চব্বিশের জুলাই অভ্যূত্থান পরবর্তীতে কত মানুষ কতকিছু দাবি করে আন্দোলন করলো! রাস্তায় নামলো, শ্লোগান তুললো। রাষ্ট্র কাউকে একটা ফুলের টোকাও দিলো না। রিকশাওয়ালা নেমেছিলো, বেকার-মজুর পথ অবরোধ করে রাস্তায় বসেছিলো। সবাইকে বুঝিয়ে, সান্ত্বনা দিয়ে কিংবা আশ্বাস দিয়ে সরকার ঘরে ফেরালো। সাধারণ মানুষজন বিশ্বাস করতে শুরু করলো- এ সরকার তো আমাদের সরকার, প্রাণের সরকার এবং প্রিয় সরকার। সরকারের প্রশংসায় জনগণ উল্লাস করলো। মানুষ বলতে লাগলো, ‘আগে নয়, এখন ভলো আছি।’
আগষ্ট অভ্যূত্থানের পরে কত কত অযৌক্তিক দাবির কথা শুনেছি। রাস্তা আটকে দিনভর আন্দোলন হতে দেখেছি কিংবা ছাত্রদের বিক্ষোভে নগরবাসীকে নাকাল হতে দেখেছি। সরকার কিংবা আন্দোলনকারীরা- কেউ সীমালঙ্ঘন করেনি। সরকারের ধৈর্য প্রশংসিত ছিলো। আন্দোলনকারীরাও দিন শেষে নির্বিঘ্নে ঘরে ফিরেছে। এই সরকার অতীতের কোনো সরকারের মত দানবীয় আচরণ করবে না- আশা ছিলো এবং বিশ্বাস জন্মেছিলো। জনগণকে বুঝবে এবং বোঝাবে, দাবি মানবে এবং মানাবে কিংবা কথা শুনবে এবং শোনাবে- এমন আস্থার সম্পর্ক তৈরি হওয়ার কথা ছিলো। অনেকটাই হয়েছিলো বটে, তবে হঠাৎ যেনো ছন্দপতন!
ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষক প্রায় অবহেলিত। যা বেতন পায় তার চেয়ে চামার-কর্মকারের আয় অনেকগুণ বেশি। সরকার বাহাদুরের কাছে তারাও তাদের দাবি জানাতে গেছিলো। অন্যরা নির্বিঘ্নে যেতে পারে দেখে তারাও কষ্টের কথা বলতে গেছিলো। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, সম্পূর্ণ অযৌক্তিক দাবি নিয়ে রাজধানীর শাহবাগে গিয়েছিলো। এমন তো নয় যে তাদের পূর্বে এমন দাবি নিয়ে আর কেউ ওদিকে যায় নি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দলেবলে শহীদ মিনার হয়ে যমুনার দিকে গিয়েছিলো। চাকরির বয়স বাড়াতে বেকাররা তো প্রায়ই যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদেরকে আটকায় কিন্তু কখনোই আঘাত করে না।
ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকদের ওপর লাঠিচার্জ করে সরকারের সরকারি রূপ দেখাতে হলো? শিক্ষকদের ওপর হামলায় সরকারের নৈতিক বিপর্যয় ঘটেছে- এটা কি কর্তৃপক্ষ বুঝবে? এমন মানুষগুলো- যারা শিশু শিক্ষার্থীদেরকে পড়ায়, তাদেরকে মেরেই সুনাম হারাতে হলো? যে মানুষগুলো বছরের পর বছর বিনা বেতনে, পেটে ভাতে গ্রামে-চরে শিক্ষার বাতি প্রজ্জ্বলিত রেখেছে তাদের দিকে জলকামান নিক্ষেপ কিংবা লাঠিচার্জের দৃশ্য একজন নাগরিক হিসেবে আমাদেরকে চরমভাবে ব্যথিত করেছে।
দীর্ঘদিনের অবজারভেশনে অন্তবর্তীকালীন সরকারের চরিত্র মোটামুটি আন্দাজ করতে পারি। শাহবাগে শিক্ষকদের ওপরে যে জুলুম দেখলাম তা সরকারের চরিত্রের সঙ্গে মিলছে না। সরকার এই বিষয়টিকে ভালোভাবে খতিয়ে দেখুক- প্রত্যাশা করছি। এই ঘটনার পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র আছে কিনা তা সরকারের কাছে স্পষ্ট হওয়া দরকার। কেউ কি সরকারের দুর্নাম করতে চাইছে? যারাই শিক্ষকদের ওপরে এমন বর্বরোচিত হামলার ফুটেজ দেখেছে তারাই দারুণভাবে মনেপ্রাণে আহত হয়েছে। নিরীহ ছাপোষা শিক্ষকদের দিকে পুলিশের এমন আগ্রাসী আক্রমণ ও আচরণ অশুভের ইঙ্গিত। দূরের কোনো মেঘ এখানে বজ্রপাতের ইন্ধন দিচ্ছে- হয়তো।
সরকার অবিলম্বে শিক্ষকদের সঙ্গে বসুক এবং তাদের কথা শুনুক। সব সমস্যার সমাধান করার সাধ্য অন্তবর্তীকালীন সরকারের নাই। তবে দাবি-দাওয়া শুনতে তো দোষ নাই। যে সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে তা তো জনগণের স্বার্থে। জনতার সেই কাতারে শিক্ষক-মজুরও আছেন। শিক্ষকদের শরীরে আঘাত করা, রক্তাক্ত করা, এসব অমার্জনীয় অপরাধ। রাষ্ট্র-সরকার যতদ্রুত এটা অনুধাবন করতে পারবে ততদ্রুত সামগ্রিক কল্যাণ নিশ্চিত হবে। এই ঘটনায় মনে হয়েছে, সরকারকে বিব্রত করার জন্য কোনো একটি পক্ষ কৌশলে কলকাঠি নাড়ছে। সরকারের সাবধান হওয়া উচিত। শিক্ষকের কল্যাণের মধ্যেই জাতিরাষ্ট্রের মঙ্গল নিহিত আছে।
লেখক: প্রাবন্ধিক।
(মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন)