আজ ২৫ জানুয়ারি বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মদিন। ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে তিনি যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কবি ছিলেন জমিদার বংশের ছেলে। তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি। সাগরদাঁড়ির নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কোলে কবি বেড়ে উঠেছেন। তিনি একাধারে মহাকাব্য, নাটক, পত্রকাব্য, গদ্য ও প্রহসন রচয়িতা। মাইকেলের বিভিন্ন লেখায় প্রকৃতিপ্রেমের নিদর্শন পাওয়া যায়।
হিন্দু কলেজে অধ্যয়নের সময়ে মধুসূদন প্রথম কাব্য চর্চা শুরু করেন। তাকে বাংলার নবজাগরণ সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে গণ্য করা হয়। সাহিত্যের গতানগতিক পথে তিনি হাঁটেননি। সাহিত্যে নব্যরীতি প্রবর্তনের কারণে তাকে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিদ্রোহী কবি হিসেবেও অভিহিত করা হয়। অমিত্রাক্ষর ছন্দের মাধ্যমে তিনি কাব্যাঙ্গনে নতুন ধারা তৈরি করেন। বাংলা সাহিত্যে অঙ্গনে সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতা কবির গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। তার অধিকাংশ সনেটের বিষয় দেশপ্রেম ও প্রকৃতিনির্ভর।
১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হন। অতঃপর বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করে ভিনদেশি ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনার মনোনিবেশ করা শুরু করেন। কিন্তু বাংলা প্রেম ও প্রকৃতি কি এতো সহজে ভোলা যায়! তাই আবার ফিরে এসেছেন বাংলায়। ভালোবেসেছেন বাংলা সাহিত্যকে, বাংলার প্রকৃতিকে।
মাইকেল মধুসূদন সত্তের বিখ্যাত কবিতা ‘কপোতাক্ষ নদ’। কবি এ কবিতাটি লিখেছিলেন প্যারিসের শিন নদীর তীরে বসে। শিন নদীর তীরে বসে শেষ বিকেলের আলোয় কবি হারিয়ে গিয়েছিলেন নদীর কাছে। জানা যায়, স্থানীয়ভাবে বাংলাদেশিদের কাছে শিন নদী কপোতাক্ষ নদ নামে পরিচিত।
যেখানে বসে কবি মাইকেল মদুসূদন দত্ত কবিতাটি লিখেছিলেন সেই জায়গাটি চিহ্নিত করে রেখেছে স্থানীয় ফরাসিরা। দেশের প্রতি কতোটা টান থাকলে, প্রকৃতির প্রতি কতোটা প্রেম থাকলে নিজের নদী সম্পর্কে বিদেশের মাটিতে বসেও লেখা যায়। কবি বহু নদ দেখেছেন কিন্তু স্নেহের তৃষ্ণা মিটিয়েছেন শুধু কপোতাক্ষ নদের জলে। কপোতাক্ষ নদীর পাড়ে কবির স্মরণে রাখা আছে একটি স্মৃতিস্তম্ভ। কবি লিখেছেন-
‘সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে!
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে;
সতত (যেমতি লোক নিশার স্বপনে
শোনে মায়া-মন্ত্রধ্বনি) তব কলকলে
জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে!
বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ-দলে,
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?
দুগ্ধ-স্রোতোরূপী তুমি জন্মভূমি-স্তনে।’
‘বউ কথা কও’ কবির একটি বিখ্যাত সনেট। কবি এ সনেটে জানার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন দেশীয় ঐতিহ্য ও পাখির মনের বেদনা। বউ কথা কও পাখির সঙ্গে কবি তার মনের কথা আপন ভেবে বলতে চেয়েছেন। কবি লিখেছেন-‘কি দুঃখে, হে পাখি, তুমি শাখার উপরে/বসি, বউ কথা কও, কও এ কাননে?/মানিনী ভামিনী কি হে, ভামের গুমরে,/পাখা-রূপ ঘোমটায় ঢেকেছে বদনে?’
মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘আশ্বিন কালে’, ‘বসন্তে একটি পাখির প্রতি’, ‘নন্দন কানন’ ‘সায়ংকালের তারা’, ‘ছায়াপথ’, ‘সূর্য’, ‘বটবৃক্ষ’সহ বহু প্রকৃতি ও প্রেম জাতীয় সনেট লিখেছেন। এ ছাড়া ইতিহাস-ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করেও কবি সনেট লিখেছেন। সূর্য পুরো পৃথিবীতে তাপ ও আলো দেয়। সূর্যের আলোর ওপর নির্ভর করে চলছে প্রাণীজগৎ। কবি সূর্যকে নিয়ে কল্পনায় ভেবেছেন। সূর্য কবিতায় কবি লিখেছেন: ‘এখনো আছে লোক দেশ দেশান্তরে/দেব ভাবি পূজে তোমা, রবি দিনমণি/ দেখি তোমা দিবামুখে উদয়-শিখরে/লুটায়ে ধরণীতলে, করে স্তুতি-ধ্বনি:/ আশ্চর্যের কথা, সূর্য, এ না মনে গণি।/ অসীম মহিমা তব, যখন প্রখরে’। কবি ‘বটবৃক্ষ’ নিয়ে সনেট লিখেছেন। কবির কাছে বটবৃক্ষ বিশাল। যেনো করুণার আরেক নাম। বৃটবৃক্ষকে অতি মহান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বটবৃক্ষ বিশাল শাখা-প্রশাখা বিছিয়ে ছায়া প্রদান করে। কবি বলতে চেয়েছেন, বটবৃক্ষ গুণের দিক দিয়ে দেবতার মতো। বটবৃক্ষে পাখি আশ্রয় নেয়। বটবৃক্ষের ফল খেয়ে পাখি জীবনধারণ করে। কবির ভাষায়: ‘দেব-অবতার ভাবি বন্দে যে তোমারে,/নাহি চাহে মনঃ মোর তাহে নিন্দা করি,/ তরুরাজ! প্রত্যক্ষতঃ ভারত-সংসারে,/বিধির করুণা তুমি তরু-রূপ ধরি।/ জীবকুল-হিতৈষিণী, ছায়া সু-সুন্দরী,/তোমার দুহিতা, সাধু! যবে বসুধারে দগধে আগ্নেয় তাপে, দয়া পরিহরি,’।
‘নন্দন-কানন’ সনেটে কবি প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্যের ছবি হৃদয়ে ধারণ করেছেন। শিশির বিন্দু ফুলের ওপর পড়ার দৃশ্য কবিকে মুগ্ধ করে। কোকিল তার সুরে গান গেয়ে যায়, বাতাস বয়ে যায়, সবই কবি তাঁর চিত্রপটে ধারণ করেছেন। ‘নন্দন-কানন’ সনেট অসম্ভব সুন্দর একটি কবিতা: ‘যথায় শিশিরের বিন্দু ফুল্ল ফুল-দলে /সদা সদ্যঃ; যথা অলি সতত গুঞ্জরে;/ বহে যথা সমীরণ বহি পরিমলে;/বসি যথা শাখা-মুখে কোকিল কুহরে:/লও দাসে; আঁখি দিয়া দেখি তব বলে/ভাব-পটে কল্পনা যা সদা চিত্র করে।’ ‘বসন্তে একটি পাখির প্রতি’ সনেটে কবি পাখি, ফুল, সংগীতের বন্দনা করেছেন। ঋতুরাজ বসন্তে প্রেম ও প্রকৃতির বর্ণনা করেছেন এভাবে: ‘নহ তুমি পিক, পাখি, বিখ্যাত ভারতে,/ মাধবের বার্তাবহ; যার কুহরণে/ ফোটে কোটি ফুল-পুঞ্জ মঞ্জু কুঞ্জবনে!-/ তবুও সংগীত-রঙ্গ করিছ যে মতে/ গায়ক, পুলক তাহে জনমে এ মনে!’
১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ জুন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম আধুনিক এ কবি মৃত্যুবরণ করেন।
লেখক: শিক্ষক