
ফেব্রুয়ারি হলো ভাষার মাস। বাংলা ভাষাকে ঐতিহাসিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার মাস। বাংলা ভাষাশহীদদের সঙ্গে ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ, যার অনন্য পৃষ্ঠপোষকতার কারণে আমরা পেয়েছি বাংলা ভাষা।
বহিরাগত সেন-আর্যদের অত্যাচারে যখন বাংলা ভাষা ও বাঙালি নিশ্চিহ্ন হওয়ার উপক্রম হয়, তখনই সুলতানি শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাষা পূর্ণমাত্রায় প্রাণ ফিরে পায়। মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে হয়তোবা কালের গর্ভে হারিয়ে যেত বাংলা ভাষা। ডক্টর কাজী দীন মুহম্মদ লিখেছেন, ‘সেনেরা কনৌজ থেকে উচ্চ শ্রেণির ব্রাহ্মণ এনে হিন্দু সমাজে কৌলীন্য প্রথার প্রচলন করেন। তারা সাহিত্য ও রাষ্ট্র ভাষায় সংস্কৃত আমদানি করে ভাষায়ও রাষ্ট্রগত কৌলীন্য প্রতিষ্ঠা করেন।শ্রীদীনেশ চন্দ্র সেন লিখেছেন, ‘বাঙ্গালা ভাষা মুসলমান-প্রভাবের পূর্ব্বে অতীব অনাদর ও উপেক্ষায় বঙ্গীয় চাষার গানে কথঞ্চিৎ আত্মপ্রকাশ করিতেছিল। পণ্ডিতেরা নস্যাধান হইতে নস্য গ্রহণ করিয়া শিখা দোলাইয়া সংস্কৃত শ্লোকের আবৃত্তি করিতেছিলেন, এবং তৈলাধার পাত্র কিম্বা পাত্রাধার তৈল এই বলিয়া ঘোর বিচারে প্রবৃত্ত ছিলেন। যোগাযোগ তাহারা হর্ষচরিত হইতে হারং দেহি যে হরিণি প্রভৃতি অনুপ্রাসের দৃষ্টান্ত আবিস্কার করিয়া আত্ম-প্রসাদ লাভ করিতেছিলেন, এবং কাদম্বরি, দশকুমারচরিত প্রভৃতি পদ্য-রসাত্মক গদ্যের অপূর্ব সমাস-বদ্ধ পদের গৌরবে আত্মহারা হইয়াছিলেন। রাজসভায় নর্ত্তকী ও মন্দিরে দেবদাসীরা তখন হস্তের অদ্ভুত ভঙ্গী করিয়া এবং কঙ্কণ ঝঙ্কারে অলি গুঞ্জনের ভ্রম জন্মাইয়া ‘প্রিয়ে,মূঞ্জময়ি মানমনিদানং’ কিম্বা মুখরমধীরম, ত্যজ মঞ্জীরম প্রভৃতি জয়দেবের গান গাহিয়া শ্রোতৃবর্গকে মুগ্ধ করিতেছিল। সেখানে বঙ্গ-ভাষার স্থান কোথায়? ইতরের ভাষা বলিয়া বঙ্গ ভাষাকে পণ্ডিতমণ্ডলী দূর দূর করিয়া তাড়াইয়া দিতেন, হাড়ি-ডোমের স্পর্শ হইতে ব্রাহ্মণেরা যেরূপ দূরে থাকেন বঙ্গভাষা তেমনই সুধী সমাজের অপাংক্তেয় ছিল-তেমনই ঘৃণা, অনাদর ও উপেক্ষার পাত্র ছিলো। বাংলা ভাষাকে সর্বপ্রথম রাজদরবারে জায়গা করে দেন সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ। তার প্রেরণায় শাহ মুহম্মদ সগীর রচনা করেন ইউসুফ জোলেখা কাব্যগ্রন্থ। এর আগে এটা ছিল নিম্ন বর্গ ও অস্পর্শের ভাষা।
তিরতিএ পরনাম করোঁ রাজ্যক ইশ্বর, বাঘে ছাগে পানি খাএ নিভয় নিভর। এ ছাড়া সুলতানি আমলে কবি দৌলত উজির বাহরাম খান রচনা করেন কালজয়ী প্রেমের উপখ্যান লায়লী-মজনু। এটি ছিলো বাংলা সাহিত্যের এক বিশেষ সংযোজন। এ আমলের সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় যারা সাহিত্য চর্চা করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কবি যশোরাজ খান, মালাধর বসু বিপ্রদাস, বিজয়গুপ্ত, কবিন্দ্র পরমেশ্বর দৌলত কাজী ও আলাওল প্রমুখ। এসব কবি-সাহিত্যিকের কালজয়ী রচনা বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। কবি হাফিজ শিরাজিকে আমন্ত্রণ জানানোর কারণে বাংলা ও বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহ ইরানের সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন। হাজার বছর আগে বাঙালি জাতির মুখের ভাষা ‘বাংলা’কে কেড়ে নিয়েছিলো দক্ষিণ ভারত থেকে আগত সেন রাজারা। সেন রাজাদের হিন্দু পণ্ডিতরা ফতওয়া জারি করেছিলো, ‘যারা বাংলা ভাষা বলবে ও শুনবে তারা ‘রৌরব’ নামক নরকে যাবে।’ ওই সময় তুর্কি বংশোদ্ভূত ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজী নির্যাতিত বাঙালিদের মুক্ত করতে এগিয়ে আসেন এবং ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র ১৮ জন ঘোড়সওয়ারি নিয়ে সেন রাজাকে পরাজিত করে বাংলাকে স্বাধীন করেন। বক্তারা বলেন, ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলাজীর বাংলা বিজয়ের মাধ্যম দিয়ে সেইদিন শুধু ভূমির বিজয় হয়নি, সঙ্গে মুক্ত হয়েছিলো বাঙালিদের মুখের ভাষা ‘বাংলা’।
লেখক: এনজিও কর্মী