বদলি বঞ্চিত শিক্ষক-কর্মচারীরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। কালক্ষেপণ না করে দ্রুত প্রজ্ঞাপন সংশোধনের মাধ্যমে সর্বজনীন বদলির দাবিতে আজ জাতীয় প্রেস ক্লাব থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় অভিমূখে শিক্ষকদের অবস্থান ও লংমার্চের কর্মসূচি রয়েছে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের দীর্ঘদিনের দাবি বদলির প্রজ্ঞাপন জারি হলেও তাতে শিক্ষকদের মধ্যে চরম বৈষম্য, বিভাজন ও বিভেদ সৃষ্টি করা হয়েছে।
এ প্রজ্ঞাপনে শুধুমাত্র এনটিআরসিএর মাধ্যমে সুপারিশপ্রাপ্ত শিক্ষকদের বদলির জন্য সুযোগ রাখা হয়েছে। এতে করে বদলি বঞ্চিত নিজ বাড়ি থেকে দূরদূরান্তে চাকরিত অন্যান্য শিক্ষক-কর্মচারীরা অত্যন্ত হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তারই ধারাবাহিকতায় বদলি বঞ্চিত শিক্ষকেরা বৈষম্যহীন, সর্বজনীন বদলির দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি ও লংমার্চের ঘোষণা দিয়েছেন। তাদের এই ন্যায্য দাবি ও অধিকার না মানলে পরবর্তীতে আরো কঠোর কর্মসূচি ঘোষণাও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বদলি বঞ্চিত শিক্ষক-কর্মচারীরা।
আংশিক বা একপেশে বদলির প্রজ্ঞাপনই শিক্ষকদের মধ্যে বৈষম্য, বিভেদ ও একে অপরের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টির কারণ।
বদলিতে শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে বৈষম্য নিরসন ও সর্বজনীন বদলির দাবিতে বদলি বঞ্চিত শিক্ষকেরা তাদের ন্যায্য দাবি ও অধিকার আদায়ের দাবিতে এ সমাবেশ ডেকেছেন। কিন্তু এনটিআরসিএর মাধ্যমে সুপারিশপ্রাপ্ত কতিপয় ‘অসাধু ও দালাল শ্রেণির শিক্ষক’ এ সমাবেশকে প্রতিহত করার হুমকি দিচ্ছেন! শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি প্রতিহত করার তারা কে? তারা প্রকাশ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বিভিন্ন হুমকি-ধামকিমূলক পোস্ট করছেন এবং বিভিন্ন পোস্টে হুমকি দিয়ে কমেন্ট করে যাচ্ছেন। তারা শিক্ষক হয়ে কীভাবে এবং কেনো অন্যান্য শিক্ষকদের হুমকি দেযন? তাদের বিভিন্ন হুমকির বিচারের দাবিতে তাদের হুমকিমূলক পোস্ট এবং কমেন্টর স্ক্রিনশট সংগ্রহ করে রেখেছেন বদলি বঞ্চিত শিক্ষকেরা।
নিজেরা শিক্ষক হয়ে অন্যান্য শিক্ষকদেরকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের বিভিন্ন পেজ ও গ্রুপে এ রকমের হুমকি ও অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করা মেনে নেয়া যায় না। তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তথা মাওশি অধিদপ্তর ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিকট জোরালো দাবি জানান বদলি বঞ্চিত শিক্ষকেরা। এ ছাড়া বৈষম্যহীন ও সর্বজনীন বদলির ন্যায্য অধিকার নিয়ে দাবিকৃত শিক্ষক-কর্মচারীদেরকে তারা ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর বলে আখ্যায়িত করছেন। এই মিথ্যাচার ও মিথ্যা অপবাদেরও তারা বিচার চান।
শিক্ষকদের মধ্যে বৈষম্য, বিভেদ ও একে অপরের প্রতি হিংসা বিদ্বেষের ঘটনাগুলো প্রমাণ করে আংশিক বা একপেশে বদলির প্রজ্ঞাপনই এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য দায়ী। যদি বদলির প্রজ্ঞাপন সর্বজনীন হতো তাহলে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটার সুযোগই সৃষ্টি হতো না। সুতরাং শিক্ষকদের মধ্যে বৈষম্য, বিভেদ, হিংসা ও বিদ্বেষ সৃষ্টিকারী বদলির প্রজ্ঞাপন সংশোধন করে এনটিআরসিএর মাধ্যমে ‘সুপারিশপ্রাপ্ত’ কথাটির পরিবর্তে ‘ইনডেক্সধারী’ শিক্ষক-কর্মচারীদের বৈষম্যহীন ও সর্বজনীন বদলির দাবি জানান বদলি বঞ্চিত শিক্ষকেরা। সেই সঙ্গে ৩.১৬ ধারার বিলুপ্ত চান সব ইনডেক্সধারী শিক্ষক-কর্মচারীরা। শিক্ষা উপদেষ্টার সর্বজনীন বদলির ঘোষণার পরেও কীভাবে আংশিক বদলির প্রজ্ঞাপন জারি হলো তা জানতে চান বদলি প্রত্যাশী শিক্ষকরা।
শিক্ষা উপদেষ্টা ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘সমস্ত শিক্ষকদের স্বার্থ রক্ষা করে স্বয়ংক্রিয় সফ্টওয়্যারের মাধ্যমে সর্বজনীন বদলি বাস্তবায়ন করা হবে।’ উক্ত ঘোষণার ফলে দেশের সব বদলি প্রত্যাশী শিক্ষকেরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে কোন অলৌকিক শক্তির ক্ষমতা বলে শিক্ষা উপদেষ্টার ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে শুধুমাত্র এনটিআরসিএর মাধ্যমে সুপারিশপ্রাপ্ত আংশিক বা একপেশে শিক্ষকদের বদলির প্রজ্ঞাপন জারি করা হলো তা জানতে চান শিক্ষক সমাজ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে গঠিত সরকারের কাছে আমরা শিক্ষকেরা বৈষম্যের অবসান চাই। বদলিতে কোনোভাবেই কোনো বৈষম্য শিক্ষক সমাজ মেনে নেবে না। বদলি প্রত্যাশী সব শিক্ষক-কর্মচারীদের বদলি বাস্তবায়ন সম্ভব কিনা? সারা দেশে বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ইনডেক্সধারী প্রায় ৪ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪০-৫০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর বদলি প্রয়োজন। অথচ বর্তমানে প্রায় ৭০-৯০ হাজার শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। সুতরাং বদলি প্রত্যাশী সব শিক্ষক-কর্মচারীদের বদলি বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
উল্লেখ্য, আমরা বার বার বলে আসছি কমিটির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত সব শিক্ষকের বদলির প্রয়োজন নেই। তাদের অধিকাংশই শিক্ষক বাড়ির কাছে বা নিজ এলাকায় নিয়োগ পেয়েছেন। শুধুমাত্র যারা নিয়োগ বাণিজ্যে ঘুষ দেননি বা ঘুষ দেয়ার সামর্থ্য ছিলো না, দলীয়প্রভাব দেখিয়ে চাকরি নিতে পারেননি, কমিটি বা প্রতিষ্ঠান প্রধানের স্বজনপ্রীতি বা আত্মীয়করণের কারণে নিজ এলাকায় চাকরি নিতে পারেননি-এ রকম কিছু শিক্ষক বাধ্য হয়ে নিজ এলাকা ছেড়ে দূরদূরান্তের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ নিয়েছেন। সারা দেশে এ রকম শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন সর্বোচ্চ ১৫-২০ হাজার, যারা বদলি প্রত্যাশী।
আবার এনটিআরসিএর মাধ্যমে সুপারিশপ্রাপ্ত সব শিক্ষকের বদলির প্রয়োজন নেই। তাদের মধ্যে অধিকাংশই শিক্ষক যারা এনটিআরসিএর শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় বেশি নম্বর পেয়েছেন তারা বাড়ির কাছে বা নিজ এলাকায় নিয়োগ পেয়েছেন। কিন্তু যারা এনটিআরসিএর শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় কম নম্বর পেয়েছেন শুধুমাত্র তারা নিজ এলাকা থেকে দূরদূরান্তে নিয়োগের জন্য সুপারিশ পেয়েছেন। এ রকম বদলি প্রত্যাশী শিক্ষকদের সংখ্যা সর্বোচ্চ ২০-২৫ হাজার। এর বেশি নয়। কারণ, তাদের মধ্যে অনেকেরই চাকরি ২ বছর পূর্ণ হয়নি। সুতরাং তারা বদলির সুযোগ পাবেন না।
বদলি নিয়ে বিভিন্ন গুজব ও অপপ্রচার চলছে। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষরা মনে করেন সর্বজনীন বদলি চালু করা হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক সংকট দেখা দেবে। সবাই রাজধানী ঢাকামুখী হতে চাইবেন। এটা একদম গুজব ও ভিত্তিহীন ধারণা। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা ঢাকামুখী হতে চান না বরং তারা নিজ এলাকা, উপজেলা, জেলা বিভাগে যেতে চান। বদলির প্রজ্ঞাপনে নিজ জেলা এবং নিজ বিভাগে বদলির কথা উল্লেখ রয়েছে। এ ব্যাপারে কোনো শিক্ষক-কর্মচারীরা কোনোরূপ দ্বিমত পোষণ করেননি। সুতরাং উক্ত বিষয়টি গুজব, ভিত্তিহীন, অমূলক ও অপপ্রচার ছাড়া আর কিছুই নয়।
বদলিতে বৈষম্য, নানা নাটকীয়তা ও কালক্ষেপণের অবসান চেয়ে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসেই বদলি বাস্তবায়ন চান এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ইনডেক্সধারী শিক্ষক-কর্মচারীরা।
বদলি প্রত্যাশী শিক্ষক-কর্মচারীরা বদলির জন্য অত্যন্ত ক্ষোভ ও হতাশা নিয়ে বাড়ি ছেড়ে দূরদূরান্তে চাকরি করছেন। দূরদূরান্তে চাকরির করার কারণে শিক্ষকেরা তাদের বৃদ্ধ এবং অসুস্থ মা-বাবার সেবা করতে পারেন না। সেবা তো দূরের কথা মা-বাবাকে কাছে থেকে দেখার সুযোগও তাদের হয় না। এমন অনেক শিক্ষক রয়েছেন যাদের মা-বাবা ও নিকট আত্মীয়স্বজন মারা গেছেন কিন্তু তারা তাদের মা-বাবা এবং নিকট আত্মীয় স্বজনদের জানাযায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি।
যে বদলিতে সরকারের কোনো খরচ নেই সেই বদলি কেনো বাস্তবায়ন করা হয় না তা বদলি প্রত্যাশী শিক্ষক-কর্মচারীরা জানতে চান। অথচ বিভিন্ন সরকারি চাকরিজীবীদের শাস্তিস্বরূপ বদলি করা হয়! এ যেনো এক আজব দেশ! যারা বদলি চান তাদেরকে বদলির সুযোগ দেয়া হয় না আর যারা বদলি চান না তাদেরকে বাধ্যতামূলক বদলি করা হয়! যে বদলির জন্য বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা হতাশায় ভুগছেন, দীর্ঘদিন ধরে মানববন্ধন করছেন, আন্দোলন করছেন, অবস্থান কর্মসূচি ও লংমার্চ করছেন, প্রত্রিকায় লেখালেখি করছেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বারবার স্মারকলিপি দিচ্ছেন, অনুরোধ করছেন তারপরেও সেই বদলি কেনো বাস্তবায়ন করা হয় না তা আজও বদলি প্রত্যাশী শিক্ষকদের কাছে এক রহস্য। বদলি বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে কোনো কালো বিড়ালের হাত আছে কি না সেটাও বদলি প্রত্যাশী শিক্ষকেরা জানতে চান।
মাঝে মাঝে বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা, কারিকুলাম, পাঠ্যবই এবং শিক্ষক-কর্মচারীদের বদলির জন্য লেখালেখি করার কারণে সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষকেরা শুধুমাত্র বদলির বিষয়ে লেখার জন্য আমাকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেন, তাদের বিভিন্ন সমস্যাগুলো তুলে ধরতে বলেন। শিক্ষকদের বিভিন্ন সমস্যা শুনে বদলির বিষয়ে না লিখে থাকতে পারি না। শিক্ষক হিসেবে কর্মরত রয়েছি তাই শিক্ষক সমাজের শত শত সমস্যা সহজেই উপলব্ধি করতে পারি। এমতাবস্থায় আমরা চাই, শিক্ষকদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বদলি বাস্তবায়ন করা হোক যারা দীর্ঘদিন ধরে বাড়ি থেকে দূরদূরান্তে চাকরি করার কারণে শত শত সমস্যায় জর্জরিত।
সবশেষে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট প্রধান কর্তৃপক্ষ শিক্ষা উপদেষ্টার নিকট বিনীত অনুরোধ বদলিতে আর কালক্ষেপণ নয়। চলতি জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই বদলি বাস্তবায়ন করুন। শিক্ষার্থীরা এখনো বই হাতে পাইনি। বই পেতে আরো কিছু সময়ের প্রয়োজন। এই সময়ের মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি বাস্তবায়ন করে শিক্ষকদের শিক্ষাদান করার সুযোগ সৃষ্টি করা হোক।
লেখক: সহকারী শিক্ষক, সৈয়দ আজিজ হাবিব উচ্চ বিদ্যালয়, হবিগঞ্জ