‘গুচ্ছ গুচ্ছ করবীর মতো কিন্তু সূর্যাস্তের জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায় উড়ছে, উড়ছে অবিরাম আমাদের হৃদয়ে রৌদ্র-ঝলসিত প্রতিধ্বনিময় মাঠে চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায়।’ - শামসুর রাহমান।
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন শহীদ আসাদ দিবস। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের গণঅভ্যুত্থানে আত্মত্যাগকারী শহীদ আসাদ এ দেশের গণতন্ত্রপ্রেমী, মুক্তিকামী মানুষের মাঝে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তার আত্মত্যাগ সবসময় আমাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে প্রেরণা যোগাবে। তার পুরো নাম আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান।
তিনি ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জুন জন্মগ্রহণ করেন। আসাদ ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে শিবপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক শিক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জগন্নাথ কলেজে (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন। সেখান থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন।
একজন শহীদ ছাত্রনেতা আসাদ। তবে তিনি সর্বসমক্ষে শহীদ আসাদ নামেই অধিক পরিচিত ব্যক্তিত্ব। আজ ২০ জানুয়ারি। শহীদ আসাদ দিবস। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের এদিনে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন ছাত্রনেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান।
নরসিংদীতে জন্ম নেয়া আসাদের এই আত্মত্যাগ স্বৈরশাসনবিরোধী চলমান আন্দোলনকে বেগবান করে। পরবর্তীতে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পতন হয় স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের। আসাদ শহীদ হওয়ার পর তিন দিনের শোক পালন শেষে ওই বছরের ২৪ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের ছয় দফা ও ছাত্রদের ১১ দফার ভিত্তিতে সর্বস্তরের মানুষের বাঁধভাঙা জোয়ার নামে ঢাকাসহ সারা বাংলার রাজপথে। সংঘটিত হয় উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান। পতন ঘটে আইয়ুব খানের। আরেক স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় বসে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেন। সত্তরের সেই অভূতপূর্ব নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। কিন্তু ইয়াহিয়া ক্ষমতা না ছাড়তে নানা টালবাহানা শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদের আত্মত্যাগ ৬৯ এর আন্দোলনকে বেগবান করে। জেল-জুলুম উপেক্ষা করে স্বাধিকারের দাবিতে সোচ্চার সব শ্রেণি-পেশার মানুষ রাজপথে নেমে আসে। পর্যায়ক্রমে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয় এবং গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। স্বৈরশাসক আইয়ুব ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন, পতন হয় স্বৈরশাসনের। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনে শহীদ আসাদের আত্মত্যাগ আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে। স্বাধিকারের দাবিতে সোচ্চার সব শ্রেণি পেশার মানুষ জেল-জুলুম উপেক্ষা করে রাজপথে নেমে আসে।
পর্যায়ক্রমে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর আকার ধারণ করে। সে দিনের সেই আন্দোলন পরবর্তীতে গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয় এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। মূলত ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ২০ জানুয়ারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদুজ্জামানের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে গণঅভ্যুত্থান ঘটে। তার এই আত্মত্যাগ স্বৈরশাসনবিরোধী চলমান আন্দোলনকে বেগবান করে এবং পরবর্তীতে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পতন হয়। ১৯ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন দুঃসাহসী ছাত্র আইয়ুব শাসনের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে প্রতিবাদ সভা বের করে পুলিশ ও ইপিআরের বাঁধায় প্রত্যেকেই বন্দি হন।
পরদিন ২০ জানুয়ারি ছাত্র-জনতা আবার ১৪৪ ধারা পদদলিত করে অকুতভয়ে পাক পুলিশ-ইপিআরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামে। তবে সেদিন ছাত্রজনতার প্রতিবাদের মুখে পাক প্রশাসন পিছু হটতে বাধ্য হয়।
সব বাঁধা অতিক্রম করে বিরাট শোভাযাত্রাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন থেকে বেরিয়ে শহীদ মিনার হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের দিকে যাচ্ছিলো। সেই শোভাযাত্রার অন্যতম নায়ক ছিলেন আসাদুজ্জামান। শোভাযাত্রা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে এলে তাকে গুলি করে পাক পুলিশ। শহীদ হন টগবগে যুবক আসাদ। তারপর পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে বিপ্লবী ছাত্ররা। আসাদের রক্তাক্ত শার্ট নিয়েই তাৎক্ষিণক মিছিল বের করে ছাত্ররা। প্রবলভাবে বিস্ফোরিত হয় ৬৯-এর গণঅভ্যূত্থান। যুগে যুগে আসাদেরা জীবনের বিনিময়ে স্বৈর শাসন থেকে মুক্তির পথ ত্বরান্বিত করে দিয়ে যায়। আসাদের মতো ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে আবু সাঈদ, মুগ্ধ আর রুদ্রদের প্রাণের বিনিময়ে স্বৈর শাসন থেকে মুক্তি পায় এদেশের মানুষ।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ