
জনগণের দোরগোড়ায় উচ্চশিক্ষা পৌঁছাতে সরকার প্রতি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করছে বলে পূর্ববর্তী সরকারের ’শ্লোগান’ যে কতোটা হাস্যকর এবং ফাঁকা বুলি ছিলো সেটি একজন সচেতন মানুষ সহজেই বুঝতে পারেন। যেখানে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা এলোমেলো অবস্থায় আছে, শিক্ষার মান তলানিতে অবস্থান করছে, সেখানে জনগনের দোরগোড়ায় উচ্চশিক্ষা নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা যে কি উদ্দেশে করা হয়েছিলো তা কারোরই বুঝতে বাকি থাকে না।
ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে মোট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৭০। এর মধ্যে পাবলিক ৫৫ ও বেসরকারি ১১৫টি। এগুলোর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিগত সরকারের পনের বছরে। দেড় দশকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৮৭টি বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে ২৬টি পাবলিক আর ৬১টি বেসরকারি পর্যায়ে। পূর্ববর্তী সরকারের শেষ সময়ে নতুন করে আরো দশটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো। এতো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে দেশে বেড়েছে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা, যা ছয় বছরের ব্যবধানে বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।
কিছু মানুষকে শিক্ষক কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ দিয়ে, কিছু অবকাঠামো নির্মাণ করে কয়েকটি বিভাগ খুলে ছাত্রছাত্রী ভর্তি করলেই আর একটি প্রতিষ্ঠানকে নাম দিলেই বিশ্ববিদ্যালয় বলা যায় না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যেসব কলেজ রয়েছে আন্ডারগ্রাজুয়েট বা অনার্স বা মাস্টার্স পড়ানো হয় সেগুলো তো এক অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়ই।
একেকটি বিভাগে চার থেকে ছয়জন শিক্ষক অর্থাৎ সেখানে অনার্স-মাস্টার্স খুলে বসে আছে। ওইসব কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক ও পাস কোর্স থাকলে সেগুলোতেও সীমিত সংখ্যক শিক্ষকের ক্লাস নিতে হয়। অবার তাদের অনার্স ও মাস্টার্সেও পড়াতে হয়। একে তো প্রচুর প্রেসার, দ্বিতীয়ত কজন শিক্ষক সঠিক প্রস্তুতি নিয়ে অনার্স কিংবা মাস্টার্সে পড়াতে পারেন। সে বিষয়গুলো কেউ কখনো আমলে নেয়নি। শিক্ষকতায় বিশ্বব্যাপী যে পরিবর্তনের ঢেউ খেলে যাচ্ছে তার সঙ্গে কলেজ পর্যায়ে যেসব শিক্ষক অনার্স-মাস্টার্সে পড়াচ্ছেন তাদের কজনের পরিচিতি আছে সেটি একটি বড় প্রশ্ন। শিক্ষায় পরিবর্তনের মধ্যে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ একটি বড় বিষয়।
প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান আছে, মাধ্যমিকের জন্যও আছে। তা ছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে এবং সরকারি বিভিন্ন প্রজেক্টের মাধ্যমে এসব শিক্ষকদের মাঝে মাঝে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয় যে সুযোগ কলেজ পর্যায়ের শিক্ষকদের নেই। তাহলে তারা কীভাবে অনার্স-মাস্টার্সে পড়াচ্চেন, কি পড়াচ্ছেন সেই প্রশ্ন আমরা কখনো তুলছি না। যারা অনার্স-মাস্টার্স খোলার অনুমতি দিয়েছেন তারা কি কখনো এসব বিষয় চিন্তা করেছেন? লাখ লাখ শিক্ষার্থী অনার্স-মাস্টার্স ডিগ্রি দিয়ে বের করে দেয়া হচ্ছে মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে।
স্বাধীনতার পর দেশে ৪টি সাধারণ ও ২টি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে উচ্চশিক্ষার যাত্রা শুরু করে। একই সঙ্গে বরিশাল বিএম কলেজ, সিলেটের এম সি কলেজ, রংপুরের কারমাইকেল কলেজসহ আরো কয়েকটি কলেজ যেখানে অনার্স-মাস্টার্স পড়ানো হয় সেগুলো নিয়ে উচ্চশিক্ষার যাত্রা শুরু হয়। তখনো কিন্তু শিক্ষার মান ছিলো। কলেজ থেকে অনার্স-মাস্টার্স পাশ করেও তারা চাকরির বাজারে ভালো অবস্থানে থাকতেন যেই বিষয়টি এখন আর ঘটছে না ব্যতিক্রম ছাড়া। বিশ্বব্যাপী উন্নতির সোপানের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিযোগিতা বেড়ে গেছে, সেই প্রতিযোগিতায় টিকতে যে পরিমাণ অধ্যবসায়, অনুশীলন, পড়াশোনা ও দক্ষতা অর্জন প্রয়োজন সেটি এসব প্রতিষ্ঠান থেকে বের হওয়া হচ্ছে না শিক্ষার্থীদের। এগুলোর দিকে লক্ষ্য না রেখে শুধু প্রতিষ্ঠান বাড়ানো বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ানো এক ধরনের সুইসাইড।
আমাদের প্রয়োজন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাকে অত্যন্ত মানসম্মত করা এবং এটি রাষ্ট্রের পবিত্র দায়িত্ব। আমরা সেখানেই বহু পিছিয়ে আছি। সবাইকে উচ্চশিক্ষিত করার দায়িত্ব আমাদের মতো গরিব রাষ্ট্রের নয়। আমাদের প্রয়োজন টেকনিক্যাল শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের স্বাবলম্বী করে তোলা। সেটি না করে অর্থাৎ গোড়া শক্তিশালী না করে ওপরের দিকে বাড়াতে থাকলে সহজেই পুরো ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে আর সেই বিষয়টিই করা হয়েছে যা আমাদের গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের শিক্ষানীতিতে উল্লিখিত কর্মমুখী ও বিশেষায়িত শিক্ষার ওপর অধিক গুরুত্ব দেয়ার কথা বলা হয়েছিলো এবং সেটিতে জোর দিতে হবে।
তাই সহজেই বলা যায় যে, বিগত সরকার জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে উচ্চশিক্ষার মানের ব্যাপক অবনতি ঘটিয়েছে। তারা শিক্ষার মানের প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে একের পর এক পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খোলার প্রতিযোগিতায় নামে। আমরা জানি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কেবল জ্ঞান বিতরণ নয়, নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টিও। আর সেটি করতে হয় নিরন্তর গবেষণার মাধ্যমে। এ কারণেই পৃথিবীর খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কাজকে অগ্রাধিকার দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় তো কেবল শ্রেণিকক্ষের পাঠদান নয়। গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি ছাড়া একটি প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে না অথচ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ বিষয়ে ভীষণ উদাসীন। বলা যায় এ জাতীয় কোন চিন্তা-ভাবনাও নব্য প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোর নেই। আমরা যখনই বলি যে, শিক্ষার মান নিম্নগামী তখন ভাবি যে, পড়াশোনা ভালো হয় না। তাই অনেক সময় শোনা যায় যে, কিছু ভালো শিক্ষক এনে ভালো ক্লাস নিলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মান বেড়ে যায়, বিষয়টি কিন্তু শুধু তা নয়।
জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষার ‘আত্মাহুতি’ শীর্ষক বক্তৃতায় জনৈক ইউজিসি সদস্য বলেছেন ১৬ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা জেনোসাইডের মতো ‘এডুসাইডের’ শিকার হয়েছে। উচ্চশিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ নয়, দলীয় সমর্থক গোষ্ঠীকে সুবিধা দেয়ার জন্যই এসব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো। একটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেখানে অবকাঠামো নেই, শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৬০০, কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রায় ৩০০, শিক্ষক ১০৪ জন, বিভাগ ২৪টি। অথচ শিক্ষকদের বসার পর্যাপ্ত জায়গা নেই, গ্রন্থাগার নেই। ২১টি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয় ভাড়াবাড়িতে।
এসব বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে বিগত সরকার যোগ্যতা থাকুক আর না-ই থাকুক, দলীয় লোকদের পদায়ন করেছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে দশ থেকে বিশ লাখ টাকা পর্যন্ত উৎকোচ নেয়ার খবর পত্রিকায় বের হয়েছে। জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা মানে উচ্চশিক্ষার সর্বনাশ ডেকে আনা। আর তাই হয়েছে এতো বছরে। তার জের হিসেবে এখন জায়গায় কলেজের শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করে জনদুর্ভোগ চরমে নিয়ে গেছে। তাদের দাবি তাদের কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা করতে হবে। তারা ষোল বছরের ইতিহাস থেকে দেখেছে যে, একটি কলেজ এমনকি বিদ্যালয়ের মতো আবকাঠামাতে গড়ে তোলা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়, সেই সুযোগটি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা নিতে চাচেছন। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাই পাল্টে দিয়েছে পূর্ববতী সরকারের যত্রতত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কারণে।
ওই আমলে যত্রতত্র পাবলিক মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। মেডিক্যাল কলেজের মতো বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তো যেনতেন প্রকারে চালু করলে শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন, হয়েছেও তাই।
সম্প্রতি স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম পাবলিক মেডিক্যাল কলেজগুলোর সম্ভাব্যতা যাচাই করার কথা বলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রেও একই ধনের পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। যেসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ন্যূনতম অবকাঠামো ও শিক্ষক নেই, সেসব বিশ্ববিদ্যালয় টিকিয়ে রাখার যুক্তি আছে বলে মনে হয় না। উচ্চশিক্ষা জাতির বিবেক সৃষ্টির অন্যতম মাধ্যম, সে কারণে প্রত্যোক জাতি উচ্চশিক্ষা বিস্তার ও এর গুণগত উন্নয়নের মাধ্যমে সমাজের প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের অবস্থানকে সুদৃঢ় করতে তৎপর থাকে। উচ্চশিক্ষা একাডেমিক উন্নয়নের পাশাপাশি টেকনিক্যাল, প্রকৌশল, স্বাস্থ্য, কৃষি ও শিল্প উন্নয়নের মাধ্যমে জাতিকে উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরি করতে সহায়তা করে। কিন্তু আমাদের এই পনের-ষোল বছরে প্রতিষ্ঠিত তথাকথিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে কি ঘটেছে?
তবে, কিছুটা হলেও আনন্দের সংবাদ হলো দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কমানোর সুপারিশ করেছে অন্তবর্তী সরকার গঠিত বৈষম্যহীন টেকসই উন্নয়নের জন্য অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ ও প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণ বিষয়ক টাস্কফোর্স। সম্প্রতি টাস্কফোর্স কমিটির পক্ষ থেকে এ সুপারিশ সংবলিত একটি প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তারা সুপারিশ করেছেন কিছু সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে একীভূতকরণের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কমিয়ে আনতে। আমরাও বিষয়টিতে একমত। আমরা মনে করি, যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়নি, সেগুলো নিয়ে আর এগোনোর প্রয়োজন নেই। যেগুলোর কার্যক্রম চলছে, সেগুলোর বিষযে বাস্তবভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে দেখতে হবে, শিক্ষার্থীরা যেনো কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হন। উচ্চশিক্ষার নামে বিশ্ববিদ্যালয় দলীয় লোক পুনর্বাসনের কেন্দ্র হতে পারে না। উচ্চশিক্ষার ধারণা ভবিষ্যৎ প্রজন্মেও কাছে ভুলভাবে উপস্থাপন করা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক