ঢাকা শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ , ৯ ফাল্গুন ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

কর্মবিমুখতা, বেকারত্ব ও কর্মমুখী শিক্ষা

মতামত

মো. নজরুল ইসলাম, আমাদের বার্তা

প্রকাশিত: ০৮:৪০, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

সর্বশেষ

কর্মবিমুখতা, বেকারত্ব ও কর্মমুখী শিক্ষা

বলতে দ্বিধা নেই আমরা গতানুগতিক যে শিক্ষা গ্রহণ করি সে শিক্ষা আত্মপ্রতিষ্ঠায় ও বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষাপটে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জীবন যুদ্ধের পাথেয় যোগাতে ব্যর্থ। শিক্ষা মানবসমাজকে অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার থেকে মুক্ত করে নতুন আলোয় উদ্ভাসিত করে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু শিক্ষা যদি জীবনঘনিষ্ঠ না হয় তবে সে শিক্ষা মানুষকে ক্রমেই হতাশ, অলস ও কর্মবিমুখ করে তোলে এবং সমাজে বেকারত্ব এনে দেয়। দেশের প্রায় অর্ধেক জনগণ অদ্যাবধি নিরক্ষর।

এই বিপুল নিরক্ষর জনতাকে শুধু অক্ষরজ্ঞান দান করলেই হবে না, বরং তাদেরকে সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী বাস্তবমুখী শিক্ষাদানের মাধ্যমে কর্মক্ষম ও দক্ষ করে তুলতে পারলে তবেই জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব। এ পরিস্থিতেতে বাস্তব জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বৃত্তিমূলক শিক্ষা অর্থাৎ কারিগরি বা কর্মমুখী শিক্ষাই পারে দেশের বেকারত্ব দূর করে জাতিকে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড় করাতে।

বাঙালি জাতি জাপানিদের মতো পরিশ্রমী নয়। কঠোর পরিশ্রম পরিহার করে আরাম আয়েশে সময় কাটাতে বাঙালির জুড়ি মেলা ভার। অধিকাংশের ধারণা, লেখাপড়ার উদ্দেশ্য হলো চাকরি করা, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা নেয়ার পেছনে বিসিএস উত্তীর্ণ হয়ে ক্যাডার সার্ভিস পাওয়া ছাড়া আর যেনো অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে না। ক্যাডার অফিসার হতে না পারলে যেনো জীবনটাই বৃথা। আর এই উদ্দেশে তাদের বিদ্যা সীমিত রাখে গাইড বইয়ের মধ্যে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে গিয়ে দেখা গেছে অধিকাংশ শিক্ষার্থী তাদের সিলেবাস সংশ্লিষ্ট বই বা জ্ঞানচর্চার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো বই নয় বরং বিসিএস গাইড নিয়ে বসে আছে অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার জ্ঞানচর্চার কোনো জায়গা না হয়ে বরং বিসিএস প্রস্তুতির জায়গায় পরিণত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের কাছে প্রশ্ন করে জানা গেছে শ্রেণিকক্ষ এবং পাঠ্যবই তাদেরকে তেমন আকর্ষণ করে না। কারণ, পরীক্ষার ফলাফল যতোই ভালো হোক না কেনো তাতে কোনো লাভ নেই, ভালো ফলাফলে কোনো চাকরি মিলবে না। অতএব সবার লক্ষ্য বিসিএস নামক সোনার হরিণ বধ যদিও প্রতিবছর ওই লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হন কয়েক লাখের মধ্য মাত্র কয়েকশ’। আর তারপর শুরু হয় বিসিএস যুদ্ধ ফেরত এমএ পাসের ব্যর্থ যুবকটির হতাশ হয়ে শুরু হয় ব্যাংক, কোনো প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা লাভের চেষ্টা অথবা নিরুপায় হয়ে ওষুধ কোম্পানি বা গার্মেন্টস-এর দ্বারস্থ হওয়া। অথচ বেকারত্ব ঘুচাবার সহজ পথ তার জন্য খোলা ছিলো সবসময়। সবাইকে এমএ পাস করতেই হবে, ক্যাডার সার্ভিস করতেই হবে এমন কোনো কথা নেই । ‘নো জব, নো লাইফ’--এমন ধারণা থেকে দ্রুতই বেরিয়ে আসতে হবে। সাধারণ কর্মমুখী শিক্ষা নিয়ে যে কেউ নিজেই একজন উদ্যোক্তা হয়ে যেতে পারে, চাকরির পেছনে না ছুটে তিনি নিজেই হয়ে যেতে পারেন একজন চাকরিদাতা। নোবেল বিজয়ী ডক্টর ইউনূস তার ‘আ ওয়ার্ল্ড অব থ্রি জিরোস’ গ্রন্থে বলেছেন প্রতিটি মানুষই একজন উদ্যোক্তা হয়ে জন্মগ্রহণ করে, তার ভেতরে সুপ্ত থাকে অসীম সৃজনশীলতা, শুধু সঠিক পথে উপযুক্ত পরিশ্রমের অভাবে তারা বেকারত্বের অভিশাপে ভুগতে থাকে। ইঞ্জিনিয়ার না হয়েও একজন শিখতে পারে ইঞ্জিনের কাজ, গাড়ির মালিক না হয়েও শিখতে পারে গাড়ির কাজ, তৈরি করতে পারে একটি ওয়ার্কশপ/কারখানা যেখানে সে নিজে কাজ করে অঢেল অর্থের মালিক হতে পারে এবং সেইসঙ্গে অন্যদেরও সেখানে কাজ দিতে পারে। এ ছাড়াও কাঠের কাজ, ধাতুর কাজ, বয়ন শিল্প, মুদ্রণ শিল্প, মৎস্য চাষ, পোলট্রি, দুগ্ধ খামার, মৌ-চাষ ইত্যাদি তো রয়েছেই। আমাদের দেশে এখনো অনেকেই জানেন না যে, মৌচাক থেকে সংগৃহীত মোম থেকে তৈরি করা যায় অত্যন্ত দামি কসমেটিকস, মৌমাছির শরীরে যে বিষ থাকে তা থেকে তৈরি হয় দুষ্প্রাপ্য ওষুধ। শুধু দরকার এসব বিষয়ে কারিগরি জ্ঞানার্জন এবং পরিশ্রম। একটি কথা সবসময় স্মরণ রাখা খুবই জরুরি--দারিদ্র কিন্তু দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সৃষ্ট নয় বরং এটি কৃত্রিমভাবে অন্য কোনো গোষ্ঠী তাদের ওপর আরোপিত অথবা নিজেদেরকে সঠিক পথে পরিচালনা না করায় উদ্ভূত সাময়িক একটি অবস্থা মাত্র, যা খুব সহজেই মোচনীয় কেনোনা তারাও প্রাকৃতিকভাবে বা জন্মগতভাবে সমান সৃজনশীল এবং কর্মক্ষমতার অধিকারী। সুযোগ পেলেই তাদের সুপ্ত মেধার স্ফুরণ অবশ্যম্ভাবী।

মেধা ও মননকে বিকশিত করার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষা। অপার সম্ভাবনাময় মানুষটি যদি সঠিক দিকনির্দেশনা না পায়, যদি সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ না পায় তবে সে সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। একমাত্র পরিকল্পিত ও বৈজ্ঞানিক উপায়ে অর্জিত শিক্ষাই তাকে করে তুলতে পারে স্বনির্ভর ও সচেতন মানুষরূপে। পাশাপাশি তাকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে পারে অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনধারার উন্নয়নে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে। কর্মমুখী শিক্ষা তুলনামূলকভাবে অল্প সময়সাপেক্ষ, কম ব্যয়বহুল এবং অল্প কাজের ভেতরেই এর ফল পাওয়া যায় বিধায় দ্রুত সময়ে অবস্থার উন্নতি করা সম্ভব। পৃথিবীর অনেক দেশেই কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষার নজির আছে এবং তারা কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করেই আজ উন্নতির চরম শিখরে আরোহন করেছে। সেখানে আমাদের মতো সবাই উচ্চশিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী নন--যারা যে শাস্ত্রে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন তারা সে শাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ হন, অন্যেরা নিছক কেরানি হবার জন্য উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন না। সেখানে যেমন গবেষক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক বা সাহিত্যিক তৈরি হচ্ছে তেমনই পেশাভিত্তিক কাজেও কর্মদক্ষ জনশক্তি তৈরি হচ্ছে। সে কারণেই আমেরিকা, বৃটেন, জার্মানি, জাপান প্রভৃতি দেশের জনগণকে বেকারত্বের অভিশাপে ভুগতে হচ্ছে না। এ বিষয়টি মাথায় নিয়ে এবং শিক্ষাকে জীবনমুখি করবার প্রয়াসে এ দেশেও বেশকিছু পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট, ভোকেশনাল ট্রেইনিং ইন্সটিটিউট, লেদার টেকনোলোজি, টেক্সটাইল ইন্সটিটিউট, গ্রাফিক আর্ট ইন্সটিটিউট এবং এ জাতীয় কিছু কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো ইতোমধ্যেই বেশ কিছু অবদান রাখতেও সক্ষম হয়েছে তবে সাধারণ মানুষের মনোজগত বা মাইন্ডসেট সেভাবে এখনো তৈরি হয়নি। ওই সমস্ত প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করা ডিপ্লোমাধারীদের এখনো সেভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। কারণ, এখানকার শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দুটোই নিম্নমানের ও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। উপরন্তু, কর্মমুখী শিক্ষার সঠিক বাস্তবায়নের জন্য কিছু কায়িক পরিশ্রমের প্রয়োজন হয় কিন্তু আমাদের দেশে কায়িক শ্রমকে ছোট এবং মানহানিকর হিসেবে গণ্য করা হয় এবং কায়িক পরিশ্রম থেকে নিজেকে বিরত রেখে বরং অলস সময় কাটানোকে কেউ কেউ প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। শ্রমিক/কর্মচারীরা মাঠে বা কারখানায় গিয়ে বিভিন্ন অজুহাতে কাজ থেকে বিরত থাকতে চায়, অফিসে কর্মকর্তারা স্ব স্ব টেবিলে কাজ করার চেয়ে অন্যের টেবিলে গিয়ে খোশগল্প করা অথবা বিনা কারণে সভা করে চা-নাস্তা বা লাঞ্চ করে সময় কাটানোর দিকেই যেনো বেশি আগ্রহী হয়ে থাকেন। অফিসে হলুদ স্টিকারযুক্ত গুরুত্বপূর্ণ যে নথিটির কাজ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাৎক্ষণিক সম্পন্ন করার কথা সেই নথিটিকে কোনো কোনো দায়িত্বহীন কর্মকর্তাকে দিনের পর দিন তার টেবিলেই ফেলে রাখতে দেখা যায়। টেবিলের কাজের চেয়ে বরং সরকারি অর্থে খাওয়া-দাওয়া করা এবং উফরি পাওনার দিকে নজর বেশি অধিকাংশ সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের। আবার কাউকে কাজ ফেলে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমাতেও দেখা যায় বিভিন্ন অফিসে। ইদানিং সেখানে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে--বড় কর্তার অফিসের সঙ্গে সংযুক্ত রাখা হয়েছে আরেকটি ছোট কক্ষ যেখানে তিনি লাঞ্চের পর একটু ন্যাপ নেবেন অর্থাৎ ঘুমাবেন। শুধু কি তাই? ওই সময়ে তার মনোরঞ্জনের জন্য তার কিছু নারী সহকর্মীও জুটে যান নিরিবিলি সেই কক্ষটিতে। এমন নজীরও পাওয়া গেছে এবং তা ফাঁস হয়েছে জুলাইয়ের ছাত্র আন্দোলনের পর।

কর্মমুখী শিক্ষার অন্যতম একটি বৈশিষ্ট হলো এই শিক্ষায় শিক্ষিত উদ্যোক্তারা সৃজনশীল ও কাজে আগ্রহী হয়ে থাকেন। যতো কাজ, ততো লাভ-এই দীক্ষায় তারা দীক্ষিত হন, কাজেই কর্মক্ষেত্রে আলস্য দেখান বা কাজে ফাঁকি দেয়ার কোনো চেষ্টা তারা করেন না। একজন উদ্যোক্তা তার প্রতিষ্ঠানে দিনরাত পরিশ্রম করে থাকেন, ৯টা-৫টা অফিস করলে তার চলে না। অতিরিক্ত পরিশ্রমের নগদ ফলই তাকে তার কাজে উদ্বুদ্ধ করে। তার অর্জিত পুঁথিগত বিদ্যার চেয়ে তিনি তার সক্রিয় কাজের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞানকেই বেশি প্রাধান্য দেন ও উপভোগও করে থাকেন। তার ছোটখাটো ব্যর্থতাকে তিনি সাফল্যের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেন এবং এই ব্যর্থতাই তাকে আরো কর্মমুখী করে তোলে।

কর্মমুখী শিক্ষাকে ফলপ্রসূ, জনপ্রিয় ও আকর্ষণীয় করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কারিগরি শিক্ষাবিশেষজ্ঞরা দ্বারা পরিচালিত হতে হবে, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ মান সম্পন্ন হতে হবে, পাসকৃতদের চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে এবং দেশে দক্ষ কর্মীবাহিনী তৈরির পাশাপাশি বিদেশে জনশক্তি রপ্তানির সুযোগ তৈরি করতে হবে। শুধু তাই নয়, তৈরিকৃত জনশক্তিকে ইংরেজি, চাইনিজ, ফরাসি এবং আরবি ভাষায় দক্ষ করে তুলতে হবে যাতে মধ্যপ্রাচ্য, নিকটপ্রাচ্য এবং দূরপ্রাচ্যের দেশগুলোতে গিয়ে তারা খুব সহজেই কাজ করার সুযোগ পান, নিজেদের দক্ষতা প্রমাণ করার সুযোগ পান। আর এভাবেই বেকারত্ব ও কর্মবিমুখতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কর্মমুখী শিক্ষাই হতে পারে অন্যতম শক্তিশালী একটি হাতিয়ার।

লেখকঃ পরিচালক,প্রশাসন(ভারপ্রাপ্ত), বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।

 

জনপ্রিয়