দেশটা কি তাহলে শুধু এনটিআরসিএর সুপারিশপ্রাপ্ত শিক্ষকদের! একই প্রতিষ্ঠানে ইনডেক্স থাকা সত্ত্বেও বদলি নীতিমালায় অন্যান্য শিক্ষকেরা কেনো উপেক্ষিত হবেন? ৩০ বছরে যে শিক্ষক বদলির জন্য চেষ্টা করেও বদলি হতে পারলেন না। একই প্রতিষ্ঠানের অন্য শিক্ষক মাত্র ২ বছরে বদলি হতে পারবেন এ কেমন আজব নীতিমালা! এমনকি এটা এমপিওনীতিমালা পরিপন্থি। গুটিকয় শিক্ষকের স্বার্থে বদলি নীতিমালা।
হাজারো ছাত্র-জনতার রক্তের দাগ এখনো রাস্তায়-দেয়ালে লেগে আছে। ‘বৈষম্য নিপাত যাক’। ‘লাখো শহীদের বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই।’, ‘লাখো শহীদের রক্তে কেনা, দেশটা কারো বাপের না।’ যে শ্লোগান-আন্দোলনে ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সম্মিলিত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পদত্যাগ করে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন।
এরই মধ্য দিয়ে তার ১৫ বছরেরও বেশি সময়ের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে। কচি-কচি তাজা প্রাণের বিনিময়ে স্বৈরাচার মুক্ত দেশ হলো। এই তো মাত্র কয়েক দিনের আগের ইতিহাস। ইতিহাসের সব চেয়ে বড় শিক্ষা ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। জনগণ স্বপ্ন দেখে বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশের। নতুন করে আর কোনো বৈষম্য হবে না। আবু সাঈদ-মুগ্ধের রক্তের দাগ এখনো শুকায়নি। এর মধ্যে দুইবার বৈষম্যমূলক বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রকাশ করা হলো।
প্রথমটা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের আমলাদের কূটবুদ্ধির ফল। আমলাদের ইচ্ছায় পারস্পরিক বদলির নীতিমালা জারি হলো ১১ আগস্টে। প্রবল আপত্তির মুখে তা স্থগিত করা হলো। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়েও আবারও আমলাদের ইচ্ছায় জারি হলো খণ্ডিত ও বৈষম্যমূলক বদলি নীতিমালা। এতে শুধু এনটিআরসিএর সুপারিশপ্রাপ্ত ইনডেক্সধারী শিক্ষকেরা বদলি হতে পারবেন। অন্যান্য শিক্ষকেরা ইনডেক্স থাকা সত্ত্বেও বদলি হতে পারবেন না। এটা চরম অমানবিক। ফ্যাসিস্ট সরকারকেও হার মানিয়েছে এই বদলি নীতিমালা। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কমনরুমে সংঘাত ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
পাহাড়সম বৈষম্য বেসরকারি শিক্ষাখাতে। নতুন করে আরেক বৈষম্যের শিকার বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশে। আর কতো রক্ত ঝরলে বৈষ্যমমুক্ত হবে! বলছিলাম বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালায় ভয়াবহ বৈষম্যের কথা। একই প্রতিষ্ঠানে, একই পরিচয়ে কেউ বদলি হবে, কেউ হবে না। এ রকম বৈষম্য, বৈষম্যবিরোধী দেশে কাম্য নয়। অবশ্য এর শুরুটা স্বৈরাচার শাসন আমল থেকে হয়, যা এখনো একের পর এক নাটক হচ্ছে বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নিয়ে। এই রঙ্গমঞ্চের শেষ কোথায়?
২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের উদ্যোগটাও ভেস্তে যায় আমলাদের কারণেই। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে নতুন করে শুরু হয় বদলির কর্মশালা থেকে। ওই কর্মশালায় বলা হয় বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি জটিল, ওসব শিক্ষক নাকি শহরে চলে যাবেন। যারা বলেছেন তারা প্রশাসন ও শিক্ষা ক্যাডারের আমলা। তাদের ইচ্ছায় শুধুমাত্র এনটিআরসিএর সুপারিশপ্রাপ্ত ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের বদলি চালুর কথা বলা হয়। অথচ সেই আমলারা ঢাকায় থাকার জন্য, ভালো বদলি ও পোস্টিংয়ের জন্য ঘুষ, দেনদরবারসহ কি-না করেন?
যাহোক এরপর থেকে বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নিয়ে চলছে নাটকের পর নাটক। ৩০ বছর পর বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি চালুর জন্য ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের ২২ অক্টোবর বদলি চালু নিয়ে প্রথম কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। প্রাথমিকভাবে এমপিও শিক্ষকদের শূন্যপদের বিপরীতে বদলির সুযোগ দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য বদলি নীতিমালার খসড়া প্রস্তুত করার সিদ্ধান্ত হয়েছিলো।
এক সময় কর্মশালা স্থগিত হয়। আবার কর্মশালা হয়। কর্মশালার পর কর্মশালা হয়। তারপর বাধা পায় বদলি প্রক্রিয়া। বলা হয়, বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি জটিল। বদলি হলে গ্রামের শিক্ষক শহরে চলে যাবেন। গ্রামের বিদ্যালয়ে শিক্ষক থাকবেন না। এখন প্রতিটি গ্রামে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ শিক্ষক পদ খালি। এটা কোনো নিয়মে হয়েছে। এই খবর আপনারা রাখেন না। আর বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি চালুর দাবি জানালে নানান অজুহাত। আমরা শিক্ষকেরা নিজ বাড়িতে যেতে চাই, তারা সেটা বুঝেও না বোঝার ভান করেন। অন্যদিকে বদলি জটিল বা বদলি চালু হলে সব শিক্ষক নাকি গ্রাম ছেড়ে শিক্ষকেরা শহরে চলে আসবেন। যেখানে শিক্ষকেরা বদলি হয়ে নিজ বাড়িতে বা কাছাকাছি যেতে চান, কর্মকর্তারা ভাবছেন তারা শহরে চলে যাবেন। আসলে বদলি না দেয়ার পাঁয়তারা।
অবশেষে ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ১১ আগস্ট এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রকাশ হয়। বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রকাশ করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ। নীতিমালা অনুযায়ী, শুধু মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের, মহাপরিচালক, পারস্পারিক বদলির আবেদন নিষ্পত্তি করতে পারবেন। বদলির ক্ষেত্রে সাধারণ শর্ত। শুধু সমপদে কর্মরত দুইজন শিক্ষকের লিখিত সম্মতিপত্রসহ পারস্পারিক বদলির আবেদন বিবেচনা করা হবে। এখান থেকে শুরু হয় বৈষম্যমূলক বদলি চালুর নীতিমালা। আবারো বদলি নীতিমালা হতাশ করলো শিক্ষকদের। এ নীতিমালায় বলা হয় শুধু এনটিআরসিএ সুপারিশ প্রাপ্ত শিক্ষকেরা বদলি হতে পারবেন। অধিকাংশ শিক্ষকেরা ক্ষোভ ও হতাশায় ভেঙে পড়েন।
গত বছরের ১ নভেম্বর থেকে চালু হওয়া পারস্পরিক বদলির আবেদন প্রক্রিয়া সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে বলে জানান তারা। সেই সঙ্গে সংশোধন ও পরিমার্জন এমনকি সবার স্বার্থ সংরক্ষণ করে বদলি নীতিমালা প্রকাশ করা হবে। এতে আবার শিক্ষকেরা আশায় বুক বাঁধেন। কিন্তু পুনরায় বৈষম্য বদলি নীতিমালা হতাশ করলো অধিকাংশ শিক্ষকদের। পাস্পরিকের স্থলে শূন্যপদে বদলি চালুর নীতিমালা প্রকাশ করা হয়। এতে আরো বলা হয়, শুধু এনটিআরসিএর সুপারিশপ্রাপ্ত শিক্ষকেরাই আবেদন করতে পারবেন। তাও বছরে একজন শিক্ষক বদলি হতে পারবেন। এ বদলি নীতিমালা প্রকাশে শিক্ষকেরা হতাশাগ্রস্ত হন। এমনকি এনটিআরসিএর শিক্ষকরাও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এমন বদলি নীতিমালা তারাও চান না।
গত ৮ জানুয়ারি পরিকল্পনা ও শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, এ বছর থেকেই এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজের সব শিক্ষকদের স্বয়ংক্রিয়ভাবে বদলি করা হবে। তখনই শিক্ষকেরা আবার আশার আলো দেখেন। আশা করি সব ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের সর্বজনীন বদলি চালু হবে। এতে কোনো বৈষম্য হবে না। বদলি হোক সব শিক্ষকের। কে কীভাবে নিয়োগ হয়েছেন তা খোঁজাখুজি না করে সব ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের বদলি হোক। কে কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ, কে এনটিআরসিএ সনদধারী নিয়োগ, কে এনটিআরসিএ সুপারিশপ্রাপ্ত নিয়োগ--এ পরিচয়ে বিভাজন এবং বদলির ক্ষেত্রে বৈষম্য কাম্য নয়। বদলি নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যেও বিভাজন ও অশোভন আচরণ যা কিনা শিক্ষকদের জন্য নিন্দনীয়। বরং সর্বজনীন বদলি চালু হলে শিক্ষকদের মধ্যে একতা তৈরি হবে। শিক্ষকেরা পাঠ দানে মনোযোগী হবেন। শিক্ষাপ্রতিষ্টানে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। আর যদি শিক্ষকেরা পাল্টা-পাল্টি কর্মসূচি দেন তাহলে দুই পক্ষের কর্মসূচিতে নীতিমালা বাতিল হয়ে বদলি চালু স্থগিত হতে পারে। যেভাবে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে একবার বদলি নীতিমালার খসড়া করা হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি।
একটা অংশের বদলি প্রয়োজন। অন্যান্য শিক্ষকদের রেখে এই উদ্ভট চিন্তা আসে কিভাবে! যে শিক্ষক বদলি হতে পারবে না এটা কি তার দোষ, না নিয়োগ পদ্ধতির দোষ। নিয়োগ পদ্ধতি একেক সময় একেক রকম ছিলো। সবাই কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ। সব শিক্ষকের ইনডেক্স আছে, তাহলে আর বিভাজন কেনো? সব শিক্ষকই নিজ পছন্দের জায়গায় শিক্ষকতা পেশায় এসেছেন বা নিজের পছন্দের জায়গায় না আসলেও সব শিক্ষকের বদলির প্রয়োজন আছে। বদলি যেকোনো শিক্ষকের প্রয়োজন, প্রয়োজন নাই তা বলা যাবে না। ৫০০/৮০০ কিলোমিটার দূরে যে শিক্ষক আছেন, তারও বদলি দরকার। আবার যিনি ৪০/৫০ কিলোমিটার দূরে আছেন সেই শিক্ষকেরও বদলি দরকার। এক বিভাগ থেকে যিনি অন্য বিভাগে আছেন সেই শিক্ষকেরও বদলি দরকার। আবার যিনি নিজ জেলায় আছেন, বা নিজ উপজেলায় আছেন সেই শিক্ষকেরও বদলি দরকার। তাই বলবো সব শিক্ষকদের বদলি দরকার।
বৈষম্যহীন দেশে কোনো বৈষম্যমূলক বদলি চাই না বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এখনো দেয়ালে-দেয়ালে গ্রাফিতি ভেসে আছে বৈষম্যবিরোধী শ্লোগানে। বৈষম্য নিপাত যাক, সর্বজনীন বদলি মুক্তি পাক। বেসরকারি শিক্ষকদের সর্বজনীন বদলি চালু জন্য শিক্ষকদের ঘুম নেই, শিক্ষকেরা অস্থির সময় পার করছেন। সামান্য আয় দিয়ে পরিবার চলে না। অনেকে শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন। অনেক পরিবার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাচ্ছে স্বামী-স্ত্রী দূর-দূরান্তে চাকরির জন্য। শিক্ষকেরা রাজপথ থেকে সচিবালয়, মন্ত্রাণালয় থেকে উপদেষ্টা, আন্দোলন, মানববন্ধন, স্মারকলিপি কোনো কিছুই বাদ রাখেনি। আবারও বলছি সব শিক্ষকের স্বার্থ সংরক্ষণ করে সর্বজনীন বদলি চালুর দাবি জানাই।
লেখক: সহকারী শিক্ষক, তাড়ল উচ্চ বিদ্যালয় দিরাই, সুনামগঞ্জ