ঢাকা বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারি ২০২৫ , ১৬ মাঘ ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

সলঙ্গা দিবস: ঐতিহাসিক বিদ্রোহের দিন

মতামত

আমাদের বার্তা, এস ডি সুব্রত

প্রকাশিত: ০৮:৩০, ২৭ জানুয়ারি ২০২৫

সর্বশেষ

সলঙ্গা দিবস: ঐতিহাসিক বিদ্রোহের দিন

২৭ জানুয়ারি ঐতিহাসিক সলঙ্গা বিদ্রোহ দিবস। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে তদানিন্তন ব্রিটিশ সরকারের লেলিয়ে দেয়া পুলিশ বাহিনীর গুলিতে সলঙ্গার হাটে বিলেতি পণ্য বর্জন আন্দোলনের কর্মীসহ সাড়ে ৪ হাজার সাধারণ হাটুরে জনতা শহীদ হন। ব্রিটিশ শাসনামলে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলন ও খেলাফত আন্দোলনে জনতা বিলেতি পণ্য বর্জন করে স্বদেশি পণ্য ব্যবহারের সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। এমনি একটি আন্দোলনের ঢেউ এসে আছড়ে পরে সলঙ্গায়। সে সময় তৎকালীন পাবনা জেলার এবং বর্তমান সিরাজঞ্জ জেলার সলঙ্গায় একটি ব্যবসায়ীক জনপদ হিসেবে সপ্তাহে দুই দিন হাট বসতো। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি শুক্রবার ছিলো বড় হাটবার।

মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশের নেতৃত্বে অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনের কর্মীরা হাটে নামেন বিলেতি পণ্য কেনা-বেচা বন্ধ করতে। আর এ স্বদেশি আন্দোলনের কর্মীদের রুখতে ছুটে আসেন পাবনা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আরএন দাস জেলা পুলিশ সুপার ও সিরাজগঞ্জ মহকুমা প্রসাশক এসকে সিনহাসহ ৪০ জন সশস্ত্র লাল পাগড়িওয়ালা পুলিশ।

সলঙ্গার গো হাটায় ছিলো বিপ্লবী স্বদেশি কর্মীদের অফিস। পুলিশ কংগ্রেস অফিস ঘেরাও পূর্বক গ্রেফতার করে মাওলানা আব্দুর রশিদকে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে মুক্ত করতে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। বিদ্রোহে ফেটে পড়েন সলঙ্গার সংগ্রামী জনতা। জনতার ঢল ও আক্রোশ দেখে ম্যাজিস্ট্রেট জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য গুলি চালাতে নির্দেশ দেয়। শুরু হয়ে যায় বুলেট বৃষ্টি। ৪০টি রাইফেলের মধ্যে মাত্র ১টি রাইফেল থেকে কোনো গুলি বের হয়নি। এ রাইফেলটি ছিলো একজন বাহ্মণ পুলিশের। হত্যাকাণ্ডে হতাহতের সরকারি সংখ্যা সাড়ে ৪ হাজার দেখানো হলেও বেসরকারি বিভিন্ন মতে এর সংখ্যা ১০ হাজারেরও অধিক বলে জানা যায়।

মাওলানা আব্দুর রশিদ সলঙ্গা বিদ্রোহ উপনিবেশিক শাসনের ভিত লড়িয়ে দিয়েছিলেন। সলঙ্গার রক্তসিক্ত বিদ্রোহ শুধু বাংলার মাটিকে সিক্ত করেনি, সিক্ত করেছে সমগ্র উপমহাদেশ। যে রক্তে ভেজা পিচ্ছিল পথে অহিংস, অসহযোগ আন্দোলনে যা কিছু অর্জিত হয়েছে তা সলঙ্গা বিদ্রোহেরই ফসল। দিবসটি পালন উপলক্ষে মাওলানা আব্দুর তর্কবাগীশ পাঠাগার, নূরুন্নাহার তর্কবাগীশ ডিগ্রি কলেজ, সলঙ্গা সমাজ কল্যাণ সমিতি, তর্কবাগীশ মহিলা মাদরাসা, তর্কবাগীশ উচ্চ বিদ্যালয়, মাওলানা তর্কবাগীশ গবেষণা কেন্দ্র ও সলঙ্গা ফোরাম পৃথক পৃথকভাবে আলোচনা সভা, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, র‌্যালি ও পুরস্কার বিতরণসহ নানা কর্মসুচির আয়োজন করে থাকে।

সলঙ্গা বিদ্রোহের দিনের ঘটনার লিখিত দলিল তেমন একটা পাওয়া যায় না। তৎকালে আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ দিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা একটি খাতায় লিখে রাখতেন। পরিবারের কাছে থেকে পাওয়া সেই খাতার লেখা সমন্বয় করে ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে মাওলানা তর্কবাগীশ পাঠাগারের যুগপূর্তির স্মরণিকায় একটি লেখা প্রকাশ করা হয়। আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের নামে প্রকাশিত লেখাটির শিরোনাম ‘স্বাধীনতা সংগ্রামের রক্ত সিঁড়ি সলঙ্গা’। তর্কবাগীশ মারা যান ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে। নিজের লেখায় আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ উল্লেখ করেন, তখন (১৯২২) দেশব্যাপী তুমুল আন্দোলনের জোয়ার। প্রতিটি শহরে, গ্রামগঞ্জে, হাটবাজারে বিদেশি বস্ত্র ও অন্যান্য দ্রব্য বয়কট করার জন্য স্বেচ্ছাসেবকেরা দলে দলে অভিযান চালাচ্ছেন। সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারও তার দমননীতি আরো কঠোর করে। জানুয়ারি মাসে বগুড়া ও পাবনার সীমান্তের চান্দাইকোনায় মঙ্গলবারের সাপ্তাহিক হাটে স্বেচ্ছাসেবকদের পণ্য বয়কট অভিযানে কয়েকজন পুলিশ বাধা দেয়। এতে জনগণ উত্তেজিত হয়ে পুলিশের হাত থেকে রাইফেল কেড়ে নিয়ে হাটসংলগ্ন ফুলজোড় নদীতে ফেলে দেয়। এ ঘটনায় পুলিশ এই এলাকায় কংগ্রেস কর্মী ও জনসাধারণের প্রতি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে পড়ে এবং সুযোগ খুঁজতে থাকে। একদিন সে সুযোগ করে নেয় এবং পরিকল্পিতভাবে সলঙ্গা হাটে স্বেচ্ছাসেবক ও নিরীহ জনসাধারণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

তর্কবাগীশ লিখেছেন, কংগ্রেস অফিস থেকে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে হাটের দক্ষিণ প্রান্তে নিয়ে যায়। মারমুখী জনতাকে শায়েস্তা করতে পুলিশ সুপার হুকুম করেন, ‘ফায়ার।’ সঙ্গে সঙ্গে গর্জে ওঠে ৩৯টি রাইফেল। গুলিবিদ্ধ হয়ে তার সামনেই সাতজন নিহত হন। সরকারি তদন্ত রিপোর্টে তখন হতাহতের সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার হাজার বলে উল্লেখ করা হয়েছিলো। উত্তেজিত জনতা হলঙ্গা, ফালা, লাঠি, সড়কি, বল্লম নিয়ে চারদিক থেকে এগিয়ে আসে। স্মরণিকার লেখা অনুযায়ী আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ জনতাকে বলেছিলেন, এখন আপনারা যদি নিরস্ত্র না হন, শান্ত না হন, তবে এ সংবাদ পেয়ে আরো পুলিশ আসবে, সৈন্যও আসবে। তারা এলে গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দেবে, নির্বিচারে হত্যা করবে, ধরে নিয়ে যাবে।’ তর্কবাগীশ লেখেন, ‘তদন্তকারীদের কাছে সবই বলেছিলাম। পরে জানতে পারি, সরকার উল্টো ঘাতকদের পদোন্নতি ও পুরস্কৃত করেছে।’

তর্কবাগীশ তার লেখায় ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের জালিয়ান ওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের বিচারের উদাহরণও টেনেছেন। লিখেছেন, ‘জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের হোতা ও’ডায়ারকে কোনো শাস্তি না দিয়ে লন্ডনে জৌলুশ জীবনযাপনের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছিলো।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ

 

জনপ্রিয়