শিক্ষকদের প্রতি অবহেলা ও তাদের যন্ত্রণা দেখতে দেখতে দীর্ঘসময় ধরে তাদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদার কথা বলে আসছি ও লিখে যাচ্ছি। গত ২৪ জানুয়ারি প্রাথমিক শিক্ষকদের দশম গ্রেড তথা মর্যাদা বৃদ্ধির প্রত্যাশায় আয়োজিত সভায় দীর্ঘসময় পরে হলেও একজন তরুণ উদীয়মান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মুখে শিক্ষকদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা কথা শুনে সাবেক শিক্ষক ও সংগঠনের কর্মী হিসেবে অনেকটা স্বস্তি অনুভব করলাম। দীর্ঘসময় এ বাক্য বা শ্লোগান শুধু নিজের লেখনীতে বা বক্তব্যে প্রকাশ করে আসছি। সাথীহীনভাবে নিজের ভাবনায় ছিলো শিক্ষকেরা কেনো থার্ড বা সেকেন্ড ক্লাস কর্মচারী হয়ে থাকবে? বক্তব্যটি সাবেক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু ভিপি ও গণধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূরের বক্তব্য সারা দেশে ব্যাপক আড়োলন সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেছেন, নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে চাইলে শিক্ষকদের অগ্রভাগে রাখতে হবে। শিক্ষক যদি জাতির মেরুদণ্ড হয়, শিক্ষকেরা যদি সমাজ গড়ার কারিগর হয়’ তাদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। প্রাথমিকসহ সব শিক্ষকদের প্রথম শ্রেণির চাকরির অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
প্রাথমিক, ইবতেদিয়া, মাদরাসা, হাইস্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষকের একই যোগ্যতা থাকা বাঞ্ছনীয়। উন্নত বিশ্বের মতো শিশু শিক্ষায় পাঠের কাঠিন্য বিবেচনা সবচেয়ে মেধাবীদের নিয়োগ দিতে হবে প্রাথমিক শিক্ষায়। সব শিক্ষকের মর্যাদা থাকবে এক ও অভিন্ন তাহলে শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্য দূর হয়ে, শিক্ষা হয়ে উঠবে অধিকতর সমৃদ্ধ। তবে কাজের ব্যাপকতা ও গুরুত্ব অনুযায়ী বেতন কম/বেশি হতে পারে, মর্যাদায় কোনো তফাৎ হওয়া কাম্য নয়।
মর্যাদা নিয়ে আমাদের প্রধান শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের হীন-কৃপণতার ভাবনা দৃশ্যমান। কতিপয় প্রধান শিক্ষকদের মাঝে কারো ভাবনা তারা ফার্স্ট ক্লাস হলে সহকারীরা কী করে একই মর্যাদা হবে? অনেকটা প্রভু-ভৃত্যের মানসিকতা। অনুরূপভাবে কর্মকর্তাদের মাঝেও অনুরূপ ভাবনা দৃশ্যমান।
সচিব ও মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে জিজ্ঞাসা, যারা আপনাদের জ্ঞানের আলো দিয়ে বিকশিত করে এনে আজকের পদ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন তাদের পদমর্যাদা আপনাদের নিচে থাকবে। কী করে ভাবেন? বিষয়টি লজ্জার। শিক্ষকেরা দেশ গড়ার কারিগর। পিতৃ-মাতৃতুল্য। তাদের অসম্মান বা অবজ্ঞার দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করা জাতীয় কলঙ্ক।
শিক্ষকদের কোনো বস থাকতে পারে না। প্রশাসনের ক্যাডার, পশু-পাখি ক্যাডারসহ অন্য কোনো ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তা তাদের নিয়ন্ত্রণ করুক। বিষয়টি মোটেই কাম্য নয়।
শিক্ষক থেকে পদোন্নতি পেয়ে বেড়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করবে, শিক্ষকদের তথা শিক্ষাব্যবস্থা। এ ব্যবস্থা হলে শিক্ষকদের মর্যাদা অক্ষুণ্ন থাকবে। তাদের মর্যাদা থাকবে সমুন্নত।
স্বাধীনতার পঞ্চাশ দশক পর আজও প্রাথমিক শিক্ষার মতো বিশাল মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব ক্যাডার সার্ভিস নেই। সরকার, মন্ত্রী, সচিব, মহাপরিচালক তথা বর্তমানে উপদেষ্টা, সংস্কার কমিটি আসছে আর যাচ্ছে। কারো ভাবনায় প্রাথমিক শিক্ষার স্বতন্ত্র ক্যাডার সার্ভিস সৃষ্টি করার ভাবনাটি দৃশ্যমান নয়। উচ্চ পর্যায়ে বিশাল গলদ রেখে প্রাথমিক শিক্ষার বৈষম্য ও শিক্ষক ঘাটতি রেখে ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’ এর মতো শিক্ষকদের ওপর দোষ চাপানো যথার্থ নয়। শিক্ষকের কাঙ্ক্ষিত মর্যাদা প্রথম শ্রেণি অর্জনের লক্ষ্যে থার্ড ক্লাস থেকে দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা আজকের শিক্ষকদের প্রত্যাশা। সব শিক্ষক নেতা, কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদসহ সবার ভাবনা থাকা প্রয়োজন শিক্ষকদের মর্যাদা প্রথম শ্রেণি।
সে লক্ষ্যে আজকের সহকারী শিক্ষকদের দশম গ্রেড, শিক্ষকদের বৈষম্য নিরসনসহ মর্যাদার লড়াই চলমান। এ দাবি হোক রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন সব কর্মকর্তাসহ সরকারের।
অর্থের দোহাই দিয়ে রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থাকে তথা জাতির সমৃদ্ধিকে ব্যাহত করা মোটেই কাম্য নয়। ব্যক্তি হিসেবে আমাদের প্রত্যেকে যেমন পরিবারের সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য যথা-অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা ও চিকিৎসা বাসস্থানের জন্য প্রয়োজনে ধার-দেনা করে সমাধান করে থাকি। অনুরূপভাবে শিক্ষা জাতির উন্নতির চাবিকাঠি। রাষ্ট্রের তথা জাতির সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনে ঋণ করে হলেও শিক্ষকদের মর্যাদা তথা বৈষম্য দূর করা।
সরকার সংশ্লিষ্টরাসহ রাজনীতিবিদদের মাঝে শিক্ষকদের মর্যাদার প্রথম শ্রেণি করার বিষয়ে উপলব্ধিবোধসহ সুমতি জাগ্রত হোক। এই প্রত্যাশা করছি।
লেখক: শিক্ষাবিদ