সারা দেশে আজ ৫ ফেব্রুয়ারি উদযাপিত হচ্ছে ‘জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস ২০২৫’। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘সম্মৃদ্ধ হোক গ্রন্থাগার এই আমাদের অঙ্গীকার’। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রের আলোকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সরকারি-বেসরকারি গ্রন্থাগার একযোগে দিবসটি উদযাপন করে থাকে। যেকোনো জাতির মেধা-মনন, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক, বাহক ও লালনকারী হিসেবে গ্রন্থাগার গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। এই দিবস পালনের মাধ্যমে বাংলাদেশের সব স্তরের জনগণ, ছাত্র-শিক্ষক, গবেষক সবাই বইপড়ার গুরুত্ব অনুধাবন এবং নিজেদের পাঠাভ্যাস বৃদ্ধি করে উন্নততর ফলাফল অর্জন করবেন এবং সার্বিকভাবে জীবনমান ও জাতীয় উন্নতি ঘটাবেন-এই প্রত্যাশাকে সামনে রেখেই প্রতিবছর এই দিনে জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস উদযাপন করা হয়ে থাকে।[inside-ad]
তথ্য, সভ্যতা ও উন্নয়নের প্রধানতম চালিকা শক্তি। তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই মানব সভ্যতা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ক্রমাগত এগিয়ে চলছে। যে জাতি যতো বেশি তথ্য ব্যবহার করে–সে জাতি ততো বেশি উন্নত ও সভ্য। অনুরূপভাবে এখন মনে করা হয়, যে জাতি যতো বেশি ইন্টারনেট ব্যবহার করে সে জাতি ততো বেশি অগ্রসর। তবে ইন্টারনেট ব্যবহারের আর এক ধাপ এগিয়ে বিশ্বের অগ্রসরমান দেশগুলো এখন ৫ম শিল্পবিপ্লব (ইন্ডাস্ট্রি-৫) বাস্তবায়নের কাজে ব্যস্ত।
এ কথা সত্য যে, তথ্যের বাহন হচ্ছে পুস্তক, সাময়িকী, দলিলপত্রাদি ও বর্তমানকার ডিজিটাল পাঠসামগ্রী। আর এ সবকিছুর আধার হচ্ছে গ্রন্থাগার। গ্রন্থাগারের কাজ হচ্ছে–প্রয়োজনভিত্তিক তথ্য নির্বাচন ও বাছাই, তথ্য সংগ্রহ, তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ ও পাঠকের চাহিদা মোতাবেক সেগুলো বিতরণ। তথ্য ব্যবস্থাপনার এ সকল কাজ করার জন্যে রয়েছে বিভিন্ন শ্রেণির গ্রন্থাগার। যেমন–শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগার, গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জন্যে বিশেষায়িত গ্রন্থাগার, সব শ্রেণির মানুষের জন্যে ব্যবহারযোগ্য গণগ্রন্থাগার এবং জাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের জন্যে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত জাতীয় গ্রন্থাগার। বিশ্বের সব দেশেই গ্রন্থাগারের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। বলা প্রয়োজন, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যে উল্লেখিত সব প্রকার গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা, এ গুলোর সুষ্ঠু পরিচালনা, সর্বোত্তম ও সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। গ্রন্থাগারের আবশ্যকতা, এগুলোর যথাযথ ব্যবস্থাপনা, ছাত্র-শিক্ষক-গবেষক ও সাধারণ জনগণকে তাদের ঈপ্সিত তথ্য ও সেবা দানের কার্যকারিতা পর্যালোচনা ও ফলাফল ভিত্তিক মূল্যায়নই জাতীয় গ্রন্থাগার দিবসের মূল প্রতিপাদ্য। জাতীয় গ্রন্থাগার দিবসে গ্রন্থাগার ব্যবহারকারী, গ্রন্থাগারকর্মী, প্রতিষ্ঠান প্রধান, পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান দেশের গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন দিক পর্যালোচনাপূর্বক জাতীয় উন্নয়নে বিভিন্ন শ্রেণির গ্রন্থাগারের অবদান, সফলতা ব্যর্থতা নিরূপণ ও ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণ করবেন। মূলত এই প্রত্যাশাকে সামনে রেখেই সরকারিভাবে জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
প্রথমেই ধরা যাক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগারের কথা। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বাংলাদেশের ৮২ হাজার ৫৬৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গ্রন্থাগার রয়েছে কিংবা থাকার কথা এবং এগুলোর ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছাত্র-শিক্ষক মিলে দুই কোটির বেশি। এ ছাড়া এগুলোতে বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন যাদের অনেকেই গ্রন্থাগার ব্যবহার করে থাকেন। অভিজ্ঞতা ও জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা জানেনই না, তাদের বিদ্যালয়ে একটি গ্রন্থাগার আছে ও সেখানে বসে বই পড়া যায় কিংবা সেখান থেকে ধার করে বই বাড়ি নিয়ে পড়া যায়। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের অবস্থা প্রাথমিকের চেয়ে ভালো। কিন্তু এগুলোর অবকাঠামো ও সংগ্রহ শিক্ষার্থীদের চাহিদার তুলনায় নিতান্ত অপ্রতুল।[inside-ad-2]
একইভাবে কলেজ গ্রন্থাগারগুলোর অবস্থা আর একটু ভালো হলেও প্রয়োজনের তুলনায় আশানুরূপ নয়। এর পরে আসে বিশ্ববিদ্যালয়য় গ্রন্থাগার। সরকারি-বেসরকারি প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রন্থাগার থাকা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি প্রাপ্তির পূর্বশর্ত। তাই বাধ্য হয়েই উদ্যোক্তাদের প্রয়োজন মাফিক গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করতে হয়। অন্তত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) পরিদর্শন চাহিদা মেটানোর জন্যে।
প্রাথমিক শিক্ষা প্রসার ও সর্বজনীন করার কাজে সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী ইউনিসেফ ও বিশ্ব ব্যাংকের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার মান আশানুরূপ নয়। প্রতিবেদন আরো বলছে, প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কা ও ভারতের ২য় ও ৩য় শ্রেণির শিক্ষার্থীরা যা জানেন বাংলাদেশের ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা তা জানেন না। আর কলেজ পাস করা শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় শতকরা ৯০ জন অকৃতকার্য হন। সংবাদপত্রের পাতায় সে খবর অপ্রিয় হলেও আমাদের দেখতে হয়। সুতরাং প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার মান যে আশানুরূপ নয়, সে কথা বলাই বাহুল্য।
বস্তুত গ্রন্থাগারভিত্তিক পড়াশোনা না করা এর অন্যতম কারণ। গ্রন্থাগার ও তথ্য ব্যবহারের বর্তমান মানদণ্ড হচ্ছে বৈশ্বিক জ্ঞান সূচক, বৈশ্বিক অর্থনীতি সূচক এবং বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের বৈশ্বিক র্যাংকিং ইত্যাদি। এতদসংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এগুলোর কোনোটিতেই বাংলাদেশ বতর্মানে সম্মানজনক স্থানে নেই। গেলো বছরের বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকের তালিকা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম নলেজ ফাউন্ডেশন (এমবিআরএফ)। এ তালিকায় বিশ্বের ১৫৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২০তম। টাইমস হায়ার এডুকেশনের বৈশ্বিক বিশ্ববিদ্যালয় সূচক-২০২৪ মতে, বিশ্বের প্রথম ৮০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। এ তালিকায় ভারতের ২৪টি ও পাকিস্তানের ৮টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন সূচক (২০২৩) অনুসারে বিশ্বের ১৯৩ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান ১২৯তম। অর্থনীতি সূচকে ১৩৩ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১১৬তম অবস্থানে আছে।
গণগ্রন্থাগারের অস্তিত্ব বাংলাদেশে প্রাচীনকাল থেকেই বিদ্যমান। সাধারণ মানুষকে তথ্য ও জ্ঞান প্রদানে এ সকল গ্রন্থাগারের ভূমিকা স্মরণীয় এবং ঐতিহাসিক। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর জেলায় জেলায় সরকার গণগ্রন্থাগার চালু করে। প্রতি থানা ও উপজেলায় গণ-গ্রন্থাগার স্থাপনের পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে বলে জানা যায়। গণগ্রন্থাগারকে বলা হয়, ‘জনগণের বিশ্ববিদ্যালয়’। আমাদের গণ-গ্রন্থাগারগুলো দেশের সাধারণ মানুষের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জ্ঞানবিস্তারের কাজ কতোটা করছে তা আজ এই জাতীয় গ্রন্থাগার দিবসে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।
সবশেষে আসে জাতীয় গ্রন্থাগার ও জাতীয় আর্কাইভস এর কথা। বিশ্বের ছোট বড় সব দেশেই জাতীয় গ্রন্থাগার ও জাতীয় আর্কাইভস-এর অস্তিত্ব বিদ্যমান। বাংলাদেশেও স্বাধীনতার পর সরকার জাতীয় গ্রন্থাগার ও জাতীয় আর্কাইভস প্রতিষ্ঠা করে। এর উদ্দেশ্য হলো–জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষার্থে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ব্যবহারের জন্যে দেশ থেকে প্রকাশিত ও দেশ সম্পর্কে বিদেশে প্রকাশিত সব প্রকাশনার কপি সংগ্রহ করা। আর জাতীয় আরকাইভের কাজ হচ্ছে ইতিহাস ঐতিহ্য ও গবেষণা সম্বলিত শ্রেণিকৃত পুরোনো (২৫ বছরের অধিক) প্রকাশনা ও দলিলাদি সংগ্রহ করা। শের-ই-বাংলা নগরস্থ আগারগাঁও-এ অবস্থিত সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় আর্কাইভস এবং গ্রন্থাগার এ কাজ করছে। ইতিহাসবিদ ও প্রকৃত গবেষকরাই বলতে পারবেন জাতীয় গ্রন্থাগার ও আর্কাইভস জাতীয় ইতিহাস ঐতিহ্যের ওপর তথ্য সরবরাহে কতোটা সক্ষম?
ওপরের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয়, বাংলাদেশে সবধরনের গ্রন্থাগারের অস্তিত্ব বিদ্যমান। বৈশ্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এর বিকল্প নেই। কিন্তু মানের দিক থেকে আমাদের অবস্থান কোথায় তা নির্ধারণের সময় এসেছে। জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস সেই দাবিই করে। বৈশ্বিক বিভিন্ন সূচকের আলোকে বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে ইতোপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। এ অবস্থার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা, গবেষণা, গ্রন্থাগার ব্যবস্থা এ সব কিছুতেই সংস্কার আনা প্রয়োজন।
প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বায়নের এই যুগে বাংলাদেশকে একটি সম্মানজনক স্থানে নিয়ে যেতে হলে বৈশ্বিক বিভিন্ন সূচকে অগ্রসর হতে হবে। এ অবস্থায় জাতীয় গ্রন্থাগার দিবসে আমাদের পরামর্শ হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তক ও গ্রন্থাগারভিত্তিক পড়াশোনায় মনোনিবেশ করানো। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়াশুনার সম্পর্ক দৃঢ়তর করা এবং স্মার্টফোনকে অর্থবহ কাজে লাগানো। সর্বস্তরে লক্ষ্যভিত্তিক গুণগত শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্যে অগ্রাধিকারভিত্তিতে কিছু বিষয় সরকার বিবেচনা করতে পারে।
শিক্ষাখাতে ব্যয় বৃদ্ধি করা। জিডিপির ২ দশমিক ৫ থেকে ৩ শতাংশ করা যায় কি না, যা চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে ব্যয় জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ।
প্রতিটি গ্রন্থাগারের বাজেট থাকা প্রয়োজন এবং পর্যালোচনাপূর্বক প্রতি বছর তা বৃদ্ধি করা। স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা পর্যায়ের গ্রন্থাগার পরিচালনায় বিদ্যমান পরিবীক্ষণ পদ্ধতি নিবিঢ়তর করা।
এমপিওভুক্তির সময়ে প্রতিষ্ঠান কতৃপক্ষকে যে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে তা মেনে যথানিয়মে গ্রন্থাগার পরিচালনা করা। সেইসঙ্গে প্রতিটি গ্রন্থাগারে ইন্টারনেট সুবিধাসহ কম্পিউটার সরবরাহ করা।
সরকার নির্দেশিত বিদ্যালয়সমূহে বর্তমানকার প্রচলিত লাইব্রেরি ক্লাস কার্যক্রম নিশ্চিত ও জোরদার করা; এতে শিক্ষার্থীদের গ্রন্থাগার ব্যবহারে আগ্রহ বাড়বে। বিদ্যালয়, উচ্চবিদ্যালয় এবং মহাবিদ্যালয় গ্রন্থাগারের গ্রন্থাগারিকের শূন্যপদ পূরণ করা।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণা কার্যক্রম বৃদ্ধির জন্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা; বৈশ্বিক র্যাঙ্কিংয়ে উচ্চস্থানে অধিষ্ঠিত হওয়ার লক্ষ্যে প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিজ্ঞ শিক্ষকদের নিয়ে টার্মস অব রেফারেন্সসহ একটি সেল তৈরি করা, এর কার্যক্রম পরিবীক্ষণ করা এবং ওবিই বাস্তবায়নের মাধ্যমে গুণগত শিক্ষার লক্ষ্যে সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
লেখক: উপদেষ্টা, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ