ঢাকা শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ , ৯ ফাল্গুন ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

ভাষা আন্দোলন থেকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান

মতামত

সাধন সরকার, আমাদের বার্তা

প্রকাশিত: ০৮:৩০, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

আপডেট: ১৫:৩২, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

সর্বশেষ

ভাষা আন্দোলন থেকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান

প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ অপশাসনের অবসানের পর ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারতীয় উপমহাদেশ দুভাগে বিভক্ত হয়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান আর হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় ভারত। পূর্ব ও পশ্চিম অংশের ভূখণ্ড মিলে পাকিস্তান আবার দুটো অংশে বিভক্ত ছিলো। শুরু থেকেই পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ পশ্চিম পাকিস্তানের বিমাতাসুলভ আচরণের শিকার হতে থাকে।

পূর্ব পাকিস্তানের ওপর নানাভাবে বৈষম্যমূলক নীতি আরোপ করা হয়। এককথায় একসঙ্গে থাকলেও পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের আত্মার সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের আত্মার সেতুবন্ধন কখনো তৈরি হয়নি। শুরুটা হয় কথা বলার অধিকার কেড়ে নেয়ার মধ্য দিয়ে। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে পশ্চিম পাকিস্তান তথা মূল পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল, গণপরিষদ ও মুসলিম লিগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ-এর ঢাকা ও চট্টগ্রাম সফরের বেশ কয়েকটি সভার বক্তৃতা পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বিরোধ ভয়াবহ তিক্ততায় রূপ নেয়। জিন্নাহ তার আলোচনার মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে শুধু উর্দু।

মূলত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার আসনে আসীন করার মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের গোড়াপত্তন হয়। জাতীয়তাবাদ এমন একধরনের শক্তি বা মানসিকতা যা জাতি ও রাষ্ট্রকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। জাতীয়তাবাদ দাবি আদায়ে বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলো। তখন যে শুধু পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছিলো এমনটি নয়।

পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যেও জাতীয়তাবাদ ছিলো! কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের ইতিবাচক জাতীয়তাবাদের কাছে পশ্চিম পাকিস্তানের বিকৃতি বা নেতিবাচক জাতীয়তাবাদ টিকতে পারেনি। ভাষা আন্দোলনের মধ্যেই বাঙালির স্বাধীনতার বীজ নিহিত-এ কথা হয়তো খোদ পশ্চিম পাকিস্তানও জানতো না! ভাষার আন্দোলনে ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের শুরুতে ছাত্র-জনতার আন্দোলন থাকলেও পরবর্তীতে তা সর্বস্তরের জনতার আন্দোলনে রূপ নেয়। ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান ছিলো একই ধরনের। ছাত্রদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে একপর্যায়ে সর্বস্তরের মানুষ বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সামিল হয়। ভাষা আন্দোলনের প্রেরণা ২০২৪-এর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানেও দারুণভাবে শক্তি জুগিয়েছে।

তৎকালীন পাকিস্তানের প্রায় ৫৬ ভাগ লোক বাংলা ভাষায় কথা বলতো। পশ্চিম পাকিস্তানের সব ধরনের নিপীড়ন, বৈষম্য ও বঞ্চনায় অতিষ্ঠ হয়ে বাংলার জনগণ প্রতিরোধের পথ বেছে নেয়। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানের কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে ভাষা বিষয়ক গৃহীত প্রস্তাব পাঠ করা হয়। এভাবেই বাংলা ভাষার দাবি প্রথম উচ্চারিত হওয়ার মধ্য দিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের’ সঙ্গে বাংলা ভাষার দাবির স্বপক্ষে স্বাক্ষর গ্রহণ করা হয়। এ সময়ে গঠিত হয় ‘তমদ্দুন মজলিস’সহ বিভিন্ন সংগঠন। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে ‘রাষ্ট্রভাষা-২১ দফা ইশতেহার-ঐতিহাসিক দলিল’ নামক একটি পুস্তিকা প্রণয়ন করা হয়। ওই ইশতেহারে ২১ দফা দাবির দ্বিতীয় দাবিটি ছিলো রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত।

১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন গণপরিষদের অধিবেশনে বলেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। তার মন্তব্যে পূর্ব বাংলায় নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রথম হরতাল পালিত হয়। ১৯ মার্চ পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্রষ্টা ও প্রথম গর্ভনর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ববঙ্গ সফরে এসে ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় বলেন, উর্দু এবং কেবলমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্র তাৎক্ষণিকভাবে ‘নো’ ‘নো’ বলে চিৎকার করে প্রতিবাদ জানায়। বাংলা ভাষার আন্দোলন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলা ভাষার দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’ ব্যাপকমাত্রায় কাজ করে যেতে থাকে। দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার সাঁটানো হয়, যাতে লেখা ছিলো-‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই।’ ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১১ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পদত্যাগ করলে ক্ষমতার পালাবদলে পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রী হন লিয়াকত আলী খান। উল্লেখ্য, ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১১ মার্চ থেকে ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ আন্দোলন শুরু করে এবং ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দের ১১ মার্চ পর্যন্ত প্রতিবছর ‘ভাষা আন্দোলন দিবস’ (১১ মার্চকে) হিসেবে পালন করা হয়।

১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নাজিমউদ্দীন আহমেদ আবারো দৃঢ় ভাষায় বলেন, ‘একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ অতঃপর রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পূর্ববঙ্গের রাজপথ উত্তাল হয়ে ওঠে। দিনটি ছিলো একুশে ফেব্রুয়ারি। শাসকগোষ্ঠীর জারি করা ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে বাংলার দামাল ছেলেরা ভাষার দাবিতে ঢাকার রাজপথে মিছিল বের করে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর হঠকারিতা ও অপরিমাণদর্শী সিদ্ধান্তের ফলে মিছিলে পুলিশি নির্যাতন ও গুলিবর্ষণের ঘটনায় শহীদ হন সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, শফিকসহ আরো অনেক ভাষাবীর। মুহূর্তেই ঢাকার রাজপথ ভাষা শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়ে ওঠে। অবশেষে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়! ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে একুশের প্রথম বার্ষিকী পালন করা হয়। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দের বগুড়ার মোহাম্মদ আলী যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী তখন আন্দোলনের মুখে বাংলাকে দেশের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেয়া হয়।

প্রত্যেক জাতিরই একটা মাতৃভাষা আছে। মাতৃভাষায় কথা বলা, চিন্তা করা, মনের ভাব প্রকাশের যে আনন্দ তা আর অন্য কোনো ভাষায় আসে না। ভাষা আন্দোলন পরবর্তী ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ছয় দফা, ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচন, ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মহান মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ ও ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ছাত্র-জনতার জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে প্রেরণা হিসেবে শক্তি জুগিয়েছে। মনে রাখতে হবে, বৈষম্য সৃষ্টিকারীরা কখনো টিকতে পারেনি আর আগামীতেও পারবে না। ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধ হলে যেকোনো বৈষম্য প্রতিরোধ করা সম্ভব। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ভাষা আন্দোলন ও ২০২৪ এর ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান তারই প্রমাণ।

ভাষা আন্দোলনের গৌরব গাঁথার ইতিহাস দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আজ বিশ্বের প্রতিটি স্বাধীন দেশে অর্থাৎ ১৯৩টি দেশে পৌঁছে গেছে। ২১ ফেব্রুয়ারি এখন ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। ইউনেসকো ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সারা বিশ্বের মানুষের ন্যায় ও সত্যের অধিকার প্রতিষ্ঠার অন্যতম উৎস! আজ বিশ্বের ২৬ কোটিরও বেশি মানুষের ভাষা বাংলা। বিশ্বের সব ভাষা সংক্রান্ত গবেষণা, চর্চা, বিকাশ ও সংরক্ষণে মাতৃভাষা গুরুত্ব পাচ্ছে এখন বেশি। সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন জাতিসংঘের অন্যতম সরকারি ভাষা হবে বাংলা। যুগে যুগে বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শকে ধারণ করে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় তরুণ প্রজন্মসহ সর্বস্তরের জনসাধারণকে আরো সচেতন ও যত্নবান হতে হবে।

লেখক: শিক্ষক

 

জনপ্রিয়