ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫ , ৯ মাঘ ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

প্রাথমিক শিক্ষায় আমলা নির্ভরতা কমাতে হবে

মতামত

মাছুম বিল্লাহ, আমাদের বার্তা 

প্রকাশিত: ০৮:০০, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫

সর্বশেষ

প্রাথমিক শিক্ষায় আমলা নির্ভরতা কমাতে হবে

বিশ্বে যেকোনো দেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে বিবেচনা করা হয় শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হিসেবে। কারণ, এ ধাপের শিক্ষার মানের ওপর নির্ভর করেই শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও দক্ষতার ভিত গড়ে ওঠে। উন্নত বিশ্বে এ পর্যায়ের শিক্ষা গুরুত্ব পায় সবচেয়ে বেশি। কিন্তু আমাদের দেশে এ পর্যায়ের শিক্ষাকে কখনই কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় গুরুত্ব দেয়া হয়নি। দেশে প্রাথমিক শিক্ষাখাতকে দীর্ঘদিন ধরে যেসব সংকট মোকাবিলা করতে হচ্ছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে বহু ধারার শিক্ষাব্যবস্থা, দক্ষ শিক্ষকের অভাব, শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি, রাজনৈতিক প্রভাব, কারিকুলাম ও পাঠদানের দুর্বলতা, মূল্যায়ন পদ্ধতির দুর্বলতা ও নীতি নির্ধারণী দুর্বলতা। প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন করতে চাইলে প্রথমে এ জায়গাগুলোয় উন্নয়ন করতে হবে। এসব সংকট মোকাবিলার পাশাপাশি খাতটিতে প্রয়োজনীয় সংষ্কার আনতে নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে অভিজ্ঞতার আলোকে দূরদর্শী পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য। কিন্তু বর্তামন বাস্তবতায় এ বিষয়ে সংশয় রয়ে গেছে। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষকদের বেতন কাঠামো মানসম্মত নয়, ফলে মেধাবী শিক্ষকেরা এখানে থাকতে চান না।

এ ছাড়া আমাদের মূল্যায়ন ও পাঠ পদ্ধতিতে সংস্কার প্রয়োজন। একই সঙ্গে নীতিনির্ধারণের জায়গাগুলোয় মাঠ পর্যায়ে যারা কাজ করছেন, তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এসব সংস্কার না করে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন সম্ভব নয়। প্রাথমিক শিক্ষা পরিসংখ্যান ২০২৩ অনুযায়ী দেশে বর্তমানে অন্তত পাঁচ ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা এবং ১১ ধরনের বিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিদ্যালয়ের পঠন-পাঠন পদ্ধতিতে পার্থক্য থাকায় শিক্ষার্থীদের দক্ষতায় বড় ধরনের পার্থক্য তৈরি হচ্ছে যা প্রাথমিক শিক্ষায় বড় সংকট সৃষ্টি করেছে। জুলাই গণ-অভুত্থানের পর অন্তর্বতী সরকারের পক্ষ থেকে এ থেকে উত্তরণে এখনো কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

২০১৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ধাপে ধাপে ২৬ হাজারের বেশি এমপিওভুক্ত রেজিস্টার্ড, আনরেজিস্টার্ড ও কমিউনিটি বিদ্যালয় সরকারীকরণ করা হয়। এদের মধ্যে প্রায় ২১ হাজার শিক্ষক ছিলেন কাম্য যোগ্যতাবিহীন। বার বার সময় দেয়ার পরও তারা কাম্য যোগত্যা অর্জন করতে পারেননি। আবার অনেক স্কুলে ছিলো নামমাত্র শিক্ষার্থী। গোঁজামিল দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য দিয়ে স্কুলগুলো চালাচ্ছেন কিছু শিক্ষক। তারা বেতন-ভাতাও পাচ্ছেন। শিক্ষা অধিদপ্তর ও ইউনিসেফের ন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্ট-২০২২’ অনুযায়ী তৃতীয় শ্রেণির ৫১ শতাংশ ও পঞ্চম শ্রেণির ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলায়ও দুর্বল। শেষোক্তদের মানও তৃতীয় শ্রেণির উপযোগী নয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যারা এনজিও পরিচালিত স্কুল ও মাদরাসায় পড়েন, তাদের তুলনায় সরকারি ও বেসরকারি স্কুলের শিক্ষার্থীরা তুলনামূলকভাবে ভালো করেছেন। যে শিশুরা পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি অন্যান্য বই পড়েন, তাদের দক্ষতা তুলনামূলক ভালো হয়ে থাকে। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের বার্ষিক প্রাইমারি স্কুল জরিপ থেকে জানা গেছে, দেশে ৯৪৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে যেগুলোর শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫০ জনেরও কম। মোট ৫৬টি জেলায় এ স্কুলগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ওই বছর সরকারি অর্থের অপচয় রোধে এসব নামমাত্র স্কুল একীভূতকরণের বিষয়টি সামনে আনা হয়েছিলো। তারপর বিষয়টি আর এগোয়নি।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইফেক্টিভ স্টেটস অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট (ইএসআইডি) ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত ‘দ্য প্রবলেমস উইথ টিচার্স: দ্য পলিটিক্যাল সেটেলমেন্ট অ্যান্ড এডুকেশন কোয়ালিটি রিফর্মস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনেও প্রাথমিকের বড় সংকট হিসেবে বহু ধারার শিক্ষাব্যবস্থা, দক্ষ শিক্ষকের অভাব ও রাজনৈতিক প্রভাবের কথা তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে দেশে প্রাথমিক শিক্ষকদের নিয়োগ, বদলি ও পাঠ্যপুস্তকের কনটেন্ট নির্বাচন কীভাবে রাজনৈতিক বিবেচনা প্রভাব ফেলে, সে বিষয়েও আলোকপাত করা হয়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে ক্ষমতাসীনরা সব সময় পাঠ্যপুস্তকে বিশেষত ইতিহাসের ক্ষেত্রে তাদের অর্জনের বিষয়গুলোকে অন্তর্ভূক্ত করতে পছন্দ করে, যার অধিকাংশই বিতর্কিত ও ক্ষমতার পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেও পরিবর্তন হয়ে যায়। এ ছাড়া বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটিতে স্থানীয় কাউন্সিলর ও এমপিরা প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেন।

শিক্ষার মান বাড়াতে হলে প্রথমেই শিখন পরিবেশের উন্নতি করতে হবে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষকের মর্যাদা বাড়াতে হবে। শিখন মানের উন্নতি বলতে নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিখন শুধু শ্রেণিকক্ষে নয়, বাড়িতে ও চারপাশ থেকেও শেখানো হবে। প্রাথমিক স্তরেই ভদ্রতা, নম্রতা, শিষ্টাচার, দেশপ্রেম, পরোপকারিতা ও ন্যায়পরায়ণতা শেখানো প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা ও মানসিক বিকাশে গতানুগতিক শিক্ষাদানের বাইরে গিয়ে এঁকে, গান শুনিয়ে, গল্প বলে শিশুদের পাঠে আগ্রহী করে তুলতে হবে। সেজন্য সেসব বিষয়েও তাকে পারদর্শী হতে হবে। একজন আদর্শ শিক্ষক শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই পড়ার পাশাপাশি তাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর মানমানসিকতা গঠনে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করবেন। সর্বোপরি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিল্প-সংস্কৃতি, সাহিত্য-ঐতিহ্য, বিজ্ঞান চর্চা ও প্রযুক্তির ব্যবহারে আগ্রহী এবং পারদর্শী করে তুলতে হবে।

বিগত কয়েক দশকে দেশের প্রাথমিক ও গণশিক্ষার উন্নয়নে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে ঠিকই কিন্তু রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে এ পর্যায়ের শিক্ষার মানোন্নয়নে সেগুলো কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা খাতে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন ছিলো, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তবর্তী সরকারের সময়ও সেদিক থেকে বড় ধরনের ঘাটতি থেকে গেছে। আবার সরকারের সংস্কার কর্মসূচিতেও অবহেলিত প্রাথমিক ও গণশিক্ষা খাত। জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর বিভিন্ন খাতে সংস্কারের জোর উদ্যোগ নিয়েছে অন্তবর্তী সরকার। এজন্য গঠিত বিভিন্ন কমিশন এরই মধ্যে তাদের প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে। কিন্তু প্রাথমিক ও গণশিক্ষায় সংস্কার কার্যকম সীমাবদ্ধ আছে শুধু পরামর্শক কমিটি গঠনের মধ্যোই। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অগ্রাধকিারপ্রাপ্ত খাতগুলোর অন্যতম হওয়ার কথা ছিলো। এ খাতে সংষ্কার আরো অনেক আগে শুরু হওয়া প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো অন্যান্য বিভিন্ন খাতে সংস্কারের জন্য কমিশন হলেও শিক্ষায় কোনো কমিশন হয়নি। এমনকি যে পরামর্শক কমিটি গঠন করা হয়েচে সে কমিটিও এখনো কোনো প্রতিবেদন দেয়নি। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন দপ্তরগুলোর কার্যক্রম পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত ছয় মাসে দপ্তরগুলোর কার্যক্রম বেশির ভাগই ছিলো রুটিন ওয়ার্ক নির্ভর। এ সময়ে দপ্তরগুলোয় বৃহৎ পরিসরে কোনো সংস্কারের উদ্যোগ দেখা যায়নি। তবে প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষাবিদ, বিশেষজ্ঞ এবং প্রাথমিক শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গত ৩০ সেপ্টেম্বর নয় সদস্যের একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির তিন মাসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা থাকলেও তা এখনো জমা পড়েনি।

শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের কাছাকাছি দেশগুলোর মধ্যে এগিয়ে আছে শ্রীলঙ্কা। ইদানিং মালদ্বীপও শিক্ষায় খুব দ্রুত এগিয়েছে। এশিয়ার মধ্যে তাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে সবচেয়ে উন্নত বলা যায়। সেখানে মন্ত্রীসহ শিক্ষার নীতিনির্ধারণী সব পদে শিক্ষকরা কাজ করেন। ফলে তারা সমস্যাগুলো ভালোভাবে বোঝেন এবং সে অনুযায়ী দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কিন্তু আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষায় অনেক আগে থেকেই মহাপরিচালক, উপ-মহাপরিচালক পদে প্রশাসন ক্যাডারের ব্যক্তিরা দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের বেশিরভাগেরই মাঠ পর্যায়য়ের বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষার সমস্যা, সম্ভাবনা, বাস্তব অবস্থা সম্পর্খে স্বচ্ছ ধারণা নেই। ধারণা করে নিতে পারেন কিন্তু বাস্তব অবস্থার সঙ্গে তারা পরিচিত নন। ফলে নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে আসা সিদ্ধান্তগুলোর সঙ্গে মাঠপর্যায়ের বাস্তবতাতার দূরত্ব থাকে এবং সেখানে মাঠপর্যায়ের সংকটের সমাধান থাকে না। আমরা যদি প্রাথমিক শিক্ষার মনোন্নয়ন করতে চাই তাহলে এসব বিষয় আমাদের পর্যালোচনা করতে হবে। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এ কাঠামোয় প্রয়োজনীয় সংষ্কার আনতে হবে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় দপ্তর আছে পাঁচটি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, উপানুষ্ঠানকি শিক্ষা ব্যুরো, জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি, বাধ্যতামুলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ইউনিট ও শিশু কল্যাণ ট্রাস্ট। এ পাঁচ দপ্তরের মহাপরিচালক এবং উপ-মহাপরিচালক পর্যায়ে কর্মকর্তাদের সবাই প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। মোটাদাগে দেশের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা খাতে শীর্ষ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের যারা দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের প্রায় সবারই এ বিষয়ে মাঠ পর্যায়ের কাজের অভিজ্ঞতা বিশেষ করে শিক্ষা ক্ষেত্রে তেমন একটা নেই। এই বিষয়টিতে অবশ্যই পরিবর্তন আনতে হবে।

লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক

জনপ্রিয়