সর্বপ্রকার বৈষম্য ও সাম্প্রদায়িকতা বিলোপকল্পে রাষ্ট্র কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক বা সাংবিধানিক মর্যাদাদান রহিত করার কথা বলা হয়েছে। যাতে বিশেষ কোনো ধর্ম রাষ্ট্রে আধিপত্য না করতে পারে। আমাদের সংবিধানে যেভাবে বারবার সমমর্যাদা, সমঅধিকার, অসাম্প্রদায়িকতা ও বৈষম্যহীনতার কথা বলা হয়েছে, গোড়ার ‘রাষ্ট্রধর্ম’ তার মুখে এক প্রবল চপেটাঘাত।

আমাদের সংবিধানে সব ধর্মাবলম্বীর সমঅবস্থান ও সমঅধিকার থাকার ব্যাপারটি একটি নিষ্ঠুর প্রহসন। সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ...’ ও ‘রাষ্ট্রধর্ম’ বহাল রেখে রাষ্ট্র নিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক কী করে হয়? প্রশ্ন হলো, সব ধর্মাবলম্বীর সমান অধিকার হলে কেবল একটি ধর্মের মাল-মশলা সংবিধানে সন্নিবেশিত হয় কেনো?

‘রাষ্ট্রধর্ম’ মানে রাষ্ট্রের ধর্ম বা রাষ্ট্রের নিজের ধর্ম। একটি ধর্মকে যদি রাষ্ট্র তার নিজের ধর্ম করে নেয়, তবে অন্য ধর্মগুলো কার হবে? তাদের কী ব্যবস্থা হবে? রাষ্ট্র যদি সব ধর্মানুসারীর হতে চায় এবং সব ধর্মের সমান মর্যাদা, সমান স্বীকৃতি ও নিরপেক্ষ দৃষ্টি দিতে চায় তবে কোনো একটি ধর্মকে সে নিজের বলে ঘোষণা করতে পারে না। ধর্ম থাকবে রাষ্ট্রের অধিবাসীদের, রাষ্ট্রের নয়। সে বিশেষ কোনো একটি ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারে না, বিশেষ কোনো ধর্ম পালন করতে পারে না। রাষ্ট্র ও এর সংবিধান রাষ্ট্রভুক্ত সকার নিরাপত্তা বলয় ও রক্ষাকবচ।

কোনো অঞ্চলের সব মানুষের সামগ্রিক আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভূগোল-ভূপ্রকৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিল্প-সংস্কৃতি ধারণ করেই রাষ্ট্র গঠিত হয়। ‘রাষ্ট্রধর্ম’ সে ক্ষেত্রে তাই একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী ধারণা। ‘রাষ্ট্র’ ও ‘রাষ্ট্রধর্ম’ পরস্পর সাংঘর্ষিক। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র রাষ্ট্র-ধারণারই পরিপন্থি। দেশ বা রাষ্ট্র ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে উঠতে পারে না। ধর্ম যেমন মানুষের চেয়ে বড় হয়ে উঠতে পারে না, সে হিসেবে তা মানুষের সংগঠন রাষ্ট্রের মাথায়ও চড়ে বসতে পারে না। ‘রাষ্ট্রধর্ম’ অনুচ্ছেদ রাষ্ট্রের ভিন্ন ধর্মাবলম্বী সাংবিধানিক নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকারকে স্পষ্টতই ক্ষুণ্ন করে। এতে করে ধর্ম রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে প্রবেশ করে এবং ধর্মকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হয়। এটি তাই আমাদের সাংবিধানিক মূল কাঠামোর পরিপন্থি এবং সাংবিধানিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ।

বাংলাদেশের সংবিধানে এখন আজব তামাশা, একইসঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম হাত ধরাধরি করে চলছে, যা একটি অপরটির সম্পূর্ণ বিপরীত। একটি থাকলে আরেকটি থাকতে পারে না। একজন ব্যক্তি কি চাইলে একইসঙ্গে দুদিকে হাঁটতে পারেন? কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানকে হাঁটানো হচ্ছে রাজনীতির ক্রাচের ওপর ভর করে। ধর্ম তবে এখানে রাজনীতির কোন জায়গায় ঢুকে গেছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। সামরিক শাসকেরা এই যে সাংবিধানিক তেলেসমাতি দেখিয়ে গেছেন তা পরবর্তী কোনো গণতান্ত্রিক সরকার আর শোধরাতে পারেনি। জোড়াতালি দিয়ে, গোঁজামিল দিয়ে, আইন-আদালতের বিচিত্র সার্কাসে তা বহাল রেখেছে। ভোটের রাজনীতির ম্যারপ্যাঁচে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভূত রাষ্ট্র ও সংবিধানের ঘাড় থেকে আর নামানো যায়নি। বিষয়টি আজ এমন জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, কার ঘাড়ে দুইটা মাথা আছে, এই ভূত নামাবে!

এ দেশটা বিশেষ কোনো ধর্মগোষ্ঠীর নয়। তাই মুসলমানও যেমন ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা চাইতে পারে না, হিন্দুও তেমন হিন্দুয়ানি রাষ্ট্রব্যবস্থা চাইতে পারে না। একইভাবে অন্যান্য ধর্মগোষ্ঠীরাও এমন আবদার করতে পারে না। আমরা চাই এ দেশটা মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানসহ সব বিশ্বাসী ধর্ম-সম্প্রদায়ের যেমন হবে, তেমনি হবে অবিশ্বাসী-নাস্তিকসহ সব মানুষের। বিশ্বাস-অবিশ্বাস যার যার, দেশ সবার।

রাষ্ট্রধর্ম অন্যকে নাকচ করে দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে যা একটি কর্তৃত্ববাদী ভাবনা এবং একাংশ নাগরিকদের সাংবিধানিক বঞ্চনা। এটি বহাল রেখে অন্তর্ভুক্তিমূলক সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থা এক সোনার পাথরবাটি। পরিসংখ্যানগত সংখ্যাগরিষ্ঠতার উন্মাদনায় অন্যান্য ধর্মগোষ্ঠীর ওপর আধিপত্য দেখানোর চেষ্টা বা যা ইচ্ছা তাই করা গণতান্ত্রিক নয়; বরং সংখ্যাগরিষ্ঠতার স্বেচ্ছাচারিতা ফ্যাসিবাদী আচরণের বহিঃপ্রকাশ। সংখাগুরুত্বের উচ্ছ্বাস-উত্তেজনা অন্যদের ওপর খবরদারির চেষ্টা করে, সংখ্যালঘুদেরকে দলে ভেড়ানোর ধান্ধায় থাকে। অথচ রাষ্ট্রকে এমন একটি সাধারণ প্রতিষ্ঠান হতে হবে যেখানে সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু ধারণা থাকবে না।

গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তীকালে এখন বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশের শ্লোগান আকাশে-বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। রাষ্ট্র সংস্কারের জন-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। তারা বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশনও গঠন করেছে যার মধ্যে একটি সংবিধান সংস্কার কমিশন। রাষ্ট্র সংস্কারের আগে সবরকমের দ্ব্যর্থকতা-গোঁজামিল-জড়তা ভেঙে স্পষ্টভাবেই নিজেদের প্রশ্ন করতে হবে, আমরা কী ধরনের পরিবর্তন চাই? আমরা আসলেই সব অন্যায় ও বৈষম্যের বিলোপ চাই কি না। প্রথমেই আমাদের একটি জরুরি সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা সত্যিকার অর্থেই এ দেশকে একটি বহু ধর্মের, বহু বিশ্বাসের, বহু সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্তিমূলক বহুত্ববাদী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে চাই কি না।

দেশটা ততোটাই ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর যতোটা বাঙালির, আবার যতোটা মুসলমানের তার চেয়ে একটুও কম নয় অ-মুসলমান জনগোষ্ঠীর। আমার সামনে হিন্দু, পেছনে বৌদ্ধ, ডানে খ্রিষ্টান, বাঁয়ে ইহুদি, এপাশে বনবাসী, ওপাশে পাহাড়ি যেমন-ই আছে, তেমন-ই থাকবে। যেদিন রাষ্ট্রীয় কাগজপত্রে ধর্মের পরিচয় লিখতে হবে না, যেদিন ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটি বিলুপ্ত হবে, সেদিন বুঝতে হবে রাষ্ট্র সবার হয়েছে। রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে সব বৈষম্য দূর হোক, বাংলাদেশ সব মানুষের হোক।

লেখক: কবি ও সংস্কৃতিকর্মী

 

জনপ্রিয়