আজ ২ ফেব্রুয়ারি ‘বিশ্ব জলাভূমি দিবস’। নদনদী ও জলাভূমির দেশ বাংলাদেশ। নদনদী, বিল, হাওর, বাঁওড় এদেশকে জালের মতো ঘিরে রেখেছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, জীববৈচিত্র্যের সুরক্ষা ও খাদ্য নিরাপত্তার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো জলাভূমি। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় জলাভূমিগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম।
সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য জলাধার শুধু এদেশের প্রাকৃতিক সম্পদই নয়, আবহমান বাংলার সমাজ, সংস্কৃতি ও লোকাচারের অংশ। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে জলাভূমিগুলো জীবন ও জীবিকার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
জলাভূমি হলো জলের আধার। জলাভূমি প্রাণ ও প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এমন একটি স্থান বা এলাকা যার মাটি মৌসুমভিত্তিক বা স্থায়ীভাবে আর্দ্র থাকে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুতন্ত্র। পুরো পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের জলাভূমি দেখতে পাওয়া যায়।
আমাদের দেশে যেসব জলাভূমি রয়েছে তা হলো- জোয়ারভাটায় প্লাবিত নিচু সমতলভূমি, পাহাড়ি অঞ্চলের ঝিরি, ঝর্ণা, বিল, বাঁওড়, খাল, খাড়ি, বাইদ, হ্রদ, কুণ্ড, হাওর, লবণাক্ত জলাধার, পুকুর, দিঘি, নিম্ন প্লাবনভূমি, নিচু জলা, জলমগ্ন এলাকা, উন্মুক্ত জলাশয়, নদীর মোহনা, সামুদ্রিক তীর ইত্যাদি।
জলাভূমি ধ্বংস হওয়ার কারণে জলবায়ুগত সমস্যা আরো জটিল আকার ধারণ করেছে। পরিবেশগত বিষয় তো বটেই অর্থনৈতিক দিক দিয়ে জলাভূমির গুরুত্ব অপরিসীম। জলাভূমিগুলো জলজ উদ্ভিদ ও মৎস্য সম্পদের অফুরন্ত উৎস। পৃথিবীতে মোট আহরিত মৎস্য সম্পদের তিনভাগের দুইভাগ আসে জলাভূমি থেকে। প্রাকৃতিকভাবে দূষিত বর্জ্য শোধনে ভূমিকা রাখে জলাভূমি। জলাভূমিসমূহ অতিথি পাখিদের প্রিয় স্থান। শীত মৌসুমে ঝাঁকেঝাঁকে অতিথি পাখিদের কলকাকলিতে ভরে যায় জলাভূমিগুলো। অতিথি পাখিদের খাবারের উৎস এই জলাভূমি। সভ্যতা ও সংস্কৃতি রক্ষায়ও জলাভূমির অবদান রয়েছে। অনেক অঞ্চলের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে জলাভূমিকে কেন্দ্র করে।
জলাভূমিগুলো উদ্ভিদ ও প্রাণীর বাসস্থান ও আশ্রয়স্থল। জীববৈচিত্র্যের আধার। অনেক সময় এমন বিরল উদ্ভিদ ও প্রাণী দেখা যায় যেগুলো শুধু জলাভূমিতেই সন্ধান মেলে। জলাভূমির ঐতিহাসিক গুরুত্বও কম নয়। ভুলে গেলে চলবে না দেশের জলাভূমিগুলো মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক বেশি সহায়তা করেছিলো। জলাভূমিগুলো ছিলো মুক্তিযুদ্ধের এক একটি ঘাঁটি। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভ করতে জলাভূমিগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বন্যার সময় জলাভূমিগুলো অতিরিক্ত পানি ধারণ করে বন্যার হাত থেকে রক্ষা করে। দূষিত পানি বিশুদ্ধকরণ ও পানির গুণাগুণ ঠিক করে এটি পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে। জলজ বাস্তুতন্ত্রের প্রাথমিক খাদ্য উৎপাদক হিসেবে কাজ করে জলাভূমি। বাংলাদেশের প্রধান প্রধান খাদ্যশস্য (বিশেষ করে ধান) ও অর্থকরী ফসলের অর্ধেকের বেশি অংশ উৎপাদিত হয় জলাভূমিতে। মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যের যোগান আসে জলাভূমি থেকে। পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে জলাভূমির গুরুত্ব ব্যাপক। বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলের পর্যটন, রাতারগুল পর্যটন, কাপ্তাই লেক, সুন্দরবন সবই তো কোনো না কোনোভাবে জলাভূমি। জলকে কেন্দ্র করে মৌসুমভিত্তিক পর্যটন গড়ে উঠেছে দেশের অনেক জায়গায়। অনেক দেশে ছোট-বড় জলাভূমিকে আকর্ষণীয় ও পরিপাটি করে স্থানীয়ভাবে পর্যটক আকর্ষণ করা হচ্ছে।
জলাভূমির উদ্ভিদ প্রজাতির সংখ্যা অগণিত। সুন্দরবনের সুন্দরী, কেওড়া, গরান, গোলপাতা, হোগলা উল্লেখযোগ্য। এছাড়া রয়েছে শালুক, শাপলা, নলখাগড়া, মাখানা, কলমী, শ্যাওলা, পদ্ম, কচুরিপানা, পানিফল, বিভিন্ন ধরনের গাছ ও লতাপাতা। জলাভূমিতে যে কত ধরনের মাছ, উভচর ও সরীসৃপ প্রাণী, পাখি আছে তার ইয়ত্তা নেই। কোঁচবক, সাদাকাক, শামুকখোল, ছোট গুলিন্দা, ভূতিহাঁস, শঙ্খচিল, বামুনিয়া হাঁস, পিংহাঁস, জৌরাব্বী, বড়গুলিন্দা, পানকৌড়ি, গয়ার, জলপিপি, কায়েম, মদনটাক, জলপায়রা, জলময়ূর, নাস্তাহাঁসসহ হাজার রকমের পাখি আছে। জলাভূমি কচ্ছপ, প্রবাল, কাঁকড়ার আশ্রয়স্থল। অপরিকল্পিত নগরায়ণের চাপে জলাভূমিগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। ‘প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০’ অনুযায়ী কোনো পুকুর-জলাশয়, নদী-খাল ভরাট করা বেআইনি। আবার ‘বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-২০১০’ অনুযায়ী জাতীয় অপরিহার্য স্বার্থ ছাড়া কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারি বা আধা সরকারি, এমনকি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পুকুর বা জলাধার ভরাট করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু কোনো না কোনোভাবে প্রাকৃতিক জলাভূমিগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এতে করে সার্বিকভাবে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। তথ্য মতে, বিংশ শতাব্দী থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় ৬৩ শতাংশের বেশি জলাভূমি ধ্বংস করা হয়েছে। এর ফলে জলাভূমির ওপর নির্ভরশীল মানুষ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
এক বেসরকারি গবেষণার তথ্য বলছে- ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা শহরে মোট আয়তনের জলাভূমি ও নিম্নভূমি ছিলো প্রায় ৬০ ভাগ। কিন্তু বর্তমানে ঢাকায় আয়তনের মাত্র ২১ ভাগ জলাভূমি ও নিম্নাঞ্চল রয়েছে। শুধু ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকা থেকে বছরে প্রায় ৫ হাজার একর জলাভূমি হারিয়ে যাচ্ছে। আর এভাবে সারা দেশে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৪২ হাজার একর জলাধার ভরাট করা হচ্ছে। রাজধানী ঢাকা শহরে জলাভূমি ভরাটের বিরূপ প্রভাব পড়েছে। শহরের জলাভূমি কমে যাওয়ার ফলে শহরের গড় তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। শহরাঞ্চলে সুষ্ঠুভাবে বসবাসের জন্য ও নাগরিক জীবনকে বাসযোগ্য করার জন্য জলাভূমিগুলোর ভূমিকা রয়েছে। যদি জলাধারগুলো নষ্ট হয়ে যেতে থাকে এবং শহরে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটে তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে পানিপ্রাপ্তির ওপর ঝুঁকি তৈরি হবে। কেনোনা জলাভূমিগুলো নগরের তাৎক্ষণিক পানি সরবরাহের সবচেয়ে বড় উৎস। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে যখন ঢাকার ‘ড্যাপ’ (ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা) বাস্তবায়নের ওপর জোর দেয়া হয়েছিলো, তখন ভাবা হয়েছিলো ঢাকার চারপাশের জলাভূমিগুলো রক্ষা পাবে। কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়ণের চাপে একের পর এক জলাভূমি হারিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে।
বাসযোগ্য শহরে কমপক্ষে ১২-১৫ শতাংশ জলাশয় দরকার। কিন্তু ঢাকা শহরে আছে মাত্র ৪ ভাগের কিছু বেশি। তথ্য মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৯ লাখ হেক্টর জলাভূমি রয়েছে। সম্প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে যে ১২টি এলাকাকে পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তার সবকটিই জলাভূমি। বোঝায় যাচ্ছে দেশের জলাভূমিসমূহ কতটা বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বলা হয়ে থাকে, যেখানে পানি আছে সেখানে প্রাণ আছে। জলাভূমি সংরক্ষণ না করার ফলে অনেক দেশীয় মাছ ইতিমধ্যে হারিয়ে গেছে। অনেক জলজ লতা গুল্ম এখন আর দেখা যায় না শুধু জলাভূমি হারিয়ে যাওয়ার কারণে। অনেক ব্যাঙ, জলজ কীট বিপন্ন হওয়ার পথে রয়েছে। জলাভূমি হারিয়ে যাওয়ার ফলে প্রাণীজগতের বৈচিত্র্যতা হারিয়ে যেতে বসেছে। ফলে জলভাগের খাদ্যশৃঙ্খল বিনষ্ট হয়ে পড়েছে। জলাভূমি দুর্যোগ হ্রাস করে এবং ঝুঁকি কমিয়ে বায়ুমণ্ডলকে রক্ষা করে। এর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণূ ভূমিকা রয়েছে স্থলভাগের তাপমাত্রা শোষণে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বায়ুমণ্ডলের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো জলের আধার কমে যাওয়া। জলাভূমি যত কমবে পৃথিবীর তাপমাত্রা তত বাড়বে। জলাভূমি নদী ও জলাভূমিকেন্দ্রিক মৎস্য আহরণকারীদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জীবন ও জীবিকার সঙ্গে জড়িত এদেশের ছোট-বড় জলাভূমি।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮(ক)- এর অনুচ্ছেদে পরিবেশ, জলাভূমি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের কথা উল্লেখ রয়েছে। বলা হয়েছে- ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্য প্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’ জলাভূমি সংরক্ষণে সচেতনতার লক্ষ্যে প্রতিবছর ‘বিশ্ব জলাভূমি দিবস’ পালন করা হয়। কিন্তু তথ্য বলছে, পৃথিবীর সব দেশে শুধু সংরক্ষণের অভাবে জলাভূমির আয়তন কমছে। তাই সবার আগে জলাভূমির দূষণ বন্ধ করতে হবে।
জলাভূমি সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারই হবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ উপায়। জলাভূমি রক্ষা করতে না পারলে শুধু প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতি বিলুপ্ত হবে না, ধ্বংস হয়ে যাবে সামগ্রিক বাস্তুতন্ত্র। জলাভূমি হারিয়ে গেলে জীববৈচিত্র্য রক্ষা হবে না। আর জীববৈচিত্র্য না বাঁচলে প্রকৃতি ও পরিবেশ ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে। বাড়বে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা। জীবন রক্ষায় জলাভূমি বাঁচাতে হবে। জলাভূমি রক্ষায় বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। জলাভূমি ভরাট ও দূষণ বন্ধ করতে হবে। বিল শুকিয়ে মাছ ধরা বন্ধ ও চায়না জাল নিষিদ্ধ করতে হবে। জলাভূমির ইজারা প্রথা বন্ধ করতে হবে। হাওরগুলোর ঐতিহ্য ধরে রেখে পর্যটন আকর্ষণ করতে হবে। জলাভূমিগুলো পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করতে হবে। স্থানীয়, আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে জলাভূমিগুলো সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার কথা গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। জলাধার থেকে ব্যক্তি, স্থানীয় জনগণ ও সরকার যাতে লাভবান হতে পারে এবং জলাধারও রক্ষা পায় এমনসব উদ্যোগের কথা ভাবতে হবে। জীবন বাঁচাতে ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে জলাভূমি রক্ষা করতে হবে।
লেখক: শিক্ষক