
বাংলাদেশে কোনো বিশেষ পেশা, দল বা গোষ্ঠীর দাবি আদায়ের জন্য বলপ্রয়োগের কৌশল হিসেবে যখন তখন যেখানে সেখানে বিক্ষোভ মিছিল, যানবাহন ও দালানকোঠা ভাঙচুর কিংবা জ্বালাও-পোড়াও, রাস্তাঘাট অবরোধ, অফিস-আদালত ও কর্মকর্তাদের বাসভবন ঘেরাওসহ নানা নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। তাই দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা দেশের নিরীহ জনগণের দুর্দশা ও দুর্ভোগের এ বিষয়টি আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অসুস্থতার উপসর্গ, জরুরি ভিত্তিতে সুরাহা হওয়া দরকার।
রাস্তা অবরোধ, কর্মবিরতি কিংবা হরতালের মতো কর্মসূচিগুলো প্রায়ই সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করছে, এমনকি স্থবির করে দিচ্ছে। এর ফলে হাসপাতালের রোগী, পরীক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন কিংবা দিনমজুরের জীবন-জীবিকা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জনগণের মতামত ও অধিকার সুরক্ষা গণতন্ত্রের ভিত্তি হলেও, দাবি আদায়ে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে কাঠামোগত অসংগতি এবং কার্যকর বিকল্পের অভাব আমাদের সংকটকে আরো গভীর ও প্রায়ই সংঘাতমুখী করে তুলেছে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূলভিত্তি হওয়া উচিত জনগণের মতামত ও অধিকারকে প্রাধান্য দেয়া ও সুরক্ষিত করা। কিন্তু বিদ্যমান কাঠামোতে নাগরিকদের দাবি উত্থাপন ও সমস্যার সমাধানে কার্যকর পন্থার অভাবে হরহামেশা লোকজন রাস্তায় নেমে সংঘাত, দুর্ভোগ ও অচলাবস্থা তৈরি করছে। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রয়োজন এমন একটি সমাধানের, যা একদিকে নাগরিকদের দাবির প্রতি সুবিচার করবে, অপরদিকে জনজীবনের স্বাভাবিক গতি বজায় রাখবে এবং একটি কল্যাণমুখী রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভিত্তি স্থাপন করবে। দাবি আদায়ের একটি যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য পন্থা অবলম্বনের জন্য নিচের পদক্ষেপগুলো নেয়া যেতে পারে।
১. জনগণের দাবি-দাওয়া মীমাংসার জন্য একটি জাতীয় দাবি কমিশন (জাদাক) প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে জাতীয় দাবি কমিশন গঠনের এ প্রস্তাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই কমিশনের প্রধান কাজ হবে অভিযোগ বা দাবিগুলোকে গ্রহণ, যাচাই বাছাই করা এবং যৌক্তিকতা ও প্রাসঙ্গিকতার গুরুত্বের ভিত্তিতে যথাযথভাবে সেগুলোকে সমাধানের পথ নির্ধারণ ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বিশেষ করে সম্পৃক্ত পক্ষগুলোকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে এসে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে উপনীত হওয়ার ব্যবস্থা করা। এই কমিশনকে বিভিন্ন সেক্টর ও ইউনিটে ভাগ করে দায়িত্ব অর্পণ করা যেতে পারে। যেমন খাদ্য, স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, শিক্ষা, বাসস্থান, পরিবহন, শিল্প, কৃষি প্রভৃতি সেক্টরের দাবি বা অভিযোগগুলোকে সঠিকভাবে শ্রেণিবিন্যাস করে দ্রুত সুরাহা করার ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে। দেশের সম্মানিত নাগরিকদেরকে প্রতিটি সেক্টর ও ইউনিটের জন্য ন্যায়পাল নিয়োগ করা যেতে পারে। তার অধীনে একটি করে প্যানেল থাকতে পারে। তার অবর্তমানে দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন সদস্য অন্যান্য সদস্যের সহায়তায় অভিযোগগুলো সমাধানের প্রক্রিয়ার কার্যক্রম অব্যাহত রাখবেন। সমযোতার জন্য একটি সমন্বিত ও উন্মুক্ত ফোরাম তৈরি করলে নাগরিকদের অভিযোগ প্রকাশ ও সমাধানের প্রক্রিয়া সহজতর হয়। এই কমিশন একটি সঠিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করতে পারে, যেখানে জনগণের দাবি গণতান্ত্রিক উপায়ে সমাধান করা যাবে। এ কমিশনটি জনকল্যাণমূলক প্রশাসনের ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এবং সংঘাতের পরিবর্তে সমযোতা ও সমাধানের পথে খুঁজতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এক্ষেত্রে জার্মান দার্শনিক ও সামাজিক তাত্ত্বিক ইয়োগন হাবারমাসের (১৯২৯) ‘জনপরিসর’ (পাবলিক স্পিয়ার) তত্ত্বটি এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক। হাবারমাস যুক্তি দিয়েছেন, একটি কার্যকর ও উন্মুক্ত ফোরাম নাগরিকদের অভিযোগ প্রকাশ ও সমাধানের প্রক্রিয়াকে সহজতর করে। কমিশন এমন একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করতে পারে, যা একদিকে জনমতের প্রতি সুবিচার করবে, অন্যদিকে বিবাদমান পক্ষগুলোর মধ্যে সুশাসনের ভিত্তি মজবুত করবে। এটি সামাজিক ন্যায্যতা এবং গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। তা ছাড়া, কমিশনের কার্যক্রমের উন্মুক্ততা, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার মাধ্যমে একটি নতুন ইতিবাচক সাংস্কৃতিক পরিবেশ তৈরি হতে পারে, যেখানে জনগণ তাদের অধিকার আদায়ের জন্য জনদুর্ভোগ সৃষ্টি ছাড়াই সমযোতার মাধ্যমে কার্যকর ফলাফল প্রত্যাশা করতে পারবে। এটি কেবল একটি প্রশাসনিক পদক্ষেপ নয়, বরং জনশিক্ষার মাধ্যমে জনগণের গণতান্ত্রিক চেতনা উন্নত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবেও কাজ করবে।
২. গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা বিনির্মাণের প্রচেষ্টায় দাবি আদায়ে বিক্ষোভ প্রদর্শণের নেতিবাক বর্তমান অপসংস্কৃতিকে পরিবর্তন করে সেটাকে সুনাগরিকের দায় ও দরদের মাধ্যমে ইতিবাচক সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত করা জরুরি। অবরোধ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, মারামারি বা আত্মঘাতি সংঘাত নয়, বরং শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল পন্থায় নিজ নিজ দাবি উত্থাপন এবং সমাধানের জন্য সবপক্ষকে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। আগেই বলা হয়েছে, ন্যায্য দাবি আদায়ে বিক্ষোভ গণতান্ত্রিক অধিকার। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আমার আধিকার আদায়ের পন্থা যেন অন্যের অধিকার হরণ না করে। তাই অধিকার আদায়ের কোনো পন্থাই যেনো জনজীবনে অচলাবস্থা সৃষ্টি না করে, জনসাধারণের জন্য ভোগান্তির কারণ না হয়, কিংবা জান-মালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত না করে, সেদিকে সবার নজর দেয়া উচিত। দাবি আদায়ে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করার চেয়ে একটি নির্ধারিত স্থানে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ বা প্রতিবাদ আয়োজনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ঢাকার জাতীয় প্রেস ক্লাব, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ প্রতিটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নির্ধারিত স্থানে সাংবাদিক সম্মেলন, মানববন্ধন বা গণস্বাক্ষরের মতো কর্মসূচি পরিচালিত হতে পারে। এখানে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার ঔপনিবেশিক ইতিহাস থেকে দুটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ উল্লেখ করা যেতে পারে। গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতের ঔপনিবেশিক শাসকের বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলন এবং নেলসন ম্যান্ডেলার বর্ণবাদবিরোধী শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ বিশ্বের কাছে প্রমাণ করেছে যে, বড় পরিবর্তনের জন্য সংঘাতময় পন্থা অবলম্বন করা অপরিহার্য নয়। গান্ধীর সত্যাগ্রহ নীতি এবং ম্যান্ডেলার সহনশীল নেতৃত্ব দেখিয়েছে যে জনগণকে সংগঠিত করে, দাবি আদায়ের জন্য সামাজিক চেতনা জাগ্রত করেই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জন করা সম্ভব। বাংলাদেশে জনদুর্ভোগহীন বিক্ষোভের সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য ইতিহাসের এই উদাহরণগুলো বিশেষ প্রাসঙ্গিক। এটি কেবল নাগরিক অধিকার চর্চার একটি সুস্থ পরিবেশ তৈরি করবে না, বরং নতুন প্রজন্মকে শিক্ষা দেবে যে, দাবির প্রতি আস্থা অর্জন ও সমর্থন পেতে অহিংস এবং শান্তিপূর্ণ পন্থাই সর্বোত্তম। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা এবং তা প্রসারের ক্ষেত্রে এই দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
৩. কোনো অবস্থাতেই সরকারি অফিস-আদালত, সচিবালয়, জাতীয় সংসদ, বা কোনো সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারি বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বাসভবন ঘেরাও কর্মসূচি দেয়া উচিত নয়। এমন কর্মসূচি উত্তেজনা ও সংঘাত বাড়ায়, রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমকে ব্যাহত করে এবং এমনকি জান ও মালের ক্ষয়ক্ষতি হয়। এটি কেবল সাধারণ নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না, বরং প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কার্যক্রমে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। সরকার এবং জনগণের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন কমিয়ে আনার জন্য আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দাবিদাওয়া মীমাংসার পথকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। আধুনিক প্রশাসনিক ব্যবস্থায় বহু বিষয়ের আন্ত:সম্পর্ক ও আন্তনির্ভরশীলতার কারণে এমন সংঘাতহীন পন্থা অবলম্বনের প্রয়োজনীয়তা আগের চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে সামাজিক সংলাপের মাধ্যমে জনগণের দাবি উত্থাপন এবং সমাধানের একটি দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। এই ধরনের সংলাপভিত্তিক প্রক্রিয়া উত্তেজনা প্রশমিত করে এবং বিশ্বাস ও সহযোগিতার পরিবেশ তৈরি করে।
৪. গণতান্ত্রিক উপায়ে কর্তৃপক্ষের ওপর দাবি আদায়ে চাপ সৃষ্টির নতুন পদ্ধতি গ্রহণ করা বর্তমান প্রেক্ষাপটে খুবই জরুরি। বিশেষত প্রযুক্তিগত উন্নতির এই ডিজিটাল যুগে, যেখানে জনমত সংগঠিত ও প্রকাশ করার জন্য ইলেকট্রনিক প্রচার মাধ্যম ও যোগাযোগ ব্যবস্থা এক অসাধারণ ভূমিকা রাখতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইন পিটিশন, গণসাক্ষর কর্মসূচি এবং ভার্চ্যুয়াল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে জনগণের মতামত দ্রুত ও কার্যকরভাবে তুলে ধরা সম্ভব। এ ধরনের উদ্যোগ শুধুমাত্র নাগরিকদের দাবিগুলোকে একটি সুসংহত ও সুশৃঙ্খল পদ্ধতিতে উপস্থাপন করার সুযোগ দেয় না, বরং এর মাধ্যমে প্রশাসনের কাছে বিষয়গুলো দ্রুত ও যুক্তিসংগতভাবে উপস্থাপন এবং পৌঁছানো আরো সহজ হয়। এক্ষেত্রেও ‘স্বপ্রোণদিত গণতন্ত্র’ (ডেলিবারেটিভ ডেমোক্রেসি) ধারণা, যা হাবারমাসের তত্ত্ব থেকেই উদ্ভূত, এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই তত্ত্বের মূল বক্তব্য হলো, জনগণের মধ্যে অংশগ্রহণমূলক আলোচনার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে, যেখানে তারা যুক্তিনির্ভর মতামত প্রকাশ ও সমাধানের পথে এগিয়ে যেতে পারেন। স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে নিয়মিত নাগরিক সংলাপ আয়োজন এই সংস্কৃতিকে প্রসারিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তা ছাড়া, ইলেকট্রনিক প্রচার মাধ্যম কেবল চাপ সৃষ্টির মাধ্যম নয়, এটি জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিরও একটি কার্যকর হাতিয়ার।
৫. শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্য সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি তৈরি করা এবং তা ভঙ্গকারীদের আইনের আওতায় আনা এবং শাস্তি প্রদান অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। বিক্ষোভের অধিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি মৌলিক অংশ, তবে এই অধিকার প্রয়োগে শৃঙ্খলা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে অপব্যবহারের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে। এক্ষেত্রে জাতীয় দাবি কমিশনের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট আইনি কাঠামো তৈরি অপরিহার্য। এই নীতিমালায় শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের প্রক্রিয়া, স্থান নির্ধারণ, সময়সীমা, এবং পরিবেশ সংরক্ষণের মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। শৃঙ্খলা ভঙ্গের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের পাশাপাশি, পুনরাবৃত্তি রোধে একটি প্রতিরোধমূলক কাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কিছু দেশে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের জন্য সরকারি অনুমোদন গ্রহণের নিয়ম চালু রয়েছে, যেখানে বিক্ষোভের উদ্দেশ্য, আয়োজন ও নেতৃত্বদানকারীদের পরিচয়, সম্ভাব্য অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা, এবং এর প্রভাবের বিবরণ দেয়া বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশেও এই ধরনের নীতিমালা কার্যকর করা হলে বিক্ষোভ প্রক্রিয়াকে শৃঙ্খলাপূর্ণ রাখা সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে জনশিক্ষা এবং সচেতনতা বড় ভূমিকা রাখতে পারে। শিক্ষার মাধ্যমে জনগণকে বোঝানো উচিত, শান্তিপূর্ণ অহিংস এবং নিয়মমাফিক প্রতিবাদ কেবল বেশি সমর্থন আদায় করে না, বরং তা প্রশাসনের কাছে দাবি উপস্থাপনকে আরো কার্যকর এবং গ্রহণযোগ্য করে তোলে।
বাংলাদেশের বর্তমান নজুক অবস্থায় দাবি আদায়ের প্রক্রিয়া জনজীবনে অস্থিরতা ও দুর্ভোগ সৃষ্টি করার পাশাপাশি রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রগতির পথেও বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পেশিশক্তির প্রদর্শনী ও ধ্বংশযজ্ঞের মাধ্যমে দাবি আদায়ের নেতিবাচক এই প্রক্রিয়া কেবল সাময়িক সমাধান প্রদান করে; দীর্ঘমেয়াদে এটি সামাজিক ও প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা এবং নাগরিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার পথে একটি বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তাই জাতীয় দাবি কমিশন গঠন, নির্ধারিত বিক্ষোভস্থল ব্যবহার এবং শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মতো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। সমাজে আস্থার সংকট কাটিয়ে উঠতে এবং জনদুর্ভোগহীন একটি গণমুখী আন্দোলনের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে সুসংহত নীতিমালা ও প্রশাসনিক কাঠামো অপরিহার্য। উদাহরণ হিসেবে আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলন এবং নেলসন ম্যান্ডেলার শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধ কেবল শাসকের পরিবর্তনই ঘটায়নি, বরং জনগণ ও রাষ্ট্রের মধ্যে আস্থার সম্পর্কও প্রতিষ্ঠা করেছিলো। একইভাবে জনগণের দাবি মীমাংসার ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, যেমন জাতীয় দাবি আদায় কমিশন কার্যকর হতে পারে, তেমনি এটি রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার জন্যও অপরিহার্য পদক্ষেপ। তবে এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নে নাগরিকদের শিক্ষিত ও সচেতন করে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার মাধ্যমে দাবি আদায়ের সুষ্ঠু পদ্ধতি শেখানো এবং জনমত সংগঠনের কলাকৌশল তুলে ধরার পাশাপাশি, সহনশীলতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার সংস্কৃতি গড়ে তোলাও অপরিহার্য। সঠিক পরিকল্পনা ও কার্যকর উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি নতুন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা সম্ভব, যা নাগরিক অধিকার ও রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতাকে সমানভাবে অগ্রাধিকার দেবে।
লেখক: ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য