পৃথিবীর ইতিহাসে যতোজন বৈপ্লবিক চিন্তা নায়কের আবির্ভাব ঘটেছে তাদের মধ্যে জ্যাঁ জ্যাক রুশো অন্যতম। সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার উদার বাণী ছড়িয়ে তিনি ফরাসী বিপ্লবের নায়ক হয়ে আছেন। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ান একবার বলেছিলেন, রুশো ছাড়া ফরাসি বিপ্লব সম্ভব হতো না। জ্যাঁ জ্যাক রুশো একজন নামকরা দার্শনিক, সমাজ চিন্তক ও লেখক।
১৭১২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সুইজারল্যান্ডের জেনেভোয় জন্মগ্রহণ করেন। রুশো প্রচলিত শিক্ষার বিরুদ্ধে ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রকৃতিবাদী দার্শনিক। তার শিক্ষানীতিকে ‘প্রকৃতিবাদী শিক্ষা’ বলা হয়। ভাববাদী দর্শনের বিকল্প হিসেবে প্রকৃতিবাদের উৎপত্তি। প্রকৃতিবাদী শিক্ষা দর্শনের প্রবক্তাদের মধ্যে রুশো ছাড়া অন্যান্যরা হলেন এরিস্টটল, অগাস্ট কোঁৎ, ফ্রয়েবল, হার্বাট স্পেনসার, মন্তেসরি, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ।
রুশোর প্রকৃতিবাদী শিক্ষা: প্রকৃতিবাদ হলো শিক্ষার্থীর ইচ্ছাশক্তির স্বাভাবিক প্রকাশ। প্রকৃতিবাদ অনুসারে শিশুর শিক্ষালাভের আসল ক্ষেত্র হলো প্রকৃতি। রুশো প্রকৃতি শব্দটি তিনটি অর্থে ব্যবহার করেছেন। এক. মনস্তাত্বিক প্রকৃতি ও শিক্ষা দুই. জীবনতত্ত্বমূলক প্রকৃতি ও শিক্ষা ও তিন. জাগতিক প্রকৃতি ও শিক্ষা। তিনি তার প্রকৃতিবাদে শিক্ষার্থীর মানসিক বৈশিষ্ট্যের ওপর জোর দিয়েছেন।
তিনি দেখিয়েছেন, একটা সময় মানুষ সামাজিক প্রভাবমুক্ত হয়ে প্রকৃতির রাজ্যে বসবাস করতো। তিনি শিক্ষার জন্য প্রাকৃতিক পরিবেশকে শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচনা করেছেন। শহুরে পরিবেশ নয়, গ্রামের পরিবেশই হলো শিক্ষার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান। তার ভাষায়, ‘Nature is the best teacher’. শিশুর উপযুক্ত শিক্ষা লাভের জন্য বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে পরিপূর্ণ ও মুক্তভাবে মেলামেশার সুযোগ দিতে হবে। প্রকৃতির মুক্ত আবহাওয়ায় শিশু শিক্ষা লাভ করবে। প্রকৃতি ঘেরা চারপাশের উপাদান থেকে শিশু হাতে-কলমে শিখবে। চারপাশের নদনদী, গাছপালা, পশুপাখির মতো প্রকৃতির প্রত্যক্ষ পরিচয়ের অভিজ্ঞতা শিশুর শিক্ষার প্রথম ধাপ।
বরাবরই তিনি ক্রমবিকাশের নীতিতে বিশ্বাসী। তিনি তার মৌলিক তত্ত্বে দেখিয়েছেন যে, সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে প্রথম যা আসে তা তখন পবিত্র থাকে। কিন্তু মানুষের হাতে পড়তেই তা বিকৃত হয়ে যায়। জগতই একমাত্র বই, প্রকৃতিই সেরা শিক্ষক ও তথ্যই একমাত্র শিক্ষা। তিনি প্রাকৃতিক ফলাফল তত্ত্বের ওপর জোর দিয়েছেন। শিশু মূলত হাতে কলমে কাজ করে, স্বপ্রণোদিত হয়ে, দেখে ও ঠেকে শিখবে। ভালো বা মন্দ শিশু নিজেই উপলব্ধি করবে। শিক্ষক কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে পারবেন না। শিক্ষকের কাজ হবে অন্তরালে থেকে শিশুকে সাহায্য করা।
রুশোর প্রকৃতিবাদী শিক্ষার স্তর: দার্শনিক রুশো শিক্ষার্থীর জীবনকে শিশুকাল থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত চার শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। জন্ম থেকে পাঁচ বছর প্রথম স্তর, পাঁচ বছর থেকে বারো বছর দ্বিতীয় স্তর, বারো থেকে পনেরো বছর তৃতীয় স্তর ও পনেরো থেকে কুড়ি বছর চতুর্থ স্তর। শিশুদের কৃত্রিমতা থেকে দূরে থাকার শিক্ষার কথা বলেছেন তিনি। শিশুকাল থেকে প্রাকৃতিক পরিবেশে শিশুর স্বভাব অনুযায়ী বিকাশ লাভ করবে। শিশু উন্মুক্ত পরিবেশে আপন মনে নিজের মতো করে খেলবে ও শিখবে। প্রথম জীবনের শিক্ষা হবে প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান নিয়ে। যেমন- হতে পারে গাছের ফুল, ফল, পাতা ইত্যাদি। কোনো প্রকার কৃত্রিমতা নয়, খোলা চোখ ও মন নিয়ে প্রকৃতির নিকট থেকে শিশু বাস্তব অভিজ্ঞতার অধিকারী হবে। ১৭৬২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত ‘এমিল’ গ্রন্থে মেয়েদের শিক্ষা নিয়েও মতবাদ ব্যক্ত করেছেন তিনি। নারীদের ক্ষেত্রেও প্রাকৃতিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
বর্তমান বাস্তবতায় প্রকৃতিবাদী শিক্ষার গুরুত্ব: জলবায়ু পরিবর্তনের এই পরিবর্তনশীল বাস্তবতায় প্রকৃতিবাদী শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। প্রকৃতিবাদী শিক্ষা প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা জাগ্রত করে। শিশু যদি ছোটকাল থেকেই প্রকৃতি থেকে শিক্ষা লাভ করে, প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে গুরুত্ব বুঝতে পারে তাহলে সেই শিশু যতো বড় হবে ততোই প্রকৃতির প্রতি যত্নশীল হবে। যে শিশু প্রকৃতিকে একবার ভালোবেসে ফেলে সেই শিশু প্রকৃতির প্রতি কখনো বিরূপ আচরণ করতে পারে না। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে দেশে দেশে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, দাবানল, তুষারপাত, খরা, বন্যা, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙনসহ বিভিন্ন দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে। জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব মনুষ্যসৃষ্ট কর্মকাণ্ডের ফল-এ কথা এখন প্রমাণিত। প্রকৃতিবাদী শিক্ষা প্রকৃতির ক্ষতি করতে বাধা প্রধান করে। এমন একটা সময়ে আমরা বসবাস করছি যখন প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে মানুষকে। কেনোনা ইতোমধ্যে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিগর্মনের মাধ্যমে পৃথিবী নামক ছোট্ট গ্রহের অনেক বেশি সর্বনাশ করে ফেলেছি আমরা। তাই সময় এসেছে রুশোর প্রকুতিবাদী শিক্ষানীতি প্রয়োগ করার। প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানকে ভালোবাসতে হবে। ভালোবাসতে হবে স্রষ্টা সৃষ্টিকে। শিক্ষার অর্থ শুধু জ্ঞানার্জন নয়, শিশুর স্বভাবজাত শক্তির সন্ধান ও উৎকর্ষ সাধন প্রকৃতিবাদী শিক্ষার মাধ্যমে সম্ভব।
লেখক: শিক্ষক