![সীমানা বাড়ানোর রাজনীতি ফিরছে! সীমানা বাড়ানোর রাজনীতি ফিরছে!](https://www.amaderbarta.net/media/imgAll/2023November/opinion-FB-2502071247.jpg)
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ২৪২ নম্বর রেজুলেশনের পরও ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দই সর্বেশেষ কোন রাষ্ট্র তার প্রতিবেশী দেশের ভূমি দখল করেছিলো। বলছি রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের কথা। যার কারণে শক্তিশালী রাশিয়ার কাঁধে এখনো জাতিসংঘের অবরোধ বলবত আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব নেতারা একটা নীতি মানছিলেন, কোনো রাষ্ট্র প্রতিবেশীদের ভূমি দখল করবে না। সবাই তা অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালন করেছে তাও বলবো না।
যেমন ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে আর্জেন্টিনা ফকল্যান্ড দ্বীপ দখল করে। পরে যুক্তরাজ্য সেখানে নিজের জমি পুনরুদ্ধারে চালায় সেনা অভিযান। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে ইরাক তার প্রতিবেশী কুয়েত দখল করে। পরে কুয়েত থেকে ইরাকিদের বের করে দিতে অবশ্য জাতিসংঘ সামরিক অভিযান অনুমোদন দিয়েছিলো।
এরপর আর মোটা দাগে রাজা, বাদশা আর সম্রাটদের মতো দেশের সীমানা বাড়ানোর বড় কোনো প্রতিযোগিতা মনে পড়ছে না। হালে ভূমি দখলের পুরানো রাজনীতি যেনো মাথাচাড়া দিচ্ছে দিকে দিকে। পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে স্বাধীন রাষ্ট্র আর চুড়ান্ত সীমানার জন্য জীবন দিচ্ছেন ফিলিস্তিনিরা। ইসরায়েল ফিলিস্তিনের ঘটনাকে অনেকে মধ্যপ্রচ্যে পৃথিবীর বিষফোঁড়াও বলেন। দুই দেশের এই ঘটনা স্থায়ী অস্থিরতারও বড় উদাহরণ। স্থায়ী শান্তির প্রত্যাশায় সেরা ছাড়া দিয়েও হতভাগাদের ভাগ্যে অগণিত নারী শিশুর লাশ গণনা করা আর ধ্বংসস্তুপে দাঁড়িয়ে বিলাপ ছাড়া ভূমি এখনো জুটেনি।
চলমান রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া প্রতিবেশীর অনেক ভূখণ্ড দখলে নিয়েছে। অবশ্য পরস্পরে যুদ্ধ করে সীমানা বাড়ানোর এই জয় পরাজয় তাদের মধ্যে। ইসরায়েল ফিলিস্তিনের যে ভূখণ্ড ঘিরে রেখেছিলো তা ফিরে পাওয়ার আশায় ছিলো ফিলিস্তিন। কিন্তু সেই আশায় একেবারেই গুঁড়েবালি। বাসার আল আসাদের সরকার উৎখাতের পর সিরিয়ায় অধিকৃত এলাকার সীমানা আরো বাড়িয়েছে ইসরায়েল। এদিকে গ্রিনল্যান্ড আর কানাডার দিকেও নজর দিয়েছেন বিশ্বমোড়ল, যা নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে-ভূমি দখল আর রাষ্ট্রের সীমানা বাড়ানোর রাজনীতি কী আবার ফিরে আসছে পৃথিবী জুড়ে। ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়ার আগে থেকেই যে বাগাড়ম্বর ছিলো ট্রাম্পের তা পুনঃউচ্চারিত হয়েছে শপথ নেয়ার দিনেও। আর এখন পানামা খাল নিয়ে তো রীতিমত যেনো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের ঘুম হারাম। বিশ্ববাণিজ্য রাজনীতি আর জলপথের অন্যমত রুট পানামা খালের কাছাকাছি এলাকা ও অঞ্চলে আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের অবস্থান অবশ্য ভাবনারই বিষয় করেছে ট্রাম্পকে।
ট্রাম্পের হুমকিতে ইতোমধ্যে জাতিসংঘে নালিশও করেছে পানামা। যুদ্ধবিরোধী হিসেবে পরিচত আমেরিকার এই ৪৭তম প্রেসিডেন্ট পানামা, গ্রিনল্যান্ড আর কানাডার দিকে যে নজর দিয়েছেন তার রেশ যদি হয় সামরিক কায়দায় মানে যুদ্ধে রূপ নেয় তাহলে তা হবে যুক্তরাষ্ট্রের তার নিজের নীতিবিরোধী একটি কাজ। পানামা খাল চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে পাস হয় ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার তার সময়ে বাণিজ্যিক গুরুত্বের এই খালটি পানামা সরকারের কাছে হস্তান্তরের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। জিমি কার্টার এই চুক্তির পক্ষে সিনেটের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সদস্যের ভোটও আদায় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পানামা খাল পানামা সরকারের কাছে ফেরত দেয়াটাকে ন্যায্য মনে করেছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। ওয়াশিংটন যেহেতু তখন পর্যন্ত মধ্য আমেরিকায় আধা ঔপনিবেশিক নীতি অনুসরণ করতো, তাই জিমি কার্টারের পানামা খাল ফেরত দেয়ার মধ্য দিয়ে ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন বলে ধরা হয়।
জিমি কার্টারের পরে যারাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারে এসেছেন দুই দলের প্রেসিডেন্টরাই চুক্তিটির শর্ত মেনেছেন। প্রেসিডেন্টে রোনাল্ড রিগ্যান, জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ ও বিল ক্লিনটন। বিল ক্লিনটনের দ্বিতীয় মেয়াদের মাঝামাঝি ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর পানামা খাল পরিচালনার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে দেশটির সরকারের হাতে দেয়া হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রশাসনের তথ্য বলছে, আমেরিকার বন্দরগুলোতে যতো জাহাজ যাতায়াত করা তার দুই-তৃতীয়াংশের বেশি পণ্য ও সেবা পরিবহনকারী জাহাজ পানামা খাল ব্যবহার করে। তবে ট্রাম্প অভিযোগ তুলেছিলো সম্প্রতি চীন পানামা খাল ও আশেপাশের অঞ্চল তাদের নিজেদের কাজে ব্যবহার করছে। যদিও পানামার প্রেডিডেন্ট হোসে রাউল মুলিনো এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি পাল্টা বলেছেন, পানামা খাল ও আশাপাশের প্রতি বর্গমিটারে মালিক পানামা। আগামী দিনেও এই ভূমির প্রতি কোণার মালিকানা পানামারই থাকবে।
দেশটি জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের কাছে লেখা চিঠিতে জাতিসংঘের ঘোষণার একটি ধারার কথা উল্লেখ করে বলেছে, নয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোলাল্ড ট্রাম্পের হুমকিতে তারা উদ্বিগ্ন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ২৪২ নম্বর রেজুলেশনের-অন্য দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা বা ভূখণ্ডের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে শক্তি ব্যবহার বা হুমকি দেয়া যাবে না বলে যে ঘোষণা রয়েছে তা স্মরণ করিয়েছে পানামা। যুদ্ধের সামরিক বিশ্লেষণে প্রতি হাজার সাধারণ মানুষের জন্য ২০ জন সৈন্য বরাদ্দ থাকে। ৪৫ লাখ পানামাবাসীর বিরুদ্ধে মাত্র ৫০০ বর্গমাইল ভূমির জন্য ট্রাম্প ৯০ হাজার সামরিক সৈন্যের শক্তির প্রয়োগ করবেন কি না তার দিকেই এখন চোখ সবার। বিশ্ব বাণিজ্যের ৬ শতাংশ অবদান রাখা আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের এই সংযোগ খালের জন্য যুদ্ধ হলে উত্তর-আমেরিকার দক্ষিণের দেশটির পাশে অনেকেই থাকবেন। স্পেন ও কলম্বিয়া থেকে দুই দফায় মুক্তি পেয়ে ২৯ হাজারের বেশি বর্গমাইলের এলাকার বাসিন্দারা আর নতুন কোনো উপনিবেশও প্রত্যাশা করছে না এই মুহূর্তে।
লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক