ঢাকা বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারি ২০২৫ , ১৬ মাঘ ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

ফেসবুক মাদকে আসক্ত সমাজ

মতামত

কাজী বনফুল, আমাদের বার্তা

প্রকাশিত: ০৮:৩০, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫

আপডেট: ১৫:৫৯, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫

সর্বশেষ

ফেসবুক মাদকে আসক্ত সমাজ

আগের দিনে মানুষের মুখে মুখে ভর করে কোনো স্বাভাবিক ঘটনা রটতে রটতে এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছাতো যার সঙ্গে মূল ঘটনার কোনো প্রকার মিল খুঁজে পাওয়া যেতো না। সেই একই প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন স্বাভাবিক ঘটনাকে এখন রংচং মাখিয়ে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে ফেসবুকের মাঠে। সেই ফেসবুকের গ্যালারিতে আছে লাখ লাখ কোটি কোটি দর্শক।

যাদের কাজই হচ্ছে সারাদিন ফেসবুকের ভিডিয়ো দেখা এবং সেগুলোকে কোনো প্রকার বিচার বিবেচনাহীনভাবে শেয়ার করা। ভিউ ব্যবসায়ী ও শেয়ার ব্যবসায়ীরা খুব ভালোভাবেই জানে ফেসবুকে কোন জিনিস কীভাবে ছাড়লে সেটা শেয়ার ও ভিউয়ার হবে সর্বোচ্চ। তাই তারা আবার ভিডিয়োর ওপরে লিখে দেয় আপনি যদি এই ভিডিয়োটি দেখামাত্র শেয়ার না করেন তাহলে আপনার ওপরে অমুক গজব পড়বে, অমুক ক্ষতি হবে।

সাধারণ মানুষ স্বাভাবিকভাবে ভীত ও কুসংস্কারগ্রস্ত হয়ে থাকে। আর সঙ্গে সঙ্গে শেয়ার হয়ে যায় লাখ লাখ। আর এভাবেই হাজারো মিথ্যা তথ্য, বানোয়াট খবর ছড়িয়ে পড়ছে ফেসবুকের রঙিন পাতাজুড়ে। তার পর মানুষ থেকে মানুষে সমাজ থেকে সমাজে সর্বত্র।

আমাদের অঞ্চলে ছোট বাচ্চা থেকে বুড়ো সকলেই এখন বুঝে না বুঝে ফেসবুক অ্যাকাউন্টের মালিক। তারা যখন যা ইচ্ছে ফেসবুকে ছাড়তে পারে শেয়ার করতে পারে। মানুষকে দেখাতে পারে যেকোনো কিছু, নানান আবর্জনা কুড়িয়ে কুড়িয়ে ভরে তুলছে ফেসবুক অ্যাকাউন্টের বেহিসাবি ঘর।

বাংলাদেশের সর্বত্র এখন ফেসবুকের কালো চাদরে ঢেকে গেছে। ফেসবুকে ভেসে বেড়ানো সব পচা-গলা, নষ্ট মাছদের মানুষ গ্রহণ করছে তাজা ও ভালো মাছ হিসেবে। সবাই গো-গ্রাসে ভক্ষণ করছে ফেসবুক থেকে কুড়ানো নষ্ট, পচা মিথ্যা মাছ। ফেসবুকের নদীতে যারা এখনো সাঁতার কাটতে ব্যর্থ হয়েছেন সমাজ তাদেরকে আন-স্মার্ট ও পিছিয়ে পড়া মানুষ হিসেবে বিবেচনা করছে।

সবাই ফেসবুকের নদীতে গা ভাসিয়ে ভেসে চলছে দিগন্তহীন অজানার পথে। কোথায় যাচ্ছে, কোন দিকে যাচ্ছে এর ভবিষ্যৎ, কোথাও এর ফিডব্যাক কী এর ভবিষ্যৎ আউটপুটই বা কী তার সম্পর্কে কারো কোন ভাবনাচিন্তা নেই কেবল হা হা -হো হো করতে করতে সবাই ভেসে চলছে ফেসবুকের নদীতে।

উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় তাদের ফেসবুক কার্যক্রম অত্যন্ত সীমিত ও সীমাবদ্ধ। তাদের জীবন ফেসবুকের চার দেয়ালে বন্দি নয়। ফেসবুকের বাইরেও যে জীবন রয়েছে সেটা সম্পর্কে তাদের ধারণা সুসমৃদ্ধ। তাদের জীবনের স্পেসিফিক মূল্য আছে। জীবনের মূল্যবান সময়কে তারা ফেসবুকের পঁচা খাতায় বিলিয়ে দিতে আসেনি তারা নিজেদের জীবনের মূল্যবান সময়কে খুব হিসেব করে খরচ করে। মেটার সর্বোচ্চ ফেসবুক ব্যবহারকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ নাম শীর্ষে রয়েছে কারণ বাংলাদেশের মানুষের নিজেদের জীবনের সময়ের হিসেব নেই।

নিজেদের জীবনকে ফেসবুক নামক আত্মমৌহিক জালে আবদ্ধ করে রেখেছে এ অঞ্চলের মানুষরা। বাংলাদেশের মানুষের জীবন কখন যে এই ফেসবুক নামক বাকা বড়শিতে এমন পোক্তভাবে গেঁথে গেলো আমরা তা ধরতেই পারিনি। ফেসবুক আমাদের এখন ভাত-মাছের মতো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ফেসবুক ছাড়া আমরা চলতে পারি না হাটতে পারি না, গল্প করতে পারি না, খেতে পর্যন্ত পারি না। এই সব কিছুর ভেতর আমাদের ফেসবুক ঢুকে গেছে। সব কিছুর ফাঁকে ফাঁকে আমাদের ফেসবুকে উঁকি মারতে হয়। আমাদের এখন আমাদের সঙ্গে কোনো গল্প হয় না যেটুকু হয় ওই ফেসবুকের তৈলমর্দন কূপ কমেন্ট বক্সে আর আবেগে জড়ানো কালো কালির চিঠি ধ্বংসকারক মেসেঞ্জারে। আমরা আমাদের থেকে ক্রমান্বয়ে দূরে সরে যাচ্ছি, ক্রমাগত তলিয়ে যাচ্ছি অন্ধকার অতল গহ্বরে। ফেসবুকের রঙিন আলো আমাদের চুষে চুষে অমানবিক, নিষ্ঠুর, রোবোটিক কৃত্রিম মানুষে পরিণত করছে। সামাজিক যোগাযোগের নামে আমাদের করে তুলছে চরম অসামাজিক, হিংস্র ও দুঃখী মানুষ।

সেদিন এক লোক অন্য এক লোককে ডেকে বলছে ‘ভাই আমার ফোনের ফেসবুক টিপিটা একটু চালু করে দেনতো এহানে নাকি সব পাওন যায়, সব দেহুন যায়। সবাই খালি ফেসবুক ‘দ্যাহে আমিও দেহুম ভাই আমার ফেসবুক টিপিটা একটু চালু করে দেন।’ ফেসবুক চালু করার পর সেই লোক বাকি সব কাজ বাদ দিয়ে সারাদিন এখন শুধু ফেসবুকের গায়ে ভেসে থাকা মিথ্যা বানোয়াট খবর, ভিডিয়ো দেখে আর মানুষকে ডেকে ডেকে সেই ফেসবুকের খবর শোনায় অমুক পাতার রস খেলে তো তমুক রোগ উধাও হয়ে যায়, পৃথিবীতে নাকি নতুন সব দৈত্য আসতেছে এক মাসের ভেতর পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে আরো কতো গল্প। এভাবে একটা শ্রেণির ভেতর এমন সব বানোয়াট গল্প ও গুজব মহামারির মতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।

আমরা এখন সবাই ফেসবুক বিদ্যালয়ের ছাত্র। আমাদের স্কুল, কলেজ, বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় সবকিছুই এখন হয়ে উঠছে আমাদের এই ফেসবুক। ফেসবুকে সারাক্ষণ যা দেখি, যা পড়ি সেটাই আমরা ধারণ করছি উগড়ে দিচ্ছি সর্বত্র। আমাদের মস্তিষ্কের গুরুত্বপূর্ণ লকারে জমা হচ্ছে ফেসবুকের বাসি, পচা অজ্ঞানতার স্তূপ। প্রয়োজন অনুসারে সেখান থেকে আবার উগড়ে দেই ফেসবুকের সাদা ফাঁকা স্ক্রিনের দেয়ালে। ফেসবুকের নন-স্টপ স্কুলের সারাক্ষণ ছাত্র আমরা। আমাদের এই স্কুলের কোনো ছুটি নেই, এখানে সবাই ছাত্র, সবাই শিক্ষক এবং কেউ কেউ অতিশিক্ষক। সবাই উপদেশ আর জ্ঞান বিতরণের ফ্রি চাকরি করেন এখানে। এতো এতো জ্ঞানের দহনে চারপাশে জ্ঞানের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন মানুষ। কেউ আর কিছু দেখছে না চারপাশ ধূমায়িত অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে।

সেদিন একটা বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কোন ক্লাসে পড়ো। সে আমাকে উত্তরে বলেছিলো, ‘ক্লাস-ফিলাস বাদ দেন ফেসবুকেই এখন সব পাওন যায়’। এখন আমরা পড়ালেখা ফেসবুকেই করি। কী জানতে চান কন সব উত্তর রেডি। আমি বললাম বাহ! এই না হলে সোনার ছেলে এই নাও তোমার জন্য এই চকলেট। খুব শুদ্ধ করে বাচ্চাটা ইংরেজিতে ধন্যবাদ সমেত কী যেনো দুই লাইন শুনিয়ে দিলো আমাকে। ফেসবুকের কল্যাণে এখনকার বাচ্চারা ক্লাস ওয়ান থেকে শুরু করে অনার্স-মাস্টার্স, ডিগ্রি সব এক সঙ্গেই করতে পারে। সেদিন দেখলাম এক বাচ্চা তার শিক্ষককে অপদস্ত করার জন্য দলবল নিয়ে ঘুরছে কখন তাকে বাগে পাওয়া যায় এবং এর কারণ হিসেবে যেটা জানা গেলো সেই শিক্ষকের অপরাধ হচ্ছে তিনি কেনো তাকে ক্লাসের ভেতর ফেসবুক ব্যবহার করতে নিষেধ করলেন। আর এর কারণ হিসেবেই শিক্ষককে অপদস্ত করার জন্য তারা অপেক্ষা করছে।

ফেসবুক আমাদের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব একযোগে পালন করছে এতে কোনো সন্দেহ নেই, ফেসবুক বিদ্যালয়ের সাদা ব্লাক বোর্ডে আমরা যখন যা ইচ্ছে তাই লিখতে পারি যখন যা ইচ্ছে প্রকাশ করতে পারি। অন্যের লেখা উল্টেপাল্টে নিজের নামে চালিয়েও দিতে পারি। ফেসবুক জুড়ে পণ্ডিত, দার্শনিক, উপদেশদাতা, উপদেশ বিক্রেতার ছড়াছড়ি। এতো এতো জ্ঞানী বিজ্ঞানীতে ভরপুর আমাদের ফেসবুক যা পৃথিবীর আর কোথাও এমন সমাহার একসঙ্গে দেখতে পাওয়া অসম্ভব। এদিক দিয়ে অবশ্যই আমরা যেকোনো দেশকে হারাতে সক্ষম।

একটা সময় ছিলো যখন সন্ধ্যা বা সকাল হলেই চারপাশ থেকে ভেসে আসতো কবিতা পড়ার সুর চারপাশ গমগম করতো আগামীকালকের পড়া তৈরি করার সুরে। সন্ধ্যা হলে আশেপাশের বাড়িগুলোতে মায়েরা চিৎকার চেচামেচি করে সন্তানকে পড়ার টেবিলে বসানোর জন্য হৈচৈ শুরু দিতো। চারপাশের বাড়িঘরগুলো পরিণত হতো এক একটা গৃহবিদ্যালয়ে। ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে’ ‘মনারে মনা কোথায় যাস, বিলের ধারে কাটবো ঘাস’ আরো কতো ছড়া-কবিতা এখনো স্মৃতির সন্ধ্যায় চারণকালে কল্পনার কর্ণমূলে ভাসে।

বাচ্চাদের হাতে এখন স্মার্টফোন তারা এতোটুকু বয়সেই খুলে ফেলেছে ফেক আইডিসহ তিন চারটি আইডি। সেদিন একজন বললো, সে একসঙ্গে পাঁচটা ফেসবুক আইডি চালায় নামে-বেনামে। আমি বললাম, এতগতোলো আইডি দিয়ে কি করা হয়, সে বললো ট্রেন্ড বস, এটা ট্রেন্ড।

আমরা যে ট্রেন্ডের পথে এগিয়ে চলছি তা কোনোভাবেই সঠিক ও সামগ্রিক কল্যাণকর পথ নয়। আমাদের ফেসবুক নামক কণ্টকি ফল আমাদের সমগ্র চিত্রকে মদবিহ্বলতায় জাপটে ধরেছে। আমরা যদি এখনো এই বিষ-বিষাদের তেঁতো ভবিষ্যতের বিষক্রিয়া সম্পর্কে অনুধাবন করতে না পারি তাহলে আমাদের সর্বনাশ কেউ ঠেকাতে পারবে না।

লেখক: গবেষক

 

জনপ্রিয়