ঢাকা রোববার, ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ , ১৯ মাঘ ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

মেছোবিড়াল সংরক্ষণে সচেতনতা কাম্য

মতামত

সাধন সরকার, আমাদের বার্তা

প্রকাশিত: ১৭:২১, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

আপডেট: ১৭:২৩, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

সর্বশেষ

মেছোবিড়াল সংরক্ষণে সচেতনতা কাম্য

(১ ফেব্রুয়ারি) ‘বিশ্ব মেছোবিড়াল দিবস’। দেশে প্রথমবারের মতো এ দিবস পালন করা হচ্ছে। এ বছরের প্রতিপাদ্য- ‘জনগণ যদি হয় সচেতন, মেছোবিড়াল হবে সংরক্ষণ।’ মেছোবিড়ালের ইংরেজি নাম ‘Fishing  cat’ । মেছোবিড়াল বিড়াল প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত ছোট প্রাণী।

 এটি কয়েক ধরনের বুনো বিড়াল জাতের মধ্যে একটি। গায়ে চিতাবাঘের মতো ডোরাকাটা দাগ থাকায় মেছোবিড়াল অনেক এলাকায় চিতা বাঘ, মেছো বাঘ অথবা বাঘের শাবক নামে পরিচিত।

 শরীরে হলুদ ডোরা দাগ এই বিড়ালকে বেশ আকর্ষণীয় করে তুলেছে। সমস্যাটা মূলত এখানেই। ছোট চিতাবাঘের অনুরূপ মনে করায় মানুষের সঙ্গে মেছোবিড়ালের সংঘাত বেড়েছে। শত্রু মনে করায় মেছোবিড়ালকে পিটিয়ে মারার ঘটনা  সংবাদমাধ্যমে মাঝে মাঝে শোনা যায়। বেশিরভাগ সময় দেখা যায় মানুষ মেছোবিড়াল দেখামাত্রই তাকে বিপদের কারণ হিসেবে মনে করে। ফলশ্রুতিতে তাকে যেকোনো উপায়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। 

মেছোবিড়ালের আকার ও আকৃতি সাধারণ বিড়ালের থেকে কিছুটা বড় । সাধারণত এদের ওজন ৫ কেজির বেশি হয়ে থাকে। কিন্তু বাস্তবে মেছোবিড়াল মানুষের শত্রু নয়। মানুষকে কখনোই আক্রমণ করে না। মানুষ দেখলেই পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। 

এরা মূলত নিশাচর প্রাণী। বেশিরভাগ সময় রাতের বেলায় খাবার সংগ্রহে বের হয়। দিনের বেলায় বাঁশঝাড় ও ঝোপঝোড়ের মধ্যে বিচরণ করতে দেখা যায়। জলাশয়ের মাছ এদের প্রধান খাদ্য। আর সে কারণেই জলাশয় ও ঝোপঝাড়পূর্ণ স্থান এদের আবাসস্থল। প্রাণীটি জলাশয়পূর্ণ এলাকায় মাছ ধরার বিশেষ কৌশল জানে।

 এটি দ্রুতগতির প্রাণী হিসেবে কয়েক সেকেন্ডেই শিকারকে খাদ্যে পরিণত করে। অপেক্ষাকৃত দুর্বল মাছ ও পাখি শিকার করে এরা ভক্ষণ করে থাকে। খাদ্যাভাব দেখা দিলে মেছোবিড়াল বসতবাড়ির হাঁস-মুরগির ওপর আক্রমণ শুরু করে। সাঁতারেরও বিশেষ দক্ষতা রয়েছে মেছোবিড়ালের। দক্ষিণ এশিয়ার জলাভূমি এলাকায় এরা সবচেয়ে বেশি বসবাস করে। একটা গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষ ও মেছোবিড়ালের খাদ্য মোটামুটি একই হওয়ায় এবং মানুষের কাছাকাছি আবাসস্থলের কারণে অসতর্কবশত মেছোবিড়ালের প্রতি প্রাণ সংশয়ের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

একটা সময় মেছোবিড়াল ধরা পড়লে বন বিভাগের তরফ থেকে উদ্ধার করে লাউয়াছড়া, হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান কিংবা আশপাশের উদ্যানে অবমুক্ত করা হতো। তখন দেখা যেত মেছোবিড়ালটি তার স্বাভাবিক পরিবেশ ছেড়ে নতুন পরিবেশে গিয়ে খাপ খাইতে না পেরে ঝুঁকির মধ্যে পড়তো। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিড়ালটির টিকে থাকা কঠিন হয়ে যেত। এদের বংশবৃদ্ধি ও প্রজনন বাধাগ্রস্থ হতো। পরবর্তীতে বন বিভাগ তার নীতি ও কৌশলে পরিবর্তন আনে। 

এখন সাধারণ মানুষকে বুঝিয়ে উদ্ধারকৃত স্থানের আশপাশেই মেছোবিড়াল বা তার শাবককে অবমুক্ত করা হয়। এতে করে মেছোবিড়াল তার চিরচেনা পরিবেশেই নিজের মতো বাঁচার সুযোগ পাচ্ছে। বাংলাদেশের হাওর-বাঁওড়, বিল, পুকুর সিলেট ও চট্টগ্রামের জলাভূমি ও বনভূমি, পদ্মা-তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র নদীর অববাহিকা, গ্রামাঞ্চলের ঘন ঝোপঝাড়, ঢাকার আশপাশের জলাভূমি, পাহাড়ি বনে ও সুন্দরবন মেছোবিড়ালের প্রধান আবাসস্থল। এছাড়া এরা ধানক্ষেত ও পরিত্যক্ত বাড়িতে আশ্রয় নেয়। ফসলের ক্ষেতের পোকামাকড়, ইঁদুর খেয়ে এরা কৃষকের উপকার করে।

শুধু বাংলাদেশে নয়, প্রাণী সংরক্ষণের আইনে মেছোবিড়াল সংরক্ষিত। ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন-২০১২’ অনুযায়ী ফাঁদের কৌশলে মেছোবিড়াল শিকার, হত্যা, ক্রয়-বিক্রয় ও পাচার সম্পর্ণভাবে নিষিদ্ধ এবং আইনত দণ্ডণীয়। এই আইন অমান্য করলে জেল-জরিমানারও বিধান রয়েছে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা (আইইউসিএন) ইতোমধ্যে মেছোবিড়ালকে সংকটাপন্ন প্রাণী হিসেবে লাল তালিকাভুক্ত করেছে। 

মেছোবিড়াল পিটিয়ে মারার ঘটনায় হত্যাকারীর সাজার ঘটনাও বিরল নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো মেছোবিড়ালের সংখ্যা দিনের পর দিন কমছে।  খাবার ও আবাসস্থলের সংকট মেছোবিড়ালকে সবচেয়ে বেশি বিপদে ফেলেছে। কেননা খাবার সংগ্রহ করতে এরা ধরা পড়ছে। হাঁস-মুরগির খামার ও মাছের খামার থেকে খাবার সংগ্রহের সময় এরা ধরা পড়ছে বেশি। খারাপ  খবরের পেছনে দু-একটি ভালো খবরও যে ঘটছে না তা নয়। মেছোবিড়াল ধরা পড়ার পর অনেক সচেতন মানুষ এদেরকে বন বিভাগের হাতে তুলে দিচ্ছে।

বাংলাদেশে এমন একটা সময় মেছোবিড়াল দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যখন প্রাণীটি সংকটাপন্ন! অনেক আগ থেকেই মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে দিবসটি পালনের দরকার ছিলো। আবার দিবস পালন করলেই যে প্রাণীটি রক্ষা পাবে বিষয়টি এমন নয়। দরকার হলো প্রকৃতি-পরিবেশ সংরক্ষণ করা। প্রকৃতি-পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যকলাপ না কমাতে পারলে প্রকৃতি ধ্বংস হওয়ার পাশাপাশি মেছোবিড়ালও হারিয়ে যাবে। 

জলবায়ুগত সমস্যার কারণে প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণ করা সবচেয়ে বেশি জরুরি। মানুষের বসবাস ও মেছোবিড়ালের আবাসস্থল আলাদা করে দেখার সুযোগ দিন দিন কমে আসছে। যতই জলাশয়ের পরিমাণ কমছে জলাশয়ের আশপাশের এই প্রাণীটি ততই মানুষের আবাসস্থলের কাছাকাছি চলে আসছে। সে হিসেবে মানুষকে সচেতন করেই মেছোবিড়ালকে সংরক্ষণ করতে হবে। মেছোবিড়ালকে শত্রু ভাবা বন্ধ করতে হবে। তাছাড়া যে প্রাণীটি কারো কোনো ক্ষতি করে না তাকে কেনো শত্রু ভাবতে হবে?

জনবসতির সম্প্রসারণ, মানুষের সঙ্গে সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশগত সমস্যা,  জলাশয় ও ঝোপঝাড় কমে যাওয়া ও খাদ্য সংকটের কারণে এ প্রাণীটি আজ বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় স্থান পেয়েছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় প্রতিটি প্রাণীর কোনো না কোনো ভূমিকা রয়েছে। মেছোবিড়াল পরিবেশের বন্ধু। 

মেছোবিড়াল ও তার শাবককে তাদের মতো করে থাকতে দিতে হবে। বিপন্ন এ প্রাণীটি রক্ষায় জলাভূমি রক্ষাসহ মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা না গেলে অদূর ভবিষ্যতে প্রাণীটি বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাবে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। মানুষ ও পরিবেশের বন্ধু হয়েই বেঁচে থাকুক মেছোবিড়াল।

লেখক: শিক্ষক

জনপ্রিয়