![আইন শিক্ষাবোর্ড যেনো গতানুগতিক না হয় আইন শিক্ষাবোর্ড যেনো গতানুগতিক না হয়](https://www.amaderbarta.net/media/imgAll/2023November/no-name-2502090603.jpg)
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নানা ক্ষেত্রে সংস্কার উদ্যোগের মধ্যে আট সদস্যের বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গঠন করা হয় ৩ অক্টোবর। এই কমিশন বেশকিছু প্রস্তাব দিয়েছে খসড়া প্রতিবেদনে। এতে পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা প্রধান, বিচারপতি ছাড়া অন্য বিচারক নিয়োগে পৃথক কমিশন গঠন, দেশের সব প্রশাসনিক বিভাগে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা, জেলা পর্যায়ে বাণিজ্যিক আদালত প্রতিষ্ঠা, উপজেলায় দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত প্রতিষ্ঠা, স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠনের মতো সুপারিশও করা হয়েছে।
তাদের অনেকগুলো প্রস্তাবের মধ্যে আমাদের কাছে একটি প্রস্তাব খুব উল্লেখযোগ্য মনে হচ্ছে। আর সেটি হলো আইন শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন দেখভাল করার জন্য একটি স্থায়ী ও স্বতন্ত্র শিক্ষাবোর্ড প্রতিষ্ঠা করার সুপারিশ। একই সঙ্গে এই বোর্ডের আইন শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সুপারিশও করেছে। একটি বোর্ড গঠন হলেই যে, শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ করা যায় কমিশন সে ব্যাপারে সচেতন।
আমাদের সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, কারিগরি শিক্ষা বোর্ড ও মাদরাসা শিক্ষা রয়েছে কিন্তু এ বোর্ডগুলো এক রুটিন দায়িত্ব ছাড়া কখনো কোথাও কোনো ধরনের ইনোভেশন দেখাতে পারেনি। বোর্ডগুলো নামে স্বায়ত্তশাসিত কিন্তু কাজে সরকারের পুরো নিয়ন্ত্রণে আর বোর্ডের চেয়ারম্যান, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকসহ যারাই এসব পদে নিয়োগ পান তারা সবাই রাজনৈতিক বিবেচনায় এসব পদে বসেন। ফলে, তাদের দ্বারা নতুন কিছু বা শিক্ষার প্রকৃত উন্নয়নে কিছু করা আর সম্ভব হয় না। তাই বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন সম্ভবত এই বিষয়টি বুঝতে পেরেই সে অনুযায়ী সুপারিশ করেছে। আমরা আশা করছি আইন শিক্ষার উন্নয়নে যে বোর্ড গঠনের কথা কমিশন বলেছে সেটি আর বিরাজমান শিক্ষাবোর্ডগুলোর মতো গতানুগতিক হবে না। সেটি নিশ্চিত করা গেলে আইন শিক্ষার মান অবশ্যই উন্নত ও আন্তর্জাতিক মানের হবে।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার কাছে ২৫২ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদন জমা দেন কমিশনের প্রধান সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান। আমরা বলতে চাই আইন শিক্ষার গুণগত মানের জন্য স্বতন্ত্র শিক্ষাবোর্ডের দাবিটি প্রশংসনীয়। তবে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সাধারণত কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ থাকলে ভালো হয়। যেহেতু এ ধরনের বিশেষায়িত কোনো বিশ্ববিদ্যালয় দেশে নেই সেই অর্থে কমিশন সম্ভবত পৃথক বোর্ড গঠনের সুপারিশ করেছে। এর সঙ্গে আরো দেয়া হয়েছে আইন শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজিকে উৎসাহিত করার প্রস্তাব। এটিও সময়োপযোগী প্রস্তাব। কারণ, আইন বিষয়টি শুধু দেশীয় আইনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও এর বিস্তৃতি রয়েছে।
তুলনামূলক আইন বা বিশ্বের কোথায় কি আইন প্রচলিত ইত্যাদি জানার জন্য ইংরেজিকে গুরুত্ব দেয়ার কথা বলেছেন। এটিও প্রশংসার দাবি রাখে। এ ছাড়াও জমা দেয়া সংস্কার প্রস্তাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন (সম্মান) কোর্সে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা চালুর প্রস্তাব করা হয়েছে। কোর্ট ভিজিট, মুটিং ও ল ক্লিনিকের পাশাপাশি গবেণষার গুরুত্ব দিয়ে আইন শিক্ষার পাঠ্যসূচি আধুনিকায়নের সুপারিশ করা হয়েছে। আমরা সাধুবাদ জানাই এ ধরনের প্রস্তাবকে। মাধ্যমিক শ্রেণিতে আইন ও মানবাধিকার বিষয়ে নিবন্ধ অন্তর্ভূক্ত করা এবং উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে আইনকে একটি বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। এটিও যুক্তিযুক্ত প্রস্তাব। দেশের কারিকুলামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভাগ বিশেষ করে এনসিটিবি এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পারে যদি কমিশনের সুপারিশগুলো সরকারের অনুমোদন লাভ করে।
কোনো দণ্ডিত অপরাধীকে ক্ষমা প্রদর্শনে রাষ্ট্রপতি বা নির্বাহী বিভাগের যে এখতিয়ার রয়েছে তা নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাব দিয়েছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। এতে আদালতে চূড়ান্তভাবে দণ্ডিত অপরাধীকে রাষ্ট্রপতি বা নিবার্হী বিভাগ কর্তৃক ক্ষমা প্রদর্শনের একচ্ছত্র ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশে বোর্ড প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে, যার সুপারিশের ভিত্তিতে ক্ষমা প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। উপজেলা পর্যায়ে আদালত স্থাপনেরও সুপারিশ করেছে বিচার কমিশন। উপজেলা পর্যায়ে আদালতের কার্যক্রম বিষয়ে খসড়ায় বলা হয়েছে, উপজেলা সদরের ভৌগলিক অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য, জেলা সদর থেকে দূরত্ব ও যাতায়াত ব্যবস্থা, জনসংখ্যার ঘনত্ব ও বিন্যাস এবং মামলার চাপ বিবেচনা করে কোন কোন উপজেলায় আদালত স্থাপন করা প্রয়োজন বা প্রয়োজন আছে কিনা এবং সেগুলোর ভৌগলিক এখতিয়ার পুনর্বিন্যাসের প্রয়োজন আছে কি না, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুপারিশ করা হয়েছে। কমিশনের সুপারিশে আরো বলা হয়েছে, উপজেলা আদালতগুলোতে জ্যেষ্ঠ সহকারী জজ পর্যাযের বিচারকদের পদায়ন করতে হবে এবং তাদের দেওয়ানি ও ফৌজদারি উভয় এখতিয়ার দিতে হবে। আইনগত সহায়তা কার্যক্রম ও বিকল্প নিষ্পত্তির ব্যবস্থা, বিশেষত মধ্যস্থতা পদ্ধতি উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত সম্প্রসারিত করার কথা সুপারিশে বলা হয়েছে।
প্রস্তাবিত সুপারিশে উপজেলা সদরে দেওয়ানি ও ফৌজাদারি আদালতসহ লিগ্যাল এইড কার্যক্রম সম্প্রসারণের কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি বিভাগীয় শহরে হাইকোর্টের স্থায় সার্কিট বেঞ্চ গঠনেরও কথা থাকছে প্রস্তাবনায়। এর আগে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন ও পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন সরকারের হাতে তুলে দেয়া হয়। তবে বিচার বিভাগ সংস্খার কমিশন প্রতিবেদন জমা দিতে একাধিকবার সময় বাড়ায়। অংশীজন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে প্রায় চারমাস পর বিচার বিভাগের জন্য এ সংক্রান্ত ৩০টি সংস্কার প্রস্তাব করেছে সংস্কার কমিশন। বিষয়টি অত্যন্ত জটিল এবং অনেক বিষয় স্পর্শকাতর হওয়ায় কমিশন একটু বেশি সময় নিয়েছে সেটি হতেই পারে। সময় একটু বেশি নিলেও বিচার বিভাগের জন্য, দেশের জন্য ও জনগণের জন্য প্রকৃত মঙ্গলজনক কিছু প্রস্তাব, সুপারিশ পাওয়াটা নিশ্চয়ই কল্যাণকর।
তবে, বিচার ও আইন বিভাগের বিশেষায়িত বিষয়গুলো সাধারন জনগণের কাছে স্পষ্ট থাকে না। তাই, উচ্চ মাধ্যমিকে একটি বিষয় হিসেবে চালু হলে শিক্ষাথী, শিক্ষক, প্রতিষ্ঠানসহ অনেক সাধারণ মানুষের কাছে বিষয়টি জনপ্রিয় এবং খোলামেলা থাকবে। সর্বোপরি, একটি আইন শিক্ষা বোর্ড গঠিত হলে সেটি সাধারন মানুষের কাছে আইন শিক্ষাকে আরো জনপ্রিয় করবে এবং আইন শিক্ষার মানকে উন্নত করতে ভূমিকা রাখবে। কমিশণ বেশ কিছু ইনোভেটিভ প্রস্তাব পেশ করেছে। এজন্য কমিশনকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়।