‘অচিরেই আল্লাহ মুমিনদের পূর্ণ বিজয় দান করবেন কিংবা তার পক্ষ হতে এমন কিছু দেবেন যাতে জালিমরা তাদের অন্তরে যা লুকিয়ে রেখেছিলো তার কারণে লজ্জিত হয়’-সূরা আল-মায়েদা।
‘ইসরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদিওন সা’আর ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের বিরুদ্ধে তাদের পরাজয় স্বীকার করেছেন। ইসরায়েলি টিভি চ্যানেল-১২-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম জানায়, ইসরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদিয়ন সা'আর তার এক বক্তৃতায় স্বীকার করেছেন, যদিও জিম্মিদের ব্যাপারে আমাদের অত্যন্ত গুরুদায়িত্ব ছিলো, তবু কয়েক মাস ধরে আমরা একজন জিম্মিকেও জীবিত ফেরত আনতে পারিনি। সেইসঙ্গে আমরা হামাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কোনো লক্ষ্যও অর্জন করতে পারিনি।
ইসরায়েলি শিক্ষামন্ত্রী ইয়াভ কিশও গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির কথা উল্লেখ করে এক বিবৃতিতে বলেছেন, হামাসের সঙ্গে চুক্তির জন্য আমাদের অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ইসরায়েলি নৌবাহিনীর সাবেক কমান্ডার ইয়েদিদিয়া ইয়াঅরি আরো বলেছেন, গাজার বিজয় আমাদের জন্য পরিপূর্ণ পরাজয়ে পরিণত হয়েছে।
ইয়াঅরি আরো বলেন, গাজা যুদ্ধ শেষ হবে, কিন্তু হেগের গল্পসহ ইসরায়েলের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক ও বিচারিক সুনামির পালা শুরু হবে। ওই সুনামি শেষ পর্যন্ত একটি বিপর্যয়ে পরিণত হতে পারে। বিচারিক সুনামির পালা শুরু হবে। ওই সুনামি শেষ পর্যন্ত একটি বিপর্যয়ে পরিণত হতে পারে।
গত ১৫ জানুয়ারি কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তির ঘোষণা দিয়েছে। ওই ঘোষণায় বলা হয়েছে: যুদ্ধবিরতি চুক্তি গত রোববার থেকে বাস্তবায়িত হবে এবং ওই চুক্তির ভিত্তিতে হামাস ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তির বিনিময়ে বেশ কয়েক ধাপে ৩৩ জন ইসরায়েলি বন্দিকে মুক্তি দেবে। চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো ইহুদিবাদী ইসরায়েলকে গাজা উপত্যকা থেকে সরে যেতে হবে।
প্রায় ১৫ মাস ধরে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যা চালিয়েও হামাসের নেটওয়ার্ক ধ্বংস কিংবা জিম্মি ইসরায়েলিদের উদ্ধার করতে পারেনি আইডিএফ। জেরুজালেমে ইহুদি সেনাদের অবৈধ অনুপ্রবেশ এবং মুসলমানদের নিগ্রহ, ধারাবাহিক ভূমি দখল ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের ৭ আগস্ট হামাসের অপারেশন আল আকসা ফ্লাড পরিচালিত হয়। কয়েক হাজার হামাস যোদ্ধা অভিনব পদ্ধতিতে ইসরাইলে প্রবেশ করলে সম্মুখযুদ্ধে প্রায় ১ হাজার ২০০ ইসরায়েলি নিহত হয়। কয়েকশ’ সামরিক-বেসামরিক ইসরাইলিকে বন্দি করে গাজায় নিয়ে যায় হামাস। সেই বন্দি বা জিম্মিদের মুক্তি এবং হামাসকে নির্মূল করার ইস্পাত কঠিন শপথ নিয়ে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু নজিরবিহীন যুদ্ধ ঘোষণা করে প্রতিদিন শত শত টন বোমা ফেলে গাজাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে; সেখানে স্থল অভিযান চালিয়ে হামাসের টানেল নেটওয়ার্ক ধ্বংসের ঘোষণা দেয়। যুদ্ধের কোনো নিয়ম-নীতি না মেনে বেসামরিক মানুষ হত্যা, খাদ্য, পানি, বিদ্যুৎ, জ্বালানিসহ সব ধরনের সরবরাহ বিচ্ছিন্ন করে, বাড়িঘর, জনপদ, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, মসজিদ, গির্জা, খাদ্য গুদাম, খেত-খামার, আশ্রয়কেন্দ্রসহ সবকিছু ধ্বংস করে দিয়ে সেখানে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করা হয়। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইসরায়েলি নেতাদের যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করেছে। যুদ্ধের শুরুতেই মধ্যপ্রাচ্য এবং পশ্চিমা বিশ্বের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ শহরের হাজার হাজার মানুষ যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব ও জিম্মি মুক্তি ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে রাস্তায় নামলেও ইসরায়েলের যুদ্ধবাজ সরকার হামাস-হেজবুল্লাহকে ধ্বংস করে জিম্মিদের মুক্ত করা ছাড়া অন্য কোনো প্রস্তাব মানবেন না বলে বার বার দৃঢ় সংকল্প প্রকাশ করেছিলেন। দেশি-বিদেশি চাপে গত বছর এক দফায় ৭ দিনের যুদ্ধবিরতিতে কিছু বন্দি বিনিময় ছাড়া আইডিএফ একজন জিম্মিকেও মুক্ত করতে পারেনি। এমন ব্যর্থতার গ্লানি মাথায় নিয়ে অবশেষে ইসরায়েল হামাসের শর্ত মেনে যুদ্ধ বিরতি চুক্তি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে।
কাতার, মিশর ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় গাজায় একটি যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব নিয়ে মাসের পর মাস কুটনৈতিক দর কষাকষি এবং আলোচনা চলা সত্ত্বেও গাজায় গণহত্যা একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। একটি যুদ্ধ বিরতিতে উপনীত হওয়ার আগে গত ১৫ মাসে গাজায় ৪৭ হাজারের বেশি মানুষকে নির্বিচার হত্যা করা হয়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত ১ লাখ ২০ হাজার মানুষ। গাজার ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ এই যুদ্ধে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। সর্বাত্মক ব্লকেড, বোমা বর্ষণ, স্থল হামালার ধ্বংসযজ্ঞ ও টার্গেটেড কিলিংয়ের মধ্য দিয়ে গাজার ২৩ লাখ বাসিন্দা চরম খাদ্য সংকট ও দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়েও প্রিয় মাতৃভূমি ও আল আকসার মুক্তির প্রশ্নে শহীদি তামান্না, হামাসের প্রতি তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন ও জাতীয় ঐক্য ইন্দ-মার্কিন সমর্থিত জায়নবাদী যুদ্ধাপরাধীদের পিছু হটতে বাধ্য করেছে। হামাসের অকুতোভয় যোদ্ধা, ফিলিস্তিনের নারী-শিশুসহ প্রত্যেক নাগরিক দেশপ্রেম ও ইমানি চেতনার এক সুমহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। হামাস-হেজবুল্লা-হুতিসহ ইরান সমর্থিত প্রতিরোধ যোদ্ধাদের রকেট হামলায় ইসরায়েলের লাখ লাখ অধিবাসী দেশ ছেড়ে ইউরোপ-আমেরিকায় পাড়ি জমালেও মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও গাজার অধিবাসীরা নিজেদের মাটি ছেড়ে পালিয়ে যায়নি। ‘বাঁচলে এখানেই বাঁচব, মরলে এখানেই মরবো’ এমন পণ করেই তারা যুদ্ধের বিভীষিকার সাক্ষী হয়ে, স্বজন হারিয়ে, বাস্তু হারিয়ে যুদ্ধ জয়ের মিছিলে সামিল হতে হয়েছে। গাজার মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ের এক নতুন ইতিহাস রচনা করেছে। আলোচিত যুদ্ধ বিরতি চুক্তিতে উভয় পক্ষের সম্মতিকে হামাস ও গাজাবাসীর বিজয় হিসেবে দেখা হলেও ১৫ জানুয়ারিতেও গাজায় বোমা হামলা ও গণহত্যা অব্যাহত ছিলো। আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাপে হামাসের শর্ত মেনে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব মেনে নিলেও যুদ্ধাপরাধী ইসরায়েল যুদ্ধ বিরতির চুক্তি কতোটা মেনে চলবে, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে।
আরবদের জমি দখল করে ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ ও শান্তির আলোচনা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী এজেন্ডা বা নীলনকশার অংশ। বাইডেন প্রশাসন একদিকে পনের মাস ধরে যুদ্ধ বিরতির নাটক করেছে, অন্যদিকে ইসরায়েলকে আরো বেশি আগ্রাসী হয়ে উঠতে ম্যাস ডেস্ট্রাক্টিভ যুদ্ধাস্ত্র, যুদ্ধ বিমান, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং শত শত কোটি ডলারের সামরিক বাজেট সহায়তা দিয়ে যুদ্ধকে সচল রেখেছে। বিগত নভেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেনের পরাজয়ের পেছনে নেতানিয়াহুর যুদ্ধনীতির প্রতি তার নিঃশর্ত সমর্থন এবং ইউক্রেনের যুদ্ধ পরিস্থিতির প্রভাব থাকার কথা বলা হয়। যদিও নেতানিয়াহুর গ্রেটার ইসরাইল পরিকল্পনা এবং মধ্যপ্রাচ্যকে নতুন যুদ্ধের ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেয়ার জন্য ডোনাল্ট ট্রাম্পের প্রথম পর্বে জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থাপন, আব্রাহাম অ্যাকর্ড, ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি এবং ইরানের সঙ্গে ৬ জাতির পারমানবিক সমঝোতা চুক্তি থেকে একতরফাভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহারকে দায়ী করা যায়। তবে এবারে দুই পক্ষকে একটি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত করার কৃতিত্ব দাবি করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। হোয়াইট হাউজ বা জো বাইডেনের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো বার্তা প্রকাশিত হওয়ার আগেই ডোনাল্ড ট্রাম্পই প্রথম হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ বিরতির সংবাদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। হামাসের সঙ্গে বন্দি বিনিময় চুক্তিতে উপনীত হতে সহায়তার জন্য ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু জো বাইডেন এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। কাতারের প্রধানমন্ত্রীর বরাতে প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়, প্রথম দফায় হামাস ৩৩ জন জিম্মিকে মুক্তি দেবে। এর মধ্যে স্থায়ী যুদ্ধ বিরতির আলোচনা সফল হলে বাকি জিম্মিদেরও মুক্তি দেয়া হবে। পরবর্তী ধাপে যুদ্ধে মৃত জিম্মিদের লাশ হস্তান্তর এবং গাজা পুনর্গঠনের কার্যক্রম শুরু হতে পারে। তবে সবকিছু নির্ভর করছে উভয়পক্ষ, বিশেষত ইসরাইলের যুদ্ধ বিরতি চুক্তি মেনে চলার ওপর। পশ্চিমা বিশ্বের পুরো সমর্থন ও সামরিক সহায়তা নিয়ে ইসরায়েল গাজা ও লেবাননে নৃশংস গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করেছে। কিন্তু হামাস বা হেজবুল্লাহর বিরুদ্ধে কোনো কৌশলগত বিজয় লাভ করতে পারেনি। উপরন্তু ইরানের মিসাইল হামলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। বিশ্ব সম্প্রদায়কে অবশ্যই যুদ্ধাপরাধের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে স্থায়ী যুদ্ধ বিরতি, গাজা পুনর্গঠন এবং ৬৭ খ্রিষ্টাব্দের পূর্ববর্তী সীমারেখার আলোকে পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দ্বিরাষ্ট্রকেন্দ্রিক সমাধানের বাস্তবায়ন করতে হবে। গাজা ও ফিলিস্তিনের সংগ্রামী জনগণ এবং হামাস-হেজবুল্লাহসহ প্রতিরোধ অক্ষগুলোর প্রতি আমাদের আন্তরিক মোবারকবাদ বা শুভ কামনা রইলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইসরায়েল বাহিনী সবচেয়ে বেশি মানবিক বিপর্যয় ঘটান ফিলিস্তিনের গাজা গণহত্যা মাধ্যমে। তারপরও হামাস এবং গাজার ভুক্তভোগী শিশুসহ বিভিন্ন বয়সী মানুষের মনোবল কোনো ক্রমেই ধ্বংস করতে সক্ষম হয়নি। ইসরায়েল বাহিনী শুধু গাজায় হামাসের নিকট পরাজিত হয়নি, আন্তর্জাতিক বিশ্বেও চরমভাবে পরাজিত হয়েছে। কিন্তু হামাস প্রতিরোধ বাহিনী শুধু গাজায় বিজয় লাভ করেনি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের আন্তরিক সমর্থন লাভ করতেও সক্ষম হয়। প্রায় লক্ষাধিক গাজাবাসীর প্রাণের বিনিময়ে হামাস ইসরায়েল বাহিনীকে পরাজিত হতে বাধ্য করেছে। কিন্তু লক্ষাধিক গাজাবাসীর প্রাণহানী ঘটলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ের পাশাপাশি বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বের লক্ষাধিক তরুণ প্রজন্ম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয়গ্রহণ করে জীবনের সত্যিকারের স্বাদ উপভোগ করতে সক্ষম হয়। মহান আল্লাহ তাআ’লা যেকোনো প্রতিকূল পরিবেশে ইসলামের অনুসারী হিসেবে মুসলমানদের জীবনের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করবেন-এতে কোনো সন্দেহ নেই। ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ যোদ্ধা হামাস বাহিনীর প্রতি আমাদের অবিরাম শুভকামনা। ভবিষ্যতে হামাস প্রতিরোধ যোদ্ধার মাধ্যমে ফিলিস্তিনের চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জিত হবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও এনজিও ব্যক্তিত্ব